Alapon

অদ্ভুত এক জীবনের গল্প...


ঈদের আগের রাত! ইতিকাফ শেষে রিক্সায় করে বাসায় ফিরছি। বাসায় ফেরার সময় দেখলাম এই শহর ফাঁকা! যারাও বা আছে তাদের মাঝেও চাঞ্চল্য কাজ করছে। রাতের বাস ধরে পরের দিন পরিবারের সাথে ঈদ করবে। শুধু আমার ভিতরে কোনো চাঞ্চল্য নেই। কোনো তাড়া নেই।

রিক্সাওয়ালা পিছন ফিরে চেয়ে বললেন, ‘মামার বাড়ি কই?’
বললাম- রংপুর।
এর পরের প্রশ্ন ছিল- ‘বাড়ি যাইবেন না?’

আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি। রিক্সাওয়ালা হয়তো ভেবেছিলেন, তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানি না। যে উত্তর জানি না, তা বলব কী করে!

রিক্সা থেকে নেমে যখন বাসায় ঠুকতেছি তখন কেয়ারটেকার বললেন, ‘আপনি কই থাইক্ক্যা? বাড়ি যাইবেন না? বিল্ডিং এ তো একটা প্রাণীও নাই। থাকবেন ক্যামনে, ভয় করবো না?’

এই প্রশ্নের উত্তরও আমি জানি না। যে উত্তর শব্দমালা দিয়ে দেওয়া যায় না, সেখানে হাসিই সম্বল! মুচকি হাসি দিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম। ওঠার সময় ভাবলাম, আল্লাহ হাসিকে শুধু আনন্দ প্রকাশ করার মাধ্যমই করেননি, অনেক না বলা উত্তরের জবাব হিসেবেও হাসি প্রদান করেছেন। এই হাসি না থাকলে যে কি হতো!

পুরো বাসা অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশও অন্ধকার। ছোট বেলায় আমি অন্ধকার ভীষণ ভয় পেতাম। কিন্তু কবে থেকে যেন অন্ধকার আমার ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠল। এই অন্ধকারের মাঝে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। ওদিকে ভাইব্রেশন করা মোবাইলের স্ক্রিনে কল ভাসছে 'Amma'!

কিছুক্ষণ পর আব্বা হয়তো ইতিকাফ শেষে বাড়িতে ফিরবেন। তারপর আব্বাও একটু পর পর কল দেওয়া শুরু করবেন। কী করছি, কী খাইছি, কখন খাবো, কেন খাবো না...কত কি!

আব্বা আর আম্মার মাঝে আব্বা তুলনামূলক একটু বেশি আবেগি। ছেলেমেয়েদের প্রতি অতি দুর্বল। সেই দুর্বলতার মাঝে সবাই বুঝতে পারে, আব্বা আমার প্রতি খানিকটা বেশিই দুর্বল! এই দুর্বলতার পিছনে কারণ কী আমি জানি না। হয়তো আব্বার সবচেয়ে বেয়াড়া আর বাধ্য সন্তান ছিলাম বলেই! আমি বেয়াড়া হলেও কখনো আব্বার অবাধ্য ছিলাম না। এখনো না।

যারা অধিক ভালোবাসে তাদের কষ্ট দিতে ভালো লাগে। এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। মোবাইলটা ভাইব্রেশন মুড থেকে সাইলেন্ট মুডে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হাটতে হাটতে কমলাপুর স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

কমলাপুর ষ্টেশন আমার বহুদিনের নিঃসঙ্গতার সাক্ষি! মন খারাপ হলেই বা একাকী বোধ করলে আজও আমি কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে বসে থাকি। ট্রেন দেখি, মানুষ দেখি- আর মানুষের ব্যস্ত হয়ে ছুটে চলার গন্তব্য খুঁজি!

কিন্তু বোধ করি সেদিন কমলাপুর স্টেশন আমার নিঃসঙ্গতাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল! ঈদের আগের দিনও মানুষ বাড়ির পথে ছুটছে। ঠিক সেই মুহুর্তে ‘রংপুর এক্সপ্রেস’টি প্ল্যাটফর্মে এসে প্রবেশ করল। মনে হচ্ছিল যেন এখনই ট্রেনে উঠে বসি, তারপর ট্রেনের ড্রাইভারকে বলি- হাকাও গাড়ি! কাল সূর্যোদয়ের আগে রংপুর পৌঁছাতে পারলে তুমি যা চাবে তা-ই পাবে!

কিন্তু তা আর বলা হয় না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে খাবার খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু একটা খাবারের দোকানও খোলা নেই। আর খোলা থাকবেই বা কেন! কাল তো ঈদের দিন। সবাই তো আর আমার মত ভবঘুরে নয় যে, এই শহরে একা একা ঈদ করবে!

ঈদের দিন সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি ‘ঝুম বৃষ্টি’! এই বৃষ্টিতে কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর মজাই আলাদা। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি ৮.৩০ বাজে।

তাড়াতাড়ি গোসল করে পাঞ্জাবী পরে মসজিদে গিয়ে দেখি ঈদের নামাজ শেষ! পোড়া কপাল। তারপর শেষ ভরসা হিসেবে সিএনজি নিয়ে বায়তুল মোকাররমের পথ ধরলাম। এবং আল্লাহর ইচ্ছায় ঈদের চতুর্থ‍ জামায়াতটা পেলাম।

ঈদের নামাজ শুরু হওয়ার পর বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলো। নামাজ শেষে সবাই সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরল, কোলাকুলি করল। দাড়িয়ে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ এই ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক দৃঢ় করা দৃশ্য অবলোকন করলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে কোলাকুলি করার মত কেউ ছিল না!

বুঝলাম, আমার এখানে দাড়িয়ে থাকা বৃথা! যখন রাস্তায় হাটা শুরু করলাম তখন অনুভব করলাম আমার কপল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আমি কাঁদি না। কাঁদতে পারি না। বহুদিন হয়ে গেল কাঁদতে পারি না। এমনকি আমার প্রিয়জন মারা গেলেও কাঁদতে পারি না। আল্লাহ আমার চোখে পানি হয়তো কিছুটা কমই দিয়েছেন!

কিন্তু আজ তো আমি কাঁদতে চাই না। আর এই কান্না কেউ দেখুক তাও চাই না। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম, কিন্তু কান্না বন্ধ হলো না। তবে আকাশ থেকে আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি পুনরায় ঝরতে শুরু করল। ধরে নিলাম, এটাই হয়তো আল্লাহর সাহায্য। এরপর বৃষ্টির পানি আর আমার চোখের পানি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল...

পঠিত : ১১৩৯ বার

মন্তব্য: ০