Alapon

খান জাহানের ক্যান্টনমেন্টে একদিন


ক্যান্টনমেন্টের বাইরে প্রবেশ দ্বারের কাছাকাছি আমরা তিনজন

গাজী খান জাহান আলী রহ. -এর মাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরেই আছে তাঁর অফিস ও ক্যান্টনমেন্ট। এখান থেকেই তিনি খলিফতাবাদের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। আমরা মাজার পরিদর্শন করে ওনার অফিস পরিদর্শনের জন্য বের হলাম। যা ষাট গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত। দশটাকা করে ভাড়া দিয়ে ষাট গম্বুজে যাওয়ার জন্য ব্যাটারি চালিত টমটম আছে। যদিও ষাট গম্বুজ মসজিদ বলা হয় তবে এর গম্বুজ সংখ্যা ৮১ টি। মসজিদের ছাদে ৭৭ টি গম্বুজ। চারটি মিনারের উপর চারটি। সবমিলিয়ে ৮১ টি।

আভিধানিকভাবে ‘ষাটগম্বুজ’ অর্থ হলো ষাটটি গম্বুজ সম্বলিত। তবে সাধারণভাবে মসজিদটিতে একাশিটি গম্বুজ পরিলক্ষিত হয়। নামকরণের ব্যাপারে দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কেন্দ্রীয় নেভের উপর স্থাপিত সাতটি চৌচালা ভল্ট মসজিদটিকে ‘সাতগম্বুজ’ মসজিদ হিসেবে পরিচিত করে, কিন্তু সময় পরিক্রমায় এই ‘সাতগম্বুজ’ই ‘ষাটগম্বুজ’ হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে যায়। দ্বিতীয় ব্যাখ্যানুসারে, মসজিদের বিশাল গম্বুজ-ছাদের ভারবহনকারী মসজিদ অভ্যন্তরের ষাটটি স্তম্ভ সম্ভবত একে ‘ষাট খামবাজ’ (খামবাজ অর্থ স্তম্ভ) হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলে। এটি অসম্ভব নয় যে, এই ‘খামবাজ’ শব্দটিই পরবর্তীকালে বিকৃতরূপে ‘গম্বুজ’-এ পরিণত হয়ে মসজিদটিকে ষাটগম্বুজ হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলেছে। শেষোক্ত ব্যাখ্যাটি সম্ভবত বেশি গ্রহণযোগ্য। নামকরণের এই ব্যাখ্যা বাংলাপিডিয়ার।


ক্যান্টনমেন্টের সদর দরজা

খানজাহান (রহ.)-এর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদ। পিরোজপুর-রূপসা মহাসড়কের পাশে খানজাহান আলী (রহ.) মাজার শরীফ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে সুন্দরঘোনা গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে পাকা সড়ক, পশ্চিম পাশে ঐতিহাসিক ঘোড়াদীঘি। এই দিঘীটির আয়তন প্রায় ৪০ একর। কথিত আছে এই দিঘী খনন করার পর বহুদিন এখানে পানি উঠে নি। এরপর খান জাহান আলী ঘোড়ার পিঠে আরোহন করে দিঘীতে নামেন এবং পানিপূর্ণ হওয়ার জন্য দোয়া করেন। এরপর পানি উঠতে থাকে। একারণে এই দিঘীর নাম ঘোড়াদিঘী।

খান জাহান আলীর ঘোড়াদিঘী

ষাট গম্বুজের স্থাপত্য কৌশল আর লাল পোড়া মাটির উপর সুনিপুণ লতাপাতার অলঙ্করণে নানারূপে কারুকার্যখচিত মসজিদের ভেতর-বাইরে অভাবনীয় সৌন্দর্যের সমাবেশ ঘটেছে। বাংলাদেশে এতবড় ঐতিহাসিক মসজিদ আর নেই। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৬০ ফুট এবং প্রস্থ ১০৮ ফুট। আর এর উচ্চতা ২২ ফুট। এর দেয়াল প্রায় ৯ ফুট পুরু। পূর্ব-পশ্চিমে ৭টা করে ১১টি সারিতে মোট ৭৭টি গম্বুজ রয়েছে। এর মধ্যে মাঝের এক সারিতে ৭ গম্বুজের উপরিভাগ চৌকোণা, বাকি ৭০টির উপরিভাগ গোলাকার। মসজিদের ভেতরে পূর্ব-পশ্চিমে ১০টি সারিতে ৬টা করে মোট ৬০টি স্তম্ভ রয়েছে। স্থানীয় লবণাক্ত জলবায়ুর প্রভাবে যাতে ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে কারণে মসজিদের স্তম্ভের নিচে ৪ ফুট পর্যন্ত চারপাশে পাথরের আন্তরণ দেয়া হয়েছে। এসব পাথর বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছিল। মসজিদের ভেতর এমন জ্যামিতিক পদ্ধতিতে স্তম্ভগুলো বিন্যাস করা হয়েছে যে ইমাম সাহেবের দৃষ্টি মসজিদের যে কোনো প্রান্ত পর্যন্ত কোনো বাধা ছাড়াই পৌঁছতে পারে।


ষাটগম্বুজের পূর্ব ও দক্ষিণ পার্শ্ব

মসজিদে দরজা আছে মোট ২৫টি। এর একটি দরজা রয়েছে পশ্চিম দিকে, যা সম্ভবত জানাজার নামাজ পড়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। ছাদ থেকে প্রায় ১৩ ফুট উঁচু মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার আছে। সামনের মিনার দুইটির ভেতর দিয়ে ওপরে যাওয়ার জন্য ঘোরানো সিঁড়িপথ রয়েছে। এ দুইটি মিনারের ভেতরে খিলানের সাহায্যে নির্মিত একটি করে ছোট কক্ষ রয়েছে। এ কক্ষ দুইটির নাম ‘আন্ধার মানিক’ ও ‘শলক মালিক’। মিনার দুইটি আজান দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো বলে মনে হয় এবং একইসাথে এসব মিনারে চড়ে খানজাহানের সৈন্যরা পাহারা দিতেন, বহিঃশত্রুর চলাচলের ওপর নজর রাখতেন।


মসজিদের অভ্যন্তরে ষাটটি পিলারের একাংশ

খানজাহান (রহ.) জৌনপুরের দক্ষ নির্মাণ শিল্পী এনে এই সুবিশাল সুরম্য মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে কত সময় এবং কত লোক এর নির্মাণ কাজ করেছেন তা জানা যায়নি। এ মসজিদে প্রায় আড়াই হাজার লোক এক সঙ্গে নামায পড়তে পারে। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে অযত্নে অবহেলায় মসজিদটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। ১৯০৪ সালে ইংরেজ শাসনামলে পুরাতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক এটি সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। এরপর মসজিদটিকে কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের চারপাশে সীমানা প্রাচীর রয়েছে। পূর্ব দিকে ছিল প্রবেশ তোরণ। তোরণের দু'পাশের দু'টি কক্ষ ছিল কিন্তু এখন তার কোন অস্তিত্ব নেই।


যাদুঘরে অবস্থিত খলিফতাবাদের মানচিত্র

এটি শুধু মসজিদ ছিল না, খানজাহান (রহ.) এর দরবার ও সেনা ছাউনি হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এখান থেকেই তৎকালীন দক্ষিণাঞ্চলীয় স্বাধীন-সার্বভৌম ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র হাবেলী পরগণা বা খলিফাতাবাদ রাষ্ট্র পরিচালনা করা হতো। বর্তমান ষাট গম্বুজ মসজিদ প্রাঙ্গণের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো জাদুঘর। ১৯৯৩ সালে এখানে জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। জাদুঘরে ২৮টি গ্যালারি রয়েছে। এখানে খানজাহান (রহ.)- এর আমলের শতাধিক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে।

আমাদের দুপুরে মঈন সাহেবের বিয়ের দাওয়াত ছিলো। তাই এখানে বেশি সময় অতিবাহিত করার সুযোগ পাইনি। একটার মধ্যেই খুলনায় ফেরার তাগিদ থেকে অনুপম এই নিদর্শন থেকে বিদায় নিই। ষাট গম্বুজের ঠিক উল্টোপাশেই রয়েছে সিঙ্গাইর মসজিদ। ধারণা করা হয় এটি মুঘল আমলে তৈরি করা হয়। ষাট গম্বুজের এতো কাছে আরেকটি ছোট মসজিদের কেন প্রয়োজন হয়েছিলো এই উত্তর আমি কারো কাছ থেকে পাইনি।

ষাটগম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মধ্যযুগীয় এই মসজিদটি অবস্থিত। এটি একগম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। বর্গাকার এক গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদ সম্পূর্ণরূপে ইটের তৈরি। বাইরের পরিমাপ ১২.১৯ মি। এর দেওয়ালগুলি প্রায় ২.১৩ মি পুরু। মসজিদ ইমারতটির পূর্বদিকে তিনটি খিলানপথ আছে, আর উত্তর ও দক্ষিণ দিকে আছে একটি করে। পূর্বদিকের মাঝের প্রবেশপথটি পার্শ্বদেশে অবস্থিত প্রবেশপথের চেয়ে বড়। কিবলা দেওয়ালের ভেতরে আছে খাজকৃত খিলান মিহরাব যার বাইরের দিকে রয়েছে একটি আয়তাকার।


সিঙ্গাইড় মসজিদ

সিঙ্গাইর মসজিদ দেখে এসে বাসে করে আবার খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ইতোমধ্যে আকাশের অবস্থা পাল্টে গেলো। রোদযুক্ত আকাশ কুয়াশাছন্ন হয়ে পড়লো। যতই খুলনার দিকে আগাচ্ছি ততই শীত জেঁকে বসা শুরু করেছে। সোনাডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ডের পাশেই আমরা হোটেল খুঁজতে থাকলাম। খুলনায় হোটেল ভাড়া চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের তুলনায় অনেক সস্তা। আমরা একটি বড় কক্ষ যেখানে তিনটি ডাবল বেড সেট করা আছে এমন একটি কক্ষ মাত্র ১৫০০ টাকায় ভাড়া করলাম। অর্থাৎ সাত জন থাকলাম ১৫০০ টাকায়। হোটেলের সার্ভিসও খারাপ ছিলো না।

হোটেলে ফ্রেশ হয়ে ও ব্যাগ রেখে দুটোর সময় গেলাম কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে আরো অনেক পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলো। বরের সাথে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে পেট পুরে খেলাম। খাওয়া শেষে বের হলাম চা খাবো বলে। খুলনায় একটা বিষয় আমাকে অবাক করেছে। এখানে হোটেলগুলোতে চা পাওয়া যায় না। একটি হোটেলে চা চেয়েছি। ম্যানেজার বললেন এটা তো হোটেল, চা দোকান না। চা পাওয়া যায় টং দোকানগুলোতে।

টং দোকানে চা খাওয়ার পর আমার সহযাত্রীরা শহর ঘুরেছেন। আর আমি আইলসা মানুষ। হোটেলে এসে ঘুম দিয়েছি। এই শীতের মধ্যে শহরে ঘোরাঘুরি আমার পছন্দ হয়নি।

পঠিত : ৯৪৪ বার

মন্তব্য: ০