Alapon

মুসলমানদের আশির চক্র: সহাবস্থান, জোট ও ঐক্য...


রাজনীতিকে সাদা-কালো চোখে দেখার কোনও সুযোগ নাই। রাজনীতির একটা মৌলিক বিষয় হল- বিশ্বাস ও মতবাদের সুস্পষ্ট বিবাদ অতিক্রম করার পরে, যেখানে আত্মপরিচয়, জীবন দর্শন ও মতবাদের সহাবস্থানের অপরিহার্য্যতা উদয় হয়, সেখানে আমাদের পলিটিকাল মুয়ামালাত কেমন হবে, নেগোসিয়েশন কেমন হবে, যোগসাজশ, জোট ও চুক্তি কেমন হবে- সেইটা নির্ধারণ করা। কিন্তু আমরা যেটা করছি সেটা খুবই হাস্যকর। দেশ ও দেশের বাহিরের রাজনৈতিক ঘটনা পরিক্রমার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেই মাতাল লোকটির মতো আচরণ করছি, যে কি না নেশাতুর অবস্থায় শতকিয়া গণনায় পশ্চাদমুখী বৃত্তে আটকে যায়।

বুঝার স্বার্থে, আমি সংক্ষেপে ঐ নেশাতুর ব্যক্তির শতকিয়া গণনার একটা ডেমনস্ট্রেশন দেয়া জরুরি মনে করছি। এক লোক এতো পরিমাণ মদ্যপান করেছে যে, সে নিজের হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তো, তাঁকে যখন এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনতে বলা হল তখন সে একটা পর্যায়ে গিয়ে আশির চক্রে আটকে গেল। সেই চক্রটা হল এমন- একাশি, বিরাশি, তিরাশি, চুরাশি, পঁচাশি, ছিয়াশি, সাতাশি, আটাশি, উনআশি, আশি, একাশি, বিরাশি, তিরাশি, চুরাশি, পঁচাশি, ছিয়াশি, সাতাশি, আটাশি, উনআশি...। নেশার তীব্রতার কারণে লোকটি আটাশির পরে যে উননব্বই হবে সেটা মালুম করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেললো। বরং 'আশি'র অন্ত্যমিলের কারণে সে সেই আশির চক্রে আটকে গেল।

মুসলমানরাও বিশ্ব ও দেশিয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এই আশির চক্রে আটকে আছে। তারা আশির চক্রটা থেকে বের হতে পারছে না। আমরা যদি শিয়া-সুন্নি'র ভেদ-রেখার কথা চিন্তা করি তাহলে এই আশির চক্রটা দৃশ্যমান হয়। আমরা যদি আন্ত-ইসলামী দলগুলোর সম্পর্কের কথা চিন্তা করি তাহলেও এই আশির চক্রটা উদয় হয়। আমরা যদি ইসলাম ও সেক্যুলার পন্থীদের সহাবস্থানের কথা চিন্তা করি তাহলেও এই আশির চক্রটা উদয় হয়। আমরা আটাশি থেকে উননব্বইতে আর যেতে পারি না, চলে যাই উনআশিতে। কি এক দুর্দশাময় অবস্থা!

সহাবস্থান, জোট ও ঐক্য তিন টা জিনিসই মত ভিন্নতার বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েই সামনে আসে। সহাবস্থানটা হয় কোনও প্রকার জোট বা লিয়াঁজো ছাড়া আর জোট হয় কমন ইন্টারেস্টের ভিত্তিতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের একটা নীতিগত সমমতে আসার ভিত্তিতে। কিন্তু ঐক্য বলতে যা বুঝায় তা আরেকটু উপরের মাত্রার। এখানে কমন ইন্টারেস্ট থাকে, মত ভিন্নতা সত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী বোঝাপড়া থাকে, ত্যাগের মহিমা থাকে, আর থাকে পারস্পরিক ভাতৃত্ববোধ ও ভালোবাসা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সহাবস্থান, জোট ও ঐক্য এই তিনটি জিনিসই মত ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিয়ে, পরস্পরকে দ্বিমত পোষণ করার অধিকার প্রদান করেই একটা কমন গ্রাউন্ডে এক হওয়ার কথা বলে। পক্ষান্তরে, পক্ষবদল, দলবদল কিংবা ধর্ম বদলের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এখানে ভিন্নমতের কোনও বালাই নেই বরং পূর্বের মত কে কোরবানি দিয়ে, ওটাকে ডিলিট করেই পক্ষবদল, দলবদল কিংবা ধর্ম বদলের ব্যাপারটি ঘটে।

এই দুইটা জিনিসের মধ্যে পার্থক্য করতে অনেক বিজ্ঞ আলেমকেও আমি ব্যর্থ হতে দেখেছি। শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীনদের প্রতি সম্মান রেখেই আমি দুটি উদাহরণ দিতে চাই। যেমন শায়েখে চরমোনাই সৈয়দ ফয়জুল করীম সাহেব তাঁর একটি বক্তব্যে বলতেছেন- "কিয়ামত পর্যন্ত জামায়াত যে আদর্শের উপরে আছে, যে নীতির উপরে আছে, এই নীতি ও আদর্শের উপরে যদি থাকে- গোটা বিশ্বের সবাই ঐক্য করতে পারে কিন্তু চরমোনাই ওয়ালারা কখনও ঐক্য করবে না"। সুস্পষ্ট ভাবেই বুঝা যাচ্ছে শায়েখে চরমোনাই ঐক্য কনসেপ্টটা সম্পর্কে কোনও ধারণা রাখেন না। ফলে তিনি ঐক্যের নামে দলবদল ও পক্ষবদলের কথা বলছেন। তিনি আশির চক্রে আটকে গেছেন। বোধ করি ঐ দলের বেশিরভাগই আশির চক্রে আটকে আছেন। মাওলানা মামুনুল হকের করা মুসলিম ঐক্যের প্রতি আহবানমুলক একটা ভিডিও দেখেছিলাম গত বছর। উনি এক্সাক্টলি কি বলেছিলেন তা আমার শব্দে শব্দে মনে নেই। তবে এটা নিশ্চিত মনে আছে যে- তিনিও শায়েখে চরমোনাই হুজুরের মতো ঐক্যের নামে পক্ষবদল ও দলবদলের ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাচ্ছিলেন। এইটা রাজনীতি না। এইটা ভিন্নমতের সহাবস্থানকে সহ্য করতে না পারার রিফ্লেকশন।

বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতেও রাজনীতিকে সাদাকালো চোখে দেখার নেশা পরিলক্ষিত হয় যখন ইরানী সামরিক কর্মকর্তা কাশেম সুলাইমানি আমেরিকানদের দ্বারা নিহত হন। তখনও আমরা দেখি মুসলমানদের আশির চক্রে আটকে থেকে নিজ ভাইদেরকে শি'আ বানিয়ে দেয়ার প্রবণতার নজির। এখানেও আমরা দেখি রাজনৈতিক ব্যাপারটাকে আকিদার প্যাকেটে ঢুকিয়ে দেয়ার প্রবণতা। অথচ ইরান-মার্কিন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে সুন্নিদের মধ্য থেকে যারা ইরানকে সফট কর্নার দিচ্ছেন তারা আকিদার ভিন্নতাকে শিকার করেই এই সফট কর্নারটা দিচ্ছেন। আমরা বলছি এটা মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ বিষয় যে- সুলাইমানি কি পরিমাণ সুন্নিকে হত্যা করেছেন। একথা বলার পরে আশির চক্রে আটকে থাকা সুন্নি ভাইরা আরেক প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। তাহলে বাগদাদী, দায়েশ কিংবা বোকো হারাম কি দোষ করেছিল? কিন্তু মজার বিষয় হল, সুলাইমানির সাথে বাগদাদী, দায়েশ কিংবা বোকো হারামের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে- সুলাইমানি একটি অথোরাইজড নেশন ও স্বীকৃত ইসলামী (শিয়া) প্রজাতন্ত্রের কমান্ডে যুদ্ধের ময়দানে এসেছেন। অন্যদিকে বাগদাদী, দায়েশ কিংবা বোকো হারামদের পেছনে কোনও অথোরাইজড নেশন ও স্বীকৃত ইসলামী রাষ্ট্র বা প্রজাতন্ত্রের কমান্ড হাজির নাই। সুতরাং বাগদাদী, দায়েশ কিংবা বোকো হারাম যে পরিমাণ অসমাধান যোগ্য ফিতনা-ফাসাদের জন্ম দিয়েছে সুলাইমানির মিলিটারি পদক্ষেপের কারণে সেরকম অসমাধান যোগ্য ফিতনা-ফাসাদের জন্ম হয় নাই। আপনি স্বীকার করুণ আর নাই করুণ- এইটা একটা মৌলিক পার্থক্য। বাগদাদী, দায়েশ কিংবা বোকো হারামের কারণে কোনও প্রকার অথোরাইজড চেইন অফ কমান্ড ছাড়াই ইসলামের নামে বিশ্বব্যাপী যে আক্রমণ গুলো হয়েছে- সেগুলোর লক্ষ্যবস্তুর ক্ষেত্রে না সিভিলিয়ান নন সিভিলিয়ান ভেদাভেদ ছিল আর না শান্তিপূর্ণ এলাকা আর যুদ্ধবিদ্ধস্ত এলাকার মধ্যে ভেদাভেদ ছিল। যাইহোক, এটা খুবই বিতর্কিত একটা বিষয় এই আলাপ থামার জিনিস নয়। তবে আমি একটা মৌলিক পার্থক্য টুকে রাখলাম।

মোদ্দা কথা হল, আমাদেরকে আটাশি থেকে উননব্বইতে যেতে শিখতে হবে। আশির চক্র থেকে বের হতে হবে। আশির চক্রতে আমরা মুসলিমদের বিভিন্ন ফেরাকি দল ও উপদলের মধ্যকার আকিদা, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি জনিত পার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়েছি। আমরা একে অপরকে ভুল মনে করি বলেই অন্যের আকিদা, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করি না। পারস্পরিক ভুল ভ্রান্তিকে যার যার দায়-দায়িত্বে ছেড়ে দিয়েই আমরা সহাবস্থান, জোট ও ঐক্যের চিন্তা করবো। এটা হচ্ছে আশির চক্র থেকে নব্বইয়ের ঘরে যাওয়া। ফলে এখানে পারস্পরিক বোঝাপড়া কিংবা সফট কর্নারের কারণে তাঁর আকিদাকে প্রশ্ন করার অর্থ হল আবার সেই আশির চক্রে ফিরে যাওয়ার চূড়ান্ত মাতলামি করা। আমি সুলাইমানিকে শহীদ উপাধি দেই এই রাজনৈতিক পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে, আমার আকিদাগত বিশ্বাসের দিক থেকে তিনি শহীদ নন। এইখানে আমি আল্লাহর সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত মনে করি। আর এটার ফয়সালা তো আল্লাহ কিয়ামতের ময়দানেই করবেন। যেদিন একের দায় অন্যের উপর বর্তাবে না। অন্যদিকে আফগানিস্তানের শহীদদেরকেও আমি শহীদ মনে করি। আমি তাঁকে শহীদ বলতেছি তিনটি রাজনৈতিক গ্রাউন্ড থেকে যে- (ক) সে কুফফারদের হাতে নিহত হয়েছে (খ) সে একটি অথোরাইজড নেশন ও স্বীকৃত ইসলামী (শিয়া) রাষ্ট্র বা প্রজাতন্ত্রের কমান্ডের অধীন ছিল (গ) তাঁর জাতি (শিয়া) তাঁকে শহীদ হিসেবেই গ্রহণ করেছে।(এইটা আকিদা গত যাস্টিফিকেশন না, এটা রাজনৈতিক কম্যুনালিটির স্টেটমেন্ট)। আমি মনে করি শিয়া মতবাদের সাথে আমার সুন্নি মতবাদের আকাশ পাতাল তফাতকে স্বীকার করেই আমি এই অবস্থানে আসতে পারি। সুতরাং আকিদা ও মত ভিন্নতার বিভাজন চূড়ান্ত হওয়ার পরে আমাদের পরের ধাপটা কি হবে সেটা এখানে জরুরী ভাবনার বিষয়। তো, পরের ধাপে গিয়ে আবার রিভার্স করে সেটেলড হয়ে যাওয়া আগের ধাপে ঢুকে যাওয়ার কোনও অর্থ হয় না। এই আশির চক্র থেকে বের হওয়া খুব জরুরী।

Jabal At Tariq

পঠিত : ৫৬৪ বার

মন্তব্য: ০