Alapon

মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানি...


সুলাইমানির কর্মজীবনঃ
ইরাক-ইরান যুদ্ধে একজন সাধারণ সৈন্য হিশেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। সচরাচর যা হয়, যুদ্ধকালীন রিক্রুটরা খুবই সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। সুলাইমানিও এর ব্যতিক্রম না। তাছাড়া তার শিক্ষাজীবনও খুব সাদামাটা। সেই যুদ্ধে ইরানের নিহতের সংখ্যা দুইলাখ ত্রিশ হাজার।

১৯৯৮ সালে তিনি কুদস ফোর্সের কমান্ডার হিশেবে দায়িত্ব পান। ইরানের বাইরে সুলেইমানির প্রথম অভিযান ছিল আফগানিস্তানে। ৯/১১ এর পর বুশ প্রশাসন ইরানের শরণাপন্ন হয়েছিল তালিবানকে উৎখাত করতে। সুলেইমানি ছিল সেই সহযোগিতা পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড। আফগানিস্তানে আমেরিকার আগ্রাসনের সময় উত্তরাঞ্চলীয় জোটের কার্যক্রম মনে থাকার কথা অনেকেরই। যারা সে আগ্রাসনকে স্বাগত জানিয়েছিল এবং সক্রিয়ভাবে আমেরিকানদের সহায়তা করেছিল।

ইরান ছিল সেই জোটের অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণের জোগানদাতা। আর আজকের হিরো সুলেইমানি ছিল সেই পরিকল্পনার উদগাতা। আজকে আমেরিকার হাতে নিহত হওয়ার ফলে আমরা অনায়াসেই তাকে ইসলামের বীর সিপাহসালার বানিয়ে দিচ্ছি। অতীত কিন্তু তা বলে না। তাদের সেই সুখের বাসর ২০১৬ তে এসেও মধুরই ছিল, অম্লত্ব এসেছে ইদানিং।

তারপর আসে ইরাকের পালা। এখানেও হাজির সুলেইমানি। খুব মজার একটা ডাইনামিক্স আছে এখানে। সুলেইমানির কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ইরাক-ইরান যুদ্ধে। যেখানে ইরাক ছিল আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট। সাদ্দামের পাশেই ছিল পশ্চিমারা। ভিন্নকথায় ইরানের যুদ্ধটা ছিল মূলত পশ্চিমের সাথে, সাদ্দাম ছিল প্রক্সি। সেই ইরাকের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সুলেইমানি আবার পশ্চিমাদের সাথেই হাত মিলিয়েছিল।

সুলেমানিকে ইরানের জাতীয় আইকনে পরিণত করেছে যে ছবিটা, সেটা হচ্ছে তিকরিতে, সাদ্দামের জন্মস্থান, ২০১৫ তে তোলা একটি পিক। হাস্যোজ্জল সুলেইমানি একদল আমেরিকান সৈন্যের কর্ডনে বুক চিতিয়ে হাঁটছেন।

সেদিন ইরানিরা অনুভব করেছিল ইরাকের উপর প্রতিশোধ নেওয়া গেছে। দুই লক্ষ নিহতের রক্তের বদলা নিয়েছেন জেনারেল সুলেইমানি। খোদ সাদ্দামের ঘরে আজকে ইরানিদের পদচিহ্ন, তাও জয়ী হিশেবে, বীরের বেশে। এই একটি পিকই তাকে ইরানিদের মণিকোঠায় ঠাঁই এনে দেয়।

সেদিনের হাস্যোজ্জ্বল পিক একথা বলে না যে মাত্র চার বছরের ব্যবধানেই আজকে যারা তাকে নিরাপত্তা দিয়ে নিচ্ছে তারাই তার প্রাণ নেবে। একথাও বলে না যে সে ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে সংগ্রামী বিপ্লবী মুসলিম বীর মুজাহিদ।
...........

একটি কথা খুব ভাল ভাবে মাথায় গেঁথে নিতে হবে। সুলেইমানি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোনভাবেই ধর্মকেন্দ্রিক না। এটা শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র স্বার্থের খেলা। শিয়া-সুন্নি বিষয় না, বিষয় হচ্ছে বিশ্বমোড়লদের স্বার্থ। যে সেটা রক্ষা করবে সেই তার বন্ধু, স্বার্থে আঘাত আসলেই শত্রু।

সৌদি-ইরানের শিয়া সুন্নি দ্বন্দ্ব হচ্ছে একটি কার্ড, যে কার্ড খেলে এক আমেরিকাই প্রতিবছর বিলিওয় ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য করছে মধ্যপ্রাচ্যে। আজকে যদি শিয়া-সুন্নি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শেষ হয়ে যায়, আগামিকালই আমেরিকার সবচেয়ে বড় খাত, অস্ত্রখাতে ধ্বস নামবে। তবে দেশের অভ্যন্তরীন পর্যায়ে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব অনেকটা বাস্তব। এবং ক্ষেত্রবিশেষে রক্তক্ষয়ীও।

সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেনে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী খেলোয়াড় ছিল সুলেইমানি। সিআইয়ের চোখে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এককভাবে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি সে। সিরিয়ার বিপ্লবকে একুশ শতকের ভয়াবহতম গনহত্যায় রুপান্তরের স্ট্রাটেজিক সে ই। আসাদ সরকারকে রাশিয়ার সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ, মাঠপর্যায়ে শিয়া মিলিশিয়া গঠন, এবং নির্মমভাবে আন্দোলন দমনের মূল পরিকল্পনাটা ছিল সুলেইমানিরই।

অবশ্য আমেরিকাও তাকে মাঠে রেখেছে কারণ আইএসের মোকাবেলায় সে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আইএস কে ইরাকে আটকে রাখা এবং দমন করার কৃতিত্বের দাবিদার সে। তার স্ট্রাটেজির সফলতার পর সর্ব মহলে তার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

বাশার আল আসাদ নিঃসন্দেহে এই শতকের কুখ্যাত খুনি, মধ্যপ্রাচ্যের খেমাররুজ। তার সরকার এবং শিয়া মিলিশিয়ারা সিরিয়ার সুন্নি মুসলিমদের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে তা সর্বজনবিদিত।

বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, এ্যামন্যাস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটসসহ বিশ্বের তাবৎ মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থা এ বিষয়ে কথা বলেছে। আর এসব খুনের দায় আজকের হিরো সুলেইমানি কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। তার সাথে আরও বহু খেলোয়াড় রয়েছে, সবাই সমানভাবে খুনি।
.............

সুলেইমানির বিকল্প:
সে নিহত হওয়ার পরপরই তার ডেপুটিকে কুদস ফোর্সের প্রধান হিশেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সে আদৌ সুলেইমানির বিকল্প হতে পারবে কিনা? উত্তর হচ্ছে, না। কেন?

ইরান-ইরাকের মাঝ দিয়ে প্রবহমান শাতিল আরব। আরব সাহিত্যের বিখ্যাত নদী। এই নদীর এক পাড়ে আরব জাতি, অন্যপাশে পারসিক। এক পাশের ভাশা আরবি, অন্যদের ফারসি। একপাশে সুন্নি অপরপাশে শিয়া। ইরানে বহু বড় বড় সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে।

সেই সাসানিদের থেকে শুরু করে সাফাভি, বর্তমান খোমেনিতন্ত্র কেউ ই এই শাতিল আরবের বাঁধা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। ভাষার এই ব্যবধান ঘুঁচাতে পারে নি। ব্যতিক্রম শুধু আজকের সুলেইমানি!
যদিও বর্তমানে ইরানের আঞ্চলিক সম্পর্কটা ব্যক্তি সুলেইমানির উপর নির্ভরশীল নয়। বরং এটা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে গেছে, যা তার অনুপস্থিতিতেও চলবে। অনেকাংশে এই সম্পর্ক আবার পরিবারকেন্দ্রিক।

কিন্তু আরবদেরকে তাদের জাতীয়তার বিপক্ষে গিয়েও কনভিন্স করতে পারে এমন সাংগঠনিক এবং ভাষাগত যোগ্যতা ইরানের কয়জন জেনারেলের আছে তা ভাবার বিষয়।

কদিন পূর্বে মিডল ইস্ট আইতে একটি কলামে দেখেছিলাম যে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অবস্থা বাইরে থেকে যতদুর দেখা যায় তার চেয়েও শোচনীয়। এর প্রধান কারণ সুলেইমানি। তার স্ট্রাটেজি গোটা অঞ্চলের হিশেব পালটে দিয়েছে।

এতটুকুতেই শেষ নয়, স্নায়ুযুদ্ধের পর গোটা বিশ্ব আমেরিকার একক তালুকে পরিণত হয়েছিল। রাশিয়া বিশ্বরাজনীতির মঞ্চ থেকে ছিটকে গিয়েছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার কেন্দ্রে রাশিয়ার পুনরুত্থান মূলত সুলেইমানির হাত ধরেই। বলা চলে এই লোকটি শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। একবিংশ শতাব্দির অন্যতম প্রতিভা নিঃসন্দেহে। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে মার খেয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র তার একজন সুলেইমানি নেই বলে। এবং সে সেইসব বিরল প্রতিভার একজন যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই এতদূর এসেছে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভা। এবং একই সাথে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকা বিষয়ে এক অনন্য প্রতিভা। তার বিকল্প পাওয়া ভার।

রাকিবুল হাসান

পঠিত : ৭৩০ বার

মন্তব্য: ০