Alapon

ইতিহাসের আয়নায় গণতন্ত্র...


সাসানাইড তথা পারস্য সম্রাজ্যের ঘটনা। তৎকালীন বিশ্বের দুই সুপার পাওয়ারের একটি। রোমান সিজারের মতই প্রচন্ড ক্ষমতাধর পাারস্যের খসরু। তার কথা’ই আঈন। শেষ কথা, আর কোন কথা, বা কারো কথা চলতেও পারে না। রোমের সিজার তার কর্তৃত্বকে গণতান্ত্রিক রুপ দিতে পরামর্শ সভা করেছিলেন; সিনেট। সদস্যদের বলা হতো সিনেটর।

আপাতদৃষ্টিতে সিনেটররা সিজারকে পরামর্শ দেবে, আঈন রচনা করার কথা থাকলেও সেটা ছিল কথার কথা মাত্র। সিজারের কাছ থেকে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানান সুযোগ সুবিধা পেয়ে, কখনও বা তার রোষাণলে পড়ে প্রাণভয়ে সিনেটররা সিজারের মুখ থেকে প্রস্তাব বের হওয়া মাত্র তা পাশ করিয়ে দিতেন। গণতান্ত্রিকভাবে (?)!

নিরো’র জীবন ও কর্মকান্ড বিচার করলেই সে গণতন্ত্রের নমূনা পাওয়া যায়। শুধু মাত্র পূর্বানুমতি না নিয়ে বিয়ে করায় সম্রাট কালিগুলা এক সিনেটরের নববধু স্ত্রীকে সিনেটরের সামনেই ধর্ষণ করে, এমনকি, ক্ষোভ মেটাতে সেই সিনেটরকেও ধর্ষণ করে নিজের বিকৃত সমকামী লালসাই মেটায়নি, বরং সম্রাটের বিরাগভাজন হলে কি নির্মম ও জঘন্য পরিণতি হয়, তারও প্রমাণ রেখেছে।

ফলে সমাজের এলিট শ্রেণি তথা সুশিল সমাজও সম্রাটের মন মেজাজ বুঝে চলতো, তেমনটা চলতে বাধ্য হতো। রোমান গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত সম্রাটসহ তিরিশ পান্ডবের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই তিরিশ পান্ডবই ইতিহাসে কুখ্যাত ‘থার্টি টাইরান্ট’ (Thirty Tyrant) পরিচিতি পেয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, বহুল আলোচিত দার্শনিক প্লেটোর আপন মামা ছিলেন এই তিরিশ পান্ডব বা থার্টি টাইরান্টের একজন। প্লেটো সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির বড় বড় বুলি আওড়ালেও তিনি তার মামা কিংবা মামার এই তিরিশ সহচরদের অত্যাচার, নির্যাতন ও অপকর্মের কোন প্রতিবাদ করেননি তার লেখায়।

কেন করেন নি? প্রতিবাদ করলে কি হতো বা হতে পারতে, সেটা ঐ সিনেটর ও তার নববিবাহিতা স্ত্রী তাদের ব্যক্তিগত জীবনে যে অপমান ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, তা দেখেই বোঝা যায়!
গণতন্ত্রেও প্রসংশা বহুবার শুনেছেন পারস্যের স¤্রাটরা। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। কেউ যখন হাজার বৎসরের পুরোনো ঐশ^র্যশালী পারস্য সম্রাজ্যের তুলনা করে রোমান সম্রাট কিংবা রোমান সম্রাজ্যের রসম রেওয়াজ বা শাসনপ্রণালীর, তখন খসরুর খুব কষ্ট হয়!

রোমান ও পারসিক সাসানাইড সম্রাজ্যের মধ্যে বৈরিতা সর্বজনবিদীত। কেউ কাউকে সহ্য করতে না। সীমান্তবর্তি অঞ্চল নিয়ে দুই সম্রাজ্যের মধ্যে শতাব্দি ধরে সংঘাত ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলে এসেছে। এরকম একটা মনস্তাত্বিক ও রাজনৈতিক আবহে খসরু রোমানদের সাফল্য ও কির্তিগাঁথা শুনলে, ক্ষেপে যেতেন, রাগে ঘাড়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে যেতো!

বাদশাহ প্রথম খসরু’র শখ জাগলো, সভাষদদের মতামত নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। প্রথানুযায়ী খসরু বৎসরের শুরুতের্ই রাজ্যের সকল প্রজার উপরে কর ধার্য করতেন। এ বৎসরও করবেন। প্রতি বৎসর একাই করবিভাগের মন্ত্রীকে ডেকে করের তালিকা ধরিয়ে দিতেন, সেভাবেই কর আদায় হতো, কিন্তু এবসর যেহেতু গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করবেন, তাই সভাষদগণদের ডাকলেন আলোচনার মাধ্যমে নতুন বৎসরের কর ধার্য করবেন।

খসরুর ডাকে তার সভাষদগণ জড়ো হলে খসরুর নির্দেশে মন্ত্রীপ্রবর ধার্যকৃত কর ঘোষণা করলে খসরু সকলকে প্রশ্ন করলেন; প্রিয় উপস্থিতি, আপনার বলুন ধার্যকৃত কর যথাযথ হয়েছে কি না!

পিনপতন নীরবতা। এরকমভাবে কোনদিন তো শাহানশাহ মতামত চান নি! ত আজ কেন চাইছেন? বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ সভাষদরা নীরব দেখে খসরু অস্থির হয়ে গেলেন, জনগণের মতামত ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে কি করে? তিনি আবারও জিজ্ঞাসা করলেন; আপনারা নির্ভয়ে বলুন, ধার্যকৃত কর যথাযথ হয়েছে?

এবারেও কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। সেবাই নিশ্চুপ দেখে পেছনে বসা একজন বৃদ্ধ দাঁড়ালেন, সবার দৃষ্টি সেদিকে। খসরুও তাকালেন বড় উৎসাহ নিয়ে; তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলেন! আহা কি আনন্দ!

বৃদ্ধ দাঁড়িয়েছেন। শাহানশাহর সামনে কথা বলতে গলাটা কেঁপে উঠলে একটুখানি কেশে মাথা নুইয়ে সম্রাটকে কুর্ণিশ করে শুরু করলেন; মহামান্য সম্রাট; বাৎসরিক যে কর ধার্য করেছেন, তা জগদ্দল পাথরের মত এক সময় জনগণের উপর চেপে বসবে বলে আশংকা করছি।’

জীবনে প্রথমবার পাওয়া গণতন্ত্রের স্বাদ; বড়ই তেতো! এরকম বিশ্রি অভিজ্ঞতার জন্য খসরু মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না, হুংকার দিয়ে উঠলেন; কি এতো বড়ো কথা! আমার স্বিদ্ধান্ত জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসবে? এই, তোমরা এই দূরাচারকে একটা শিক্ষা দাও। তোমাদের সামনে রক্ষিত কলমদানিগুলো দিয়েই ওরে পেটাও!

নির্দেশটা সুস্পষ্ট, কি করতে হবে তা একেবারেই পরিস্কার। গণতন্ত্র বাস্তবায়নের এক অনন্য নজীরই বটে! বেচারা বৃদ্ধ মহামান্য নিশ্চয়তা পেয়েই গণতন্ত্র বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে গিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করতে হলো নিজের জীবন দিয়ে! কিছুক্ষণের মধ্যেই বেচারা গণপিটুনিতে প্রাণ হারালেন।

এভাবেই পারস্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন সুসম্পন্ন হয়েছিল খসরুর শাসনামলে! তবে পারস্য ও রোমান সম্রাজ্যসহ পুরো বিশ্ববাসীই প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ ও তার পূর্ণরুপ দেখেছিল সপ্তম শতাব্দির তৃতিয় দশক থেকে শুরু করে সপ্তম দশক পর্যন্ত ইসলামি শাসনে। বিশ্বাস না হলে নিজে একবার ইতিহাসটা পর্যালোচনা করে দেখতে পারেন। (সংক্ষেপকৃত)

জিয়াউল হক

পঠিত : ৪৪২ বার

মন্তব্য: ০