Alapon

জেনারেল কাসেম সোলেমানী হত্যা; অগ্নিগর্ভ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি...


এ এক নতুন কারবালা:-

মুহররমের ১০ তারিখে শিয়ারা হায় হোসেন,হায় হোসেন রব তুলে শোক প্রকাশ করে। জেনারেল কাসেম সোলেমানীর হত্যার পর ইরানের প্রত্যেকটা শহর,জনপদে হাহাকার বইছে। কারবালার শোক প্রকাশের সাথে যদিও এটা তুলনীয় নয়,কিন্তুু ৫ হাজার বছরের পুরনো মহান পারসিক সভ্যতার উত্তরাধিকারীদের কাছে ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির মৃত্যু অবশ্যই চরম ক্ষতির কারণ।
শিয়াদের কাছে তিনি এক জেমস বন্ড। হিটলারের দুর্ধর্ষ সেনাপতি মরুভূমির শেয়াল নামে পরিচিত রোমেলের প্রতিমূর্তি। ৬২ বছরের জীবনে তিনি কি না করেছেন? এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাঁর। ১৯৭৯ সালে ইরানী বিপ্রবের পর থেকেই তিনি জড়িয়ে আছেন ইরানের সামরিক বাহিনীতে। ১৯৮০ সালে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে তিনি সফলভাবে বহু আঘাত মোকাবেলা করেন। নব্বই দশকে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাফসানজানির সাথে মতবিরোধ হলে তিনি কিছুদিন নিস্ক্রিয় ছিলেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান ছিলেন। কুদস্ বাহিনী তাঁর হাতে গড়া। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি কিছু। ইরানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন-আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। একমাত্র খামেনির কাছেই তিনি জবাবদিহি করতেন। রাজনীতির মাঠে কখনোই উৎসাহী ছিলেন না। তারঁ নেতৃত্বে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইরান বিরোধী ফ্রন্টগুলো মার খাচ্ছিলো একে একে। খামেনি তাকে অভিহিত করেছিলেন বিপ্লবের জীবন্ত শহীদ। তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন-অর্ডার অব জুলফিকার। ইরানের লোকজনের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। হযরত আলীর (রাsmile সেনাপতি মুখতার আল মালিকের সাথে তুলনা করা হতো তাঁকে।

যা যা করেছেন তিনি:-

চিরশত্রু সৌদি আর ইসরাাইলের সমস্ত রণকৌশল একে একে তাঁর বুদ্ধির কাছে পরাস্ত হচ্ছিলো। লেবাননের হিজবুল্লাহ তার প্রিয় শিষ্যদের দ্বারা পরিচালিত। হিজবুল্লাহর সমর্থন ছাড়া আজ লেবাননে সরকার হয় না। হিজবুল্লাহকে আর ঘাঁটাতে চায় না ইসরাইল ২০০৬ সালের পর থেকে। লেবাননে সৌদি-ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষশক্তি ব্যর্থ। ইরানের হুকুম ছাড়া আজকাল ইরাকের একটি গাছের পাতাও নড়ে না। ইরাকের প্রায় সমস্ত লোক ইরানের ভক্ত। ২০০৮ সালে সিআইএর সাবেক পরিচালক ডেভিড পেট্রাউসকে হুংকার দিয়েছিলেন সোলেমানী। তিনি বলেছিলেন-পুরো মধ্যপ্রাচ্যের সবকিছু তাঁর হাতের মুঠোয়। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তিনি বলেছিলেন- You will start the war but we will end it.
ইসরাইল-মার্কিন সমর্থিত গণমাধ্যমগুলোই তাকে বিশ্বের এক নাম্বার সমরবিশারদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাকে হত্যা করার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ ও বারাক ওবামাও চেষ্টা চালিয়েছিলেন-কিন্তুু পরিণতি মারাত্মক হতে পারে-সে চেষ্টায় তারা আর পা বাড়ান নি। সেই কাজটিই করে ফেললেন-ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তিনি সহায়তা দিয়েছেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীদের। হামাস ইরানের পক্ষ হয়ে কথা বলে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা তার মদদপুষ্ট। আইএস দমনে তিনি এক মাস্টারমাইন্ড। সিরিয়ার আসাদ সরকার তাঁর সমর্থন না পেলে খড়কুটোর মতো উড়ে যেতো। তাঁর মূলত কাজ ছিলো ইরানের বাইরে ইরানবিরোধী শক্তিদের সামরিকভাবে দুর্বল করা ।অনুগত বাহিনী তৈরী করে প্রক্সিযুদ্ধটা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছিলো ইরান। কয়েকদিন আগে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে যে হামলা হলো-তা যে তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত-তা আর বলার বাকী রাখে না।

কেন মরলেন তিনি:-

কয়েক দিন আগে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে ব্যাপক তান্ডব চালায় ইরান সমর্থিত কাতিব হেজবুল্লাহর একটি দল। তার আগে আমেরিকা এই সংগঠনের অন্তত ১৫ জনকে হত্যা করে। জেনারেল কাসেম সোলেমানী ইরাকে গিয়েছিলেন-এই সংগঠনকে তরতাজা করতে। দূতাবাসে হামলা তাঁরই পরিকল্পনার অংশ বলে কেউ কেউ মনে করেন। স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেন। বাগদাদ আন্তর্জািতিক বিমানবন্দরে তাঁকে নিখুঁত নিশানায় হত্যা করে মার্কিন ড্রোন। ইরানে ঘোষণা করা হয়েছে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক।

কি হতে পারে:-

ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে-সুপ্রাচীন পারস্য সভ্যতার অধিকারী ইরানকে মাথা নত করা সহজ হবে না কারো পক্ষেই। দশকের পর দশক জুড়ে জাতিসংঘের অবরোধ সত্বেও ইরান শিক্ষা,স্বাস্থ্য,কৃষি সহ সব খাতেই স্বয়ংসম্পূর্ন। আজ যারা কট্টর সুন্নী মতবাদের লোক তাদের কেউ কেউ তালি দিচ্ছেন বটে-কিন্তুু মনে রাখা উচিত-আজ পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে যত জ্ঞানী-গুনী জন্ম নিয়েছে তার ৯৮ ভাগের বেশি শিয়া মুসলিম। ভারতের মুঘল সম্রাটরা কিন্তুু পারস্যের সাফাভী বংশকে মাথার তাজ মনে করে তাদেরকে বাৎসরিক নজরানা দিয়ে বিশাল ভারতবর্ষকে শাসন করতো। ইরানের আছে-সাম্রাজ্য শাসন করার এক সুমহান ঐতিহ্য। যার ধারেকাছে নেই সৌদি সহ বাদবাকী সুন্নী তাবেদার রাষ্ট্রগুলোর। ইরান অবশ্যই প্রতিশোধ নিবে। খুব ধীরে সুস্থে রয়েসয়ে। তবে,ওই অঞ্চলে শান্তির আশা এখন সুদূর পরাহত।

আমিনুল ইসলাম

পঠিত : ৬৯২ বার

মন্তব্য: ০