Alapon

কাসেম সোলাইমানীর মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির চেহারা কি দাড়াতে পারে?


এই প্রশ্নের কোন সোজাসাপ্টা জবাব নাই।

মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অমীমাংসিত সংঘাত এখন চলমান। প্রায় সবগুলি সউদী আরবের চতুর্দিকে। সউদী আরবকে ভূরাজনৈতিকভাবে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনাটা কাসেম সোলাইমানীরই।
উত্তরে আসাদের সিরিয়া, দক্ষিণে অনেকাংশেই হাউথি শাসিত ইয়েমেন, পূর্বে শিয়া অধ্যুষিত ইরাক, আর উত্তর-পশ্চিম দিকে হিজবুল্লাহ শাসিত লেবানন, নাদির শাহের পর ইরান আর কখনো মধ্যপ্রাচ্যে এতটা ক্ষমতা অর্জন করেছিল বলে মনে হয় না। সউদী আরব ভূরাজনৈতিকভাবে ইরানের কাছে অবরুদ্ধ। সউদী তেলকূপে হামলার ঘটনার পরেও তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না দেখানোর প্রধান কারন এটাই।

কাসেম সোলাইমানী সরে যাওয়ার ফলে তার জায়গায় আসা ইসমাইল কানি তার মত দুর্ধর্ষ জেনারেল না হলেও প্রায় চল্লিশ বছর একসাথে কাসেম সোলাইমানীর সাথে যুদ্ধ করেছেন, পাকিস্তান-আফগানিস্তান-সিরিয়া ও ইয়েমেনে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্বল্পমেয়াদে তাই কাসেম সোলাইমানীর অভাব অনুভুত নাও হতে পারে, তবে এহেন দুর্ধর্ষ জেনারেল রোজ রোজ জন্মান না, এই ধাক্কা ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতরভাবে ইরান উপলব্ধি করবে। আবার, ইরান ঐতিহাসিকভাবেই মেধাবী সেনাপতিতে পরিপূর্ণ, তাই আরো মেধাবী কেউই যে তার জায়গায় অদুর ভবিষ্যতে আসবেন না, সেটা বলা যাচ্ছে না।

কাসেম সোলাইমানীর হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন এসে যায়, যেগুলোর জবাব দেয়ার মাধ্যমে তার হত্যার ফলে কি হতে পারে সেটা আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি।

১)তার অবস্থান কেউ একজন আমেরিকার কাছে ফাস করেছে এটা নিশ্চিত। সে অবশ্যই তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ হয়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে, এটা হওয়া অসম্ভব না, সোলাইমানীকে ইরানের ভেতর থেকেই কোন একটা পক্ষ সরিয়ে দিতে চাচ্ছিল, যা সিআইএর কাছে একটা সুযোগ হিসেবে আসে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘরের ভেতর প্রচণ্ড চাপে আছে, সে এই সুযোগটা হাতছাড়া করে নি।

২)সোলাইমানী ইরানের রাজনীতিতে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন, যা তার আভ্যন্তরীন শত্রুর সংখ্যা বাড়ার কারন হতে পারে, এমনকি কিছু অতি শক্তিশালী শত্রুও তৈরি করে ফেলতে পারে।

৩)সোলাইমানীকে হত্যার ফলে একই সাথে ইরানে মধ্যপন্থী রাজনীতি দুর্বল হল, পাশাপাশি আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প হিরো বনে গেলেন। ইরানে ক্রমেই সরকারবিরোধী অসন্তোষ বাড়ছিল। সোলাইমানীর মৃত্যুর বেনিফিশিয়ারি ইরানের শাসকশ্রেণী ও রিপাবলিকান পার্টি, উভয়েই।

৪)ক্রমেই কোনঠাসা হতে থাকা মোহাম্মাদ বিন সালমান এবং নেতানিয়াহু দুজনেই অকল্পনীয় স্বস্তি পেয়েছেন। এবার ইজরায়েলের জর্ডান ভ্যালি দখলের পথ নিষ্কন্টক হল। মোহাম্মাদ বিন সালমান ইয়েমেনে সুবিধা করতে না পারলেও ইরাকে তার নয়া ভেঞ্চারে নামার প্রচুর সম্ভাবনা আছে।

৫)সিরিয়া থিয়েটারে কিছুই বদলাবে না আপাতত, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেখানে তুর্কী প্রভাব বাড়তে থাকবে। একই কথা জর্ডানেও প্রযোজ্য।

জেনারেল কাসেম সোলাইমানী এমন এক সময়ে মারা গেলেন যখন ক্রমেই তুরস্ক-কাতার-ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একটি অক্ষ হিসেবে জমাট বাধতে শুরু করেছে এবং পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিতে চলেছে। এই সময়ে ইরানের সামরিক শক্তির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মঞ্চ থেকে সরে যাওয়া প্রধানত ইজরায়েল-সউদী-আমিরাতি পক্ষেরই উপকার করলো।

মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সংযোগস্থল পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিশ্বের পরবর্তী বড় ভূরাজনৈতিক খেলাড় সূত্রপাত হতে যাচ্ছে। এই খেলার এক পক্ষে ইজরায়েল, ইইউ, মিসর (সউদী ও আমিরাতের প্রক্সি), খালিফা হাফতার, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস, অপরপক্ষে তুরস্ক ও লিবিয়ার জিএনএ সরকার, তিউনিসিয়া। রাশিয়া ও আমেরিকার কেউই এই খেলায় এখনো সরাসরি নামে নি।
২০২৩ সালে ঐতিহাসিক লসান চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে, পুর্ন হবে উসমানী সালতানাত বিলুপ্তির একশো বছর। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পাওয়া বিপুল খনিজ সম্পদ ও ঐ অঞ্চলের ক্ষমতার মিথস্ক্রিয়া ক্রমেই সিরিয়ার পশ্চিমে থাকা লাতাকিয়া নৌ ঘাটি ও লেবাননকে এই সংকটে জড়িয়ে ফেলবে। কাসেম সোলাইমানীর উপস্থিতি এই সংকটে সউদী-আমিরাতি-ইজরায়েলী অক্ষের বিরুদ্ধে তুরস্ক-ইরান-কাতার অক্ষকে অনেকাংশে এগিয়ে রাখতে পারতো।

সুন্নীদের রক্তে গোসল করা সোলাইমানী এমন এক সময় নিহত হলেন, যখন সুন্নীদের বৃহত্তর রাজনৈতিক কল্যাণে তাকে কাজে লাগানোর সুযোগ কেবল তৈরি হতে শুরু করেছে।

মুহাম্মাদ সজল

পঠিত : ৪৮৬ বার

মন্তব্য: ০