Alapon

আন্দালুস, আমাদের হারানো ফিরদাউস...


হিজরী ৯২ সন, ২৭ রমজান। (৭১১ খ্রীঃ ১৯ জুলাই)
সিনেদিয়া প্রান্তর, ওয়াদী লাস্কের, স্পেন।

এ দিনে রচিত হয়েছিলো ইতিহাসের এক নতুন গৌরবোজ্জ্বল সোনালী অধ্যায়। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা ধর্মের নামে যাজকশ্রেণী ও জালেম, নিষ্ঠুর শাসকদের থেকে মাজলুম মুক্তি পেয়েছিল এদিনে।

সিউটা। মরক্কোর শেষ ও ভূমধ্যসাগরের তীরের এই অঞ্চল শাসিত হতো স্পেন সাম্রাজ্যের অধিনে। মুসলিমদর বার কয়েক স্পেন যাত্রা প্রতিহত করা হয়েছিল এই শহর থেকে । তখন এর গভর্নর ছিলো স্পেন সম্রাট প্রেরিত কাউন্ট জুলিয়ান। প্রথা অনুসারে গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান তার মেয়ে ফ্লোরিন্ডাকে রাজকীয় চাল-চলন ও রীতিনীতি শিক্ষা করার জন্য রাজা রডারিকের রাজ দরবারে পাঠায়। পরমা সুন্দরী ফ্লোরিন্ডা রাজা রডারিক কর্তৃক ধর্ষিতা ও লাঞ্চিতা হয়। এই ঘটনায় জুলিয়ান ক্ষুব্ধ হয় এবং প্রতিশোধের পথ খুঁজতে থাকে। তিনি উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্নর মূসা বিন নুসাইরকে স্পেন দখলের জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানায়।

উমাইয়া খেলাফতের তখন স্বর্ণসময়। রাজধানী দামেশকের মসনদে উমাইয়া বংশের অন্যতম শাসক আল-ওয়ালিদ সমাসীন। খলিফা আল-ওয়ালিদের নিয়োগে উত্তর আফ্রিকার গভর্নর ছিলেন মুসলিম সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর। মূসা বিন নুসাইর ছিলেন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মুসলিম বীর। তার নেতৃত্বে আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল দিগ্বিজয়ী মুসলিম বাহিনী দখল করেছে। সামনে যাওয়ার পথ হলো স্পেন। স্পেনই ছিল এসময় ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে মুসলিমদের জন্য উপযুক্ত ভূমি। কেননা স্পেনে তখন ছিলনা মানুষের কোন স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদা । খ্রীষ্টান শাসকরা প্রজাদের ওপর এহেন কোনো অত্যাচার নেই, যা প্রয়োগ করত না। ইহুদিসহ ভিন ধর্মাবলম্বীরা তো নির্যাতিত ছিলই, খোদ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরাও ছিল চরম নিষ্পেষণের শিকার । তাই হক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য এই দ্বীনের মূলমন্ত্রে অনুপ্রাণীত হয়ে স্পেনের মাজলুম জনগণকে মুক্ত করার মানসে ইসলামের শান্তির পতাকাতলে সমবেত করার জন্য মুসলিম বাহিনী ইসলামের ন্যায়ের নিশান নিয়ে ছুটে যায় স্পেন ।

-
উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের নির্দেশ মোতাবেক মুসা বিন নুসাইর সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদকে স্পেন অভিযানের দায়িত্ব দেন। ৭১১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে মরক্কো থেকে জাহাজে জিব্রাল্টার প্রণালি পার হন এবং জাবালে তারিকের পাদদেশে নোঙর করেন। সেখান থেকে তিনি স্পেনের মূল ভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হন। ৯২ হিজরীর ২৭ রমজান স্পেনের মেদিনা সিদনিয়ার নিকট গোয়াদালেট নদীর তীরে ওয়াদি লাস্কের উপত্যকার সিনেদিয়া প্রান্তরে রাজা রডারিকের বাহিনীর এক লক্ষ বাহিনীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হন। যুদ্ধের প্রাক্কালে সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ রণোদীপ্ত ভাষণ দেন । যার শুরু হয়েছিল এভাবে, ‘হে আমার সহযোদ্ধারা! কোথায় পালাবে? তোমাদের পেছনে বিশাল সমুদ্র আর সামনে শত্রুদল। ধৈর্যসহ সত্যের লড়াই করা ছাড়া তোমাদের আর কোনো পথ খোলা নেই ।’ (আবুল আব্বাস আহমদ আল-মাক্কারি, আল-মুনজিদ ফিল আলম, পৃষ্ঠা. ২৬১)

সেনাপতির ভাষণ মুসলিম বাহিনীকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে। এই যুদ্ধে মাত্র ১২ হাজারের মুসলিম বাহিনীর বিপরীতে লক্ষাধিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন রডারিক। অপরদিকে আলাহু একবার ধ্বনি দিয়ে মাত্র বার হাজার সৈন্যের ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুসলিম বাহিনীর তলোয়ারের নিচে মাটিতে লুটে পড়ে খ্রিষ্টান সৈন্যরা। অবশেষে যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় নিশ্চিত হলে রডারিক পালিয়ে যাওয়ার সময় নদীতে ডুবে মারা যায়। ওয়াদি লাস্কের যুদ্ধের বিজয় মুসলিম বাহিনীকে অপূর্ব মনোবল ও আত্নবিশ্বাস যোগায়। সৈন্য বাহিনীকে পুনরায় সুসজ্জিত করে অনধিকৃত অঞ্চলগুলো দখলের জন্য সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ অভিযান শুরু করেন। একে একে মালাগা, সেভিল, ইসিজ, মুরসিয়া ও কর্ডোভা বিজয় করে রাজধানী টলেডো মুসলিম বাহিনী বিজয় করে। অত্যাচারী যুলুমকারী গথ রাজশক্তির পতন হয়ে রাজধানী টলেডোর প্রাসাদ শিখরে উড্ডিন হয় ইসলামী নিশান। এই বিজয়োল্লাসে উত্তর আফ্রিকা থেকে এসে যোগ দেন মুসা বিন নুসাইর। কিছুদিনের মধ্যেই পুরো স্পেন মুসলিমদের দখল হয়। বিশাল উমাইয়া সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত হয়ে স্পেনের শেষ পীরেনীজ পর্বতমালা অতিক্রম করে ফ্রান্স পর্যন্ত প্রসারিত হয়।

Ahmed Usman

পঠিত : ১০০৯ বার

মন্তব্য: ০