Alapon

কেন মরতে হল কাসেম সুলেইমানিকে?


আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন। ডিসেম্বর ১৯৯৮ এর এক সন্ধ্যায় সংবাদ আসে প্রেসিডেন্ট ইরাকে এয়ার স্ট্রাইকের অনুমতি দিয়েছেন, সেদিন সন্ধ্যায় ইমপিচমেন্ট ভোটের শিডিউল দুদিন পিছিয়ে যায়।

একই কূটচালের পুনরাবৃত্তি হল বিশ বছর পর। মূলত এটাই সুলেইমানির মৃত্যুর জন্য প্রধানত দায়ী। ডোনাল্ড ট্রাম্প আগাগোড়া একজন পপুলারিস্ট। তাদের চালের কোন হেরফের হয় না। চাই সেটা ক্লিনটন হোক, মোদি কিংবা ট্রাম্প। নিজের বাক্সে দুটো ভোট বেশি কাস্টের জন্য তারা গোটা পৃথিবীকে নরকের মুখে ঠেলতেও কুণ্ঠিত্ হয় না।
........

দ্বিতীয় কারণ হল বাহ্যত দূতাবাসে আক্রমণ। তাছাড়া অবরোধ আরোপের পর ইরান নতজানু না হয়ে উলটা সেন্ট্রিফিউজ বাড়ানোর ঘোষণা, বৃটিশ জাহাজ আটক, আমেরিকান ড্রোন ভূপাতিত করা, কন্ট্রাক্টরের মৃত্যুসহ সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আমেরিকার লেজেগোবরে অবস্থা।

ট্রাম্প খুব হুমকি ধামকি দিচ্ছে সকাল বিকাল চা-নাস্তার মত, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এসব নেগেটিভ ইমেজ থেকে বের হয়ে আসাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। তাছাড়া ’৭৯ র বিপ্লবোত্তর ক্রাইসিস কিংবা ২০১২ তে বেনগাজি ক্রাইসিসের মত কোন সিচুয়েশন যেন তৈরি না হয় বাগদাদে সেটার ভয়ও ছিল ট্রাম্পের।

বেনগাজি ট্রাজেডি প্রেসিডেন্ট ওবামার বৈদেশিক নীতির একটি বড়সড় ব্যর্থতা হিশেবে গণ্য হয়। এরকম কিছু হলে ট্রাম্পের আগে থেকেই ধুঁকতে থাকা রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের এখানেই ইতি।

তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোটিভ অনালোচিত রয়ে যায় সাধারণত। সেটি হচ্ছে ইরাক। সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব খর্ব করার প্রচেষ্টা আমেরিকা-ইসরায়েল লবি খুব জোরেশোরেই চালাচ্ছে। তাছাড়া বাশার আল আসাদও বিদ্রোহীরা দমন হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে চাচ্ছে।

এমনকি রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতিও কমিয়ে আনা হচ্ছে। সেই প্রক্রিয়ায় ইরান নিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়া গ্রুপগুলোও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ফলত সিরিয়ায় ইরানের আগের প্রভাব আর নেই। তাই ইরান চাচ্ছিল ইরাক থেকে আমেরিকার অবশিষ্ট সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে এখানে পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে। এবং এই দাবি খোদ ইরাকি পার্লামেন্টারিয়ানদের দ্বারা উত্থাপন করা হয়েছে।

এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে অবরোধের ফলে ইরানের অর্থনীতি ধুঁকছে। ইরাকের অর্থনৈতিক সেক্টরগুলো এখনো আমেরিকানদের দখলে। যদি এই সেক্টরগুলো থেকে আমেরিকা বিদেয় হয় তবে সেটা যাবে ইরানের দখলে। রাশিয়া-তুরস্কও কিছুটা ভাগ পাবে।

তবে সবচেয়ে বড় উপকার হবে অবরুদ্ধ ইরানি অর্থনীতির। নির্মাণ ক্ষেত্রে মিসাইল আক্রমণ চালিয়ে আমেরিকান সিভিলিয়ান কন্ট্রাক্টর হত্যার ডাইনামিক্সটা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আর ওদিকে আমেরিকা তার জান দিবে কিন্তু টাকা দিবে না। তারা ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছেই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লোভে, আর কিচ্ছু না। আর সেখানেই কিনা ভাগ বসাতে আসছে ইরান! অসহ্য!!

যদি এসব মোটিভগুলো না থাকত তবে সুলেইমানি নিহত হওয়া তো দূরে থাক তার একটি পশমও নড়ত না। আমেরিকা-সুলেইমানি প্রেমাণুকাব্য আরো অনেক অনেক দীর্ঘায়িত হত। সুতরাং যারা আজকে ভিক্টিম বলে তাকে হিরো বানিয়ে দিচ্ছেন, মুসলিম সিপাহসালার ভাবছেন, এরকম কিছুই না। জাস্ট স্বার্থের খেলামেলা।

সুলেইমানি এতদিন প্রভুভক্ত ছিল, তাই লাঠির প্রয়োজন হয় নি। এখন পূর্বতন প্রভু পরিবর্তন করে নতুন প্রভুর (রাশিয়া) শরণ নিচ্ছে, তাই একটু শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। ব্যস, এতটুকুই।
...
ফলাফল ও সম্ভাব্য ফলাফল:

সুলেইমানির মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ইরান। শুনতে হয়ত খারাপ শুনাচ্ছে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। কীভাবে?

সুলেইমানি ছিল ৬২ বছর বয়েসী, হয়ত কয়েকবছরের ভিতরে এমনিতেই রিটায়ার নিতেন। প্রথমত ইরান এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা পাবে। কারণ এই আক্রমণ আন্তর্জাতিক নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। দ্বিতীয়ত ইরানের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ যা বিগত কিছুদিন যাবত উত্যুঙ্গে ছিল, বন্ধ হয়ে গিয়েছে অলরেডি। বর্তমান সরকারের গদি শক্তপোক্ত হয়েছে।

ইরাকের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, যা মূলত ইরানের হস্তক্ষেপবিরোধী ছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ইরাকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার দাবি তীব্র হবে। সেদেশের সার্ভভৌমত্ব লংঘনের সেন্টিমেন্ট জোরাল হবে। যা আদতে ইরানের পক্ষেই যাবে। (অলরেডি ইরাকের পার্লামেন্টে আইন পাস হয়ে গিয়েছে- বিদেশি সৈন্যরা ইরাক ছাড়তে হবে মর্মে, লাভ পুরোটাই ইরানের। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে আরও কোণঠাসা হয়ে যাবে, অপাংক্তেয় হয়ে যাবে)

এবং ইরানবিরোধী মনোভাব কমে আসবে। বাগদাদ ও তেহরানে ব্যর্থ সরকার জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা থেকে জনগনের মনযোগ অন্যত্র সরিয়ে দেবে।

দ্বিতীয় লাভ হবে ট্রাম্পের। হয়ত সে এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে, সেটা অবশ্য সময়ই বলে দিবে। ইমপিচমেন্টের ক্ষেত্রেও সে সুবিধা পাবে। আর দেশের ভিতর যে আলোচনা শুরু হয়েছে যে এই পদক্ষেপ সংবিধানসম্মত কিনা, প্রেসিডেন্ট সুলেইমানিকে হত্যার আদেশ দিতে পারেন কিনা, এগুলো নিতান্তই অবসরবিলাস। আইওয়াশ। বিশ্বকে দেখানোমাত্র যে আমরা এখনো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের এসব শ্রদ্ধার ভেক আফগানিস্তান, ইরাকে কাজে আসেনি। কখনো আসবেও না।

খুবই স্বাভাবিকভাবে সিরিয়া, ইয়ামেন, লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নিরা তার মৃত্যুকে রীতিমত উপভোগ করছেন। কারণ তারা তার উত্থানের ভিকটিম। শত শত কিংবা হাজার হাজার নয়, বরং লক্ষ লক্ষ পরিবার এই খেলার বলি হয়েছে। লেবাননি এক সাংবাদিক টুইট করেছেন যে সিরিয়ানরা এখন বাকলাভান (মধু ও বাদাম দ্বারা তৈরি সিরিয়ান মিষ্টান্ন) বিতরণ করে সুলেইমানির মৃত্যু উদযাপন করছে।
..........

কিন্তু বিষয়টি যেহেতু ইরানের জন্য প্রেস্টিজ ইস্যু, দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রাটেজিক ইস্যু, তাই ইরানের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে নিয়ে চলছে বিস্তর জল্পনা কল্পনা।

প্রথম সম্ভাবনাঃ
প্রথম সম্ভাবনা হচ্ছে যেকোন কিছুই ঘটতে পারে, কেউ তা নিশ্চিত করে বলতে পারে না। বিশেষত যখন বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ট্রাম্প, বরিস জনসন, পুতিন, মোহাম্মদ বিন সালমান আর আসাদের মত অর্ধোন্মাদ অভিনেতা হিশেবে থাকে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনাঃ
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আভাস। অতি আগ্রহীরা বলছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে। বাস্তবে ইরান কখনোই এই ঝুঁকি নিবে না। কারণ তার সেই সামর্থ্য নেই। তবে রাশিয়া যদি তার পুরোপুরি উত্থানের জন্য ইরানকে প্রক্সি হিশেবে নেয়, আর ওদিকে আছে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা যাদের একমাত্র লক্ষ্য হল যুদ্ধ বাঁধানো, যতবড় যুদ্ধ ততবেশি লাভ, তাহলে এরকমটা হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।

তৃতীয় সম্ভাবনাঃ
ইরান অত্র অঞ্চলে আমেরিকান প্রোপার্টি ও নাগরিকদের উপর প্রক্সি আক্রমণ জোরদার করবে। যদিও ট্রাম্প ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে খুব কাজ হবে বলে মনে হয় না। বিশেষত সুলাইমানির মৃত্যুর পর। কারণ একে তো সুলাইমানি ছিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা, দ্বিতীয়ত তার মৃত্যুর পর গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মত কার্যকর নেতৃত্ব, তার বিকল্প, গড়ে উঠতে বেশকিছুদিন সময় লাগবে।

চতুর্থ সম্ভাবনাঃ
ইরান আমেরিকার উত্তেজনায় ভাটা পড়বে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিভাষায় একে বলা হয় দাঁতাত (Detente)। অর্থাৎ তীব্র উত্তেজনাকর কোন পরিস্থিতির পর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর মাঝে সম্পর্ক তুলনামূলক সহজ হয়ে আসা। যেমনটা ঘটেছিল ’৬২ র ইউএস-সোভিয়েত মিসাইল ক্রাইসিসের পর। এমনকি হাল আমলে কিম জং উন ও ট্রাম্পের মাঝেও। কয়দিন খুব হুমকি ধামকির পর হঠাতই দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, তারপর বরফগলা শুরু। ইরানের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। অসম্ভব নয়।

শেষ সম্ভাবনাঃ
ইরান সম্পূর্ণ নতুন স্ট্রাটেজি নেবে। এই অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা তীব্রতর করবে। এটা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আর এই স্ট্রাটেজির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগি হবে সৌদি-আমিরাত জোট। কারণ ইরান জানে এই আক্রমণের পিছনে তাদের মদত রয়েছে। কিন্তু আমেরিকাকে কিছু বলার সামর্থ্য নেই, তাই পুরো আক্রোশ পড়বে এসব আঞ্চলিক লাঠিয়ালদের উপর।

এক্ষেত্রে ইরান শুধুমাত্র শিয়া মিলিশিয়াদের সমর্থন থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাপকভাবে সুন্নি অনুগত দল গড়ে তোলার নীতি নিতে পারে। যা বহুদিন আগে থেকেই হামাস ও ইসলামিক জিহাদের ক্ষেত্রে নিয়েছে।
তুরস্ক, কাতার সুন্নিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা এখন ইরানের অন্যতম মিত্র।

আজ থেকে দশ পনের বছর পূর্বেও কেউ স্বপ্নেও ভাবে নি যে অর্থনৈতিক দৈন্যে ঝাঁঝরা ইরান সৌদি-আমিরাতের মত মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সোনার খনির সাথে টেক্কা দিয়ে আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশে পরিণত হবে। কিন্তু সেটাই হয়েছে। হয়েছে সুলেইমানির স্ট্রাটেজিতে। তাই ভবিষ্যতে ইরান কী পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামবে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো সেটা কীভাবে সামলাবে সেটা দেখার বিষয়। তাছাড়া সৌদির ক্ষমতা যখন বিন সালমানের মত উদ্ভট খেলোয়াড়ের হাতে, ইরানের কাজ অর্ধেক তারাই করে দিবে।

রাকিবুল ইসলাম

পঠিত : ৫১৫ বার

মন্তব্য: ০