Alapon

কাশেম সোলায়মানিঃ দ্যা অয়ারিওর ডিপ্লোম্যাট...


প্রথম যখন খবর শুনি যে আমেরিকান ড্রোন এট্যাক হয়েছে বাগদাদ এয়ারপোর্টের কাছে এবং তাতে দুইজন খুব বিশেষ ব্যক্তি মারা গেছে, যাদের একজন হয়তো কাশেম সোলায়মানি আমার কাছে মনে হয়েছে খবর যদি সত্য হয় ইরানের পেটে আমেরিকা একটা বার মনের লাথি মারল। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর যখন প্রথম কনফার্মেশান পাই তখন মনে হয়েছে ইরান এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না।


না কি পারবে? না কি পরের জন আরও দুর্ধর্ষ হবে? সোলায়মানিদের জন্ম ঘরে ঘরে হয় না, সব যুগেও হয় না। পুরা বিশ্বে সোলাইমানিকে যুদ্ধের ট্যাক্টিকে মোকাবেলা করার মতন কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নাই। সে কোন ব্লাফ বা প্রোপাগান্ডিস্ট ছিল না। ওসামা বিন লাদেন এর সাথেও নেগোশিয়েট করে তার ছেলে বউকে বহুদিন ইরানে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল। এমনকি সাউথ আমেরিকাতেও কোন কোন দেশে সোলায়মানির প্রভাব ভালো। যারা মনে করেন যুদ্ধ মানে কেবল সমান সমান সম্মুখ যুদ্ধ তাহলে দে ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড যুদ্ধ কয় প্রকার আর কি কি। অসম যুদ্ধ যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে, অসম গরিলা যুদ্ধ দিয়েই মহা পরাক্রমশালী মোঘলদের মারাঠারা কয়েক যু্গের মধ্যেই দুর্বল করে ছেড়েছিল। তার আগে তুর্কিরা মঙ্গোলদের। সেইসব ধীর গতির যুদ্ধকে কেউ ব্লাফ বললে ভুল মুল্যায়ন করা হবে। এসব যুদ্ধের ইম্প্যাক্ট ধীরে ধীরে হয়। তেমন আমেরিকা আর ইসরায়েলের বিপক্ষে ইরানের যুদ্ধটাও ব্লাফ বা প্রোপাগান্ডা নয়। ইরানকে সহজে উস্কানো যায় না, তারা কাউকে বিশ্বাসও করে না, তারা সময় নিয়ে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহন করে। তারা অনেক লম্বা রেসের ঘোড়া। পারস্পরিক অবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তারা প্রতিটি চুক্তি করে।


যুদ্ধের নানা রকম ভেদ আছে। অর্থনৈতিক যুদ্ধ, সাইবার যুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ, প্রক্সি যুদ্ধ আর একেবারে সম্মুখ যুদ্ধ। আমেরিকা এই সব যুদ্ধ করার একক ক্ষমতা আছে। আর যারা আমেরিকার মতন মহা পরাক্রমশালী নয় তারা বেশির ভাগ সাইবার, গেরিলা, আর প্রক্সির মাঝেই বেশীরভাগ সময় সীমাবদ্ধ থাকে। আর তা দিয়েই তারা আমেরিকাকে নাস্তানাবুদও করে, যেমন আফগানিস্তান, আর ইরাক। দুইটার এক খানেও আমেরিকার নিরঙ্কুশ বিজয় হয় নাই। যুদ্ধে জয়ের দুইটি ফেইজ আছে। একটা সামরিক যুদ্ধ আরেকটা তার পরবর্তী সিভিলিয়ান শাসন। যেহেতু আমেরিকার সামরিক শক্তি তুলনাহীন, সেখানে তাদের জয় হবেই, কিন্তু তারা মার খেয়ে যায় সিভিলিয়ান শাসনামলে। যা খেয়েছে আফগানিস্তান আর ইরাক উভয় দেশেই।


কাসেম সোলাইমানিকে রিপ্লেস করা মুখের কথা না। তিনি একাধারে মিলিটারি জেনারেল, যুদ্ধের অধিনায়ক, প্ল্যানার-ট্যাক্টিশিয়ান, ডিপ্লোম্যাট সব। ইরানে কাসেম সোলাইমানির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ইমাম খামেনির খুব কাছের আর প্রিয় একজন মানুষ। আমি অবশ্য বিশ্বাস করি না যে তিনি কোনোদিন ইরানের প্রেসিডেন্ট হতেন, কারন তিনি সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরন করা একজন জাত সৈনিক যিনি চাইলেই পুরা আইআরজিসি র হেড হতে পারতেন কিন্তু ছিলেন আইআরজিসির কুডস ফোর্সের হেড, যাদের পরিচালনা করে তিনি আরব সাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ইরানের প্রভাব বিস্তার করে দিয়েছেন। এখন ইরান তা কিভাবে ধরে রাখবে সেটা ধৈর্য নিয়ে দেখতে হবে।


সোলায়মানির হাত কিন্তু সিরিয়ান জনগনের রক্তে রঞ্জিত। যে কোন মুল্যে আসাদকে সিরিয়ায় ক্ষমতায় রাখাই ছিল সোলায়মানির লক্ষ্য, যেই লক্ষ্যে শহরের পর শহর ধ্বংস করেছে সোলায়মানি, কোটি মানুষকে রেখেছিল অনাহারে, অর্ধাহারে, করেছে গৃহহারা, লাখ মানুষকে করেছে হত্যা। ধীরে এগিয়েছে, কিন্তু শহরের পর শহর বেদখল শহরকে ফের খুনি আসাদের হাতে তুলে দিয়েছে। অত্যন্ত হিংস্রতার সাথে নিজের কর্তব্য পালন করেছে। ইরাক আর সিরিয়ায় আইসিস খেলাফত নির্মূলের প্রধান কারিগরও সোলাইমানি, যেই কথা অপেনলি গর্ব করে বলছে ইরাক সিরিয়ার খৃষ্টান লিডারেরা। সেই সময় সোলাইমানির সাথে আমেরিকা ইন্টালিজেন্স শেয়ার পর্যন্ত করেছে। আর আল্টিমেটলি সৌদি আরবকে চারিদিক দিয়ে আটকেছে। সৌদি আরব আর আমিরাত ইদানীং ইরানের সাথে আর নতুন করে ঝামেলা বাড়াতে চাচ্ছে না, ইরানের সাথে সমঝোতা করার কথা হচ্ছিল। গতকাল ইরাকের পার্লামেন্টে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেছে সোলায়মানি শান্তির লক্ষ্যেই ইরাকে এসেছিল, কিন্তু আমেরিকা তাকে সেখানেই হত্যা করেছে।


কিন্তু এভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অফিশিয়ালকে হত্যা করা বেআইনি। আমেরিকা সেই অর্থে ওয়ার ক্রাইম করেছে। এর আগে সুযোগ থাকা স্বত্বেও বুশ কিংবা ওবামা যেই কাজ করে নাই ট্রাম্প সেই কাজটি করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু কেন? আর এখনই বা কেন?


এরজন্য আমি প্রধান যেই চারটি কারন দেখিঃ


১) ট্রাম্পের ইম্পিচমেন্ট কেইসকে যেভাবে হোক ড্রপ করানো, যদিও রিপাবলিকান মেজরিটি সিনেট ট্রাম্পকে আল্টিমেটলি ক্ষমতাচ্যুত থেকে বাচিয়ে দিবে। কিন্তু এটা ট্রাম্পের ইগোর প্রশ্ন। হি ইজ এ নারসিসিস্টিক ম্যান।


২) ওবামাকে সব বিষয়ে টেক্কা দিয়ে গর্ব করা, ওবামা মেরেছে ওসামা বিন-লাদেনকে (অয়ান কিল), ট্রাম্পের দরকার মিনিমাম টু কিল, আইসিসের বাগদাদি, আর বিন লাদেনের চাইতে বিগার কিল কাশেম সোলাইমানি ( ওবামার সাথে ট্রামপ শ্যাড কম্পিটিশানে আছে)।


৩) সামনে নির্বাচনের আগে একটা যুদ্ধ দরকার, কারন আমেরিকানরা এই পর্যন্ত সব যুদ্ধ চলাকালিন প্রেসিডেন্টকে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসিয়েছে।


৪) নির্বাচনের জন্য ইভাঞ্জেলিক্যাল বেইসকে খুশি রাখতে ইসরায়েল রক্ষার্থে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নিধন।


সবগুলো মিলেয়েই ট্রাম্প ডিসিশান নিয়েছে লেটস কিল সোলায়মানি।


কিন্তু এতে করে কি মধ্যপ্রাচ্যে যে ডামাডল বেজে উঠবে তা নিয়ে ট্রাম্প কেয়ারও করে নাই। কুডস ফোর্সের নতুন প্রধান রিভেঞ্জ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে আর সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছে। ইরাকের পার্লামেন্ট ইরাক থেকে আমেরিকান সেনাদের চলে যাওয়ার জন্য রেজ্যুলুশান পাশ করেছে, যদিও সুন্নি আর কুর্দিরা পার্লেমেন্টে আমেরিকানদের প্রেশারে ভোট দিতে আসে নাই। এই রেজ্যুলুশান উপর ভিত্তি করে আইন যদি পাশ করে তাহলে ইরাকের সরকার সময় বেধে দিবে ইরাক থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের।


কিন্তু এখন মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের বদলে মতায়েনের প্রয়জনিয়তা বেড়েছে আমেরিকান মিত্র দেশগুলোর জন্য, আমেরিকান দুতাবাসগুলোর জন্য, আমেরিকান কনট্রাক্টরদের জন্য। এই এক সোলাইমানিকে হত্যা করে আমেরিকা নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলল। পেন্টাগন এখন ট্রাম্পকে প্রেশারে রাখবে সেনা ধরে রাখা আর বাড়ানোর জন্য।


ইরানকে আসলেই অন্যন্য পশ্চিমা দেশগুলো কিছুটা হলেও ভয় পায়, যার কারনে এখন পর্যন্ত এক ইজরায়েল ছাড়া আর কোন দেশকে সোলাইমানির হত্যার সমর্থনে কোন বিবৃতি দিতে দেখি নাই। এরদোয়ান নাকি ট্রাম্পকে বলেছিল ইরানকে যেন আর না ঘাটায়, কিন্তু ট্রাম্প তার প্রিয় তুর্কির কথা শুনে নাই। এদিকে আজ শুনলাম সৌদিআরব তাদের ফরেইন মিনিস্টারকে ট্রাম্পের কাছে মেসেজ নিয়ে পাঠাচ্ছে, ইরানকে আর যেন আমেরিকা না ঘাটায়, আর হামলা না করে। কারন আগুন জ্বালাবে আমেরিকা কিন্তু জ্বলবে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য।


কিন্তু ইম্পিচমেন্ট আর নির্বাচনকে সামনে রেখে ট্রাম্প এখন বিশ্বের কথা নয় কেবল নিজের কথাই ভাবছে। হাঊ টু উইন এ সেকেন্ড টার্ম।


আর ইরান কি করবে? যাই করবে তা দেখার জন্য আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। ইরানের ইতিহাসে এমন হয় নাই যে তারা ছাড় দিয়েছে। প্রক্সি দিয়ে হলেও শোধ নিয়েছে। ২-৫-১০ বছর পরে হলেও পালটা চাল দিয়েছে, দান মেরেছে। এখানে প্রতিপক্ষ আমেরিকা বলে কথা। যাদের সক্ষমতা অসমান্য আর অদ্বিতীয়, আর প্রেসিডেন্ট পদে বসে আছে এক খ্যাপাটে আত্মকেন্দ্রীক নিজ গর্বে গর্বিত ম্যাগালোম্যানিয়াক। কিন্তু সোলাইমানি এদের শিখিয়ে গেছে হাউ টু ফাইট এন আন ইভেন ওয়ার এন্ড সাস্টেইন দেয়ার এম্পায়ার।


ইরান এখন শোকাহত। শোক পালনে ব্যাস্ত। গতকাল মাত্র কাশেম সোলাইমানির লাশ ইরানে ফিরেছে। শহরে শহরে লাখ লাখ মানুষ শোক মিছিল করছে। পুরা ইরানকে ইউনাইটেড দেখা যাচ্ছে। যেসব শহরে সরকার বিরোধী মিছিল ছিল সেখানে এখন সবার সমবেত লাখো মানুষের শোক মিছিল।


আমেরিকার সরকার বিভক্ত, ডেমক্রেটরা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেসিডেন্টের হাতকে দুর্বল করতে হাউজে রেজুলুশান আনছে কিন্তু অলরেডি আইন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে যুদ্ধ করার প্রচন্ড ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে যার প্রয়োগে ট্রাম্প পিছ পা হবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না। ট্রাম্প এখন ইরাক আর ইরান উভয়কে বেআইনি থ্রেট দিয়েই যাচ্ছে। ইওরোপিয়ানরা আপাতত দূরে সরে আছে ট্রাম্প থেকে।


ওদিকে কাশেম সোলাইমানির অত্যন্ত কাছের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান সকল সামরিক ইন্সটলেশান আর ব্যক্তিকে লেজিটামেট টার্গেট ঘোষণা দিয়েছে। ইরাকের মোক্তাদা আল সদর ইরাকের সরকারকে প্রচন্ড প্রেশার দিচ্ছে আমেরিকান সেনা হটানোর।


২০২০ সালের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্য আরও রক্তাক্ত পথের দিকে এগুলো।

লিখেছেন: সাবিনা আহমেদ

পঠিত : ৫৬০ বার

মন্তব্য: ০