Alapon

ওয়াজ নসিহতে ইংরেজির প্রাধান্য...


বাংলাদেশের প্রচুর মানুষের কাছে নিজের ভাষা বাংলার চেয়েও ইংরেজির প্রতি দুর্বলতা একটু বেশীই। হীনমন্যতা কিংবা ভাল চাকুরী লাভের আশায় হউক; কিংবা ভাগ্য বিড়ম্বনার দরুন, প্রবাসে গিয়ে জীবিকা হাতড়ানোর মত মননশীলতা আমাদের মনে স্থায়ীভাবে গেড়ে বসার কারণেই হয়ত তিলে তিলে এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে! আমাদের দেশে ইংরেজি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। ছাত্ররা এই বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে আঙ্গুলে 'ভি' তুলে। তারপরও আমাদের দেশের বেশীর ভাগ উচ্চশিক্ষিত ছাত্ররা ইংরেজিতে কথা বলতে পারেনা। আরব দেশের শিশুরা ইংরেজি ব্যাকরণ কি জিনিষ, নামই জানে না! কিন্তু তারা শিশুকালেই অনর্গল প্রাঞ্জল ইংরেজি বলতে পারে। তারা ইংরেজি ভাল বুঝে, মনের ভাব প্রকাশ করে। এর সোজা সাপটা উত্তর অর্থ হল, আমাদের দেশে যেভাবে ইংরেজি গেলানো হয়, তা বাস্তব সম্মত ও যুগোপযোগী নয়। যার কারণে ছাত্ররা বুড়ো হলেও ব্যাকরণের পিছনে পড়ে পড়ে থাকে কিন্তু যথাস্থানে ইংরেজি প্রয়োগে ব্যাপক দুর্বলতা দেখায়। প্রবাসে বাংলাদেশীদের ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে চরম দুর্বলতা দেখা যায়। এক সময় এটা তারা কেটে উঠতে পারে কিন্তু চাকুরী জীবনের শুরুতে কিছুদিন তো হাস্য-পদ হতে হয়! এ ধরনের পরিবেশে যে একবার পড়েছে, তার পদবী যত বড়ই হউক না কেন, সেই একই স্থানে এই অফিসারের প্রথম দিন নিয়ে হাসাহাসির একটি হাস্যপদ চিত্র জীবিত থাকে। এতে করে তাদের হীনমন্যতায় ভোগতে হয়।

প্রশ্ন হল, হুজুরদের কাছে কেন হঠাৎ করে ইংরেজি এত প্রিয় হয়ে উঠল! রীতিমত টানা হ্যাঁচড়ার মত কারবার। তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছিনা। লাখো মানুষের মাঝে একমাত্র ওয়ায়েজিনকে মানুষ মধ্যমণি হিসেবে দেখতে থাকে। তার কথা, আচরণ, খুঁটি-নাটি লক্ষ্য করতে থাকে। তিনি মুখ ফসকে কি বলেছেন, জিহ্বার আছাড় খেয়ে কি ভুল উচ্চারণ করেছেন। প্রতিটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপও দর্শক স্রোতারা মুখস্থ করেন। সেদিন এক ওয়ায়েজিনকে ওয়াজের মধ্যখানে দীর্ঘক্ষণ ইংরেজি বলতে দেখলাম! বেশ কিছুক্ষণ শোনার পরে বুঝলাম, তিনি ইংরেজিতে ওয়াজ করছেন না বরং কোন বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। আবার মনে হল, উদ্ধৃতিতে এত নিম্নমানের শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ হয় কিভাবে! আবার মনে হল তিনি বানিয়ে বাক্য বলছেন! বলতেই পারেন, অনেক শায়খ কোরআন-হাদিস থেকে দু'এক লাইন বলে তিন ঘণ্টা ধরে তার স্বপক্ষে ব্যাখ্যা করেন। এসব ব্যাখ্যার বেশীর ভাগ স্থানে নিজে যেভাবে বুঝেছে সেই কথারই বিশ্লেষণ চলতে থাকে। যাক, এই শায়খের ইংরেজি বাক্যের উচ্চারণে দাড়ি, কমার বালাই ছিলনা! তার শারীরিক নিঃশ্বাস তাকে যেখানে থামাচ্ছে, সেটাই বাক্যের দাড়ি বলে ধরা যাচ্ছে। এই ওয়াজ শুনে মন্তব্য করব দূরের কথা, কেন জানি আমার কাছে শরম লেগে বসল। আর দেখতে পারি নি। এটা তো একজনের দৃষ্টান্ত। দিন দিন এটার প্রকোপ বাড়ছে। অমুসলিম শিক্ষিত ব্যক্তিরা যখন আবোল-তাবোল এসব কথা শুনবে, তখন তারা নির্ঘাত ভাববে, এদের ভুল ধরার জন্য এদেশে বুঝি শিক্ষিত-জ্ঞানী মানুষের এতই অভাব!

আজহারী সাহেব ওয়াজে ইংরেজি বাক্য প্রয়োগ করেন। তাঁর ইংরেজি সাবলীল, উচ্চারণ বিশুদ্ধ। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে তার চরম সমালোচনা করতে দেখলাম এই বলে যে, দর্শক-স্রোতা বাড়াতে তিনি ওয়াজ মাহফিলকে রঙ্গ মঞ্চ বানিয়েছেন! কেউ বলছেন, ওয়াজে এভাবে ইংরেজি বলা দাম্ভিকতার লক্ষণ। ওয়াজে উর্দু, ফার্সির উদ্ধৃতি আসতে পারলে ইংরেজি আসলে দোষ কোথায়? একজন চতুর বক্তার কাজ হল, সমাবেশের চাহিদা বুঝা। তাকে শুরুতেই বুঝে নিতে হয়, তার স্রোতা কারা? তাদের মান কেমন? গ্রামীণ জনপদের মানুষ? উপশহর কিংবা ভার্সিটি পড়ুয়া। তারপর ঠিক করতে হয় তার পরিকল্পনা ও উপস্থিতির মন মেজাজ অনুসারে বাক্যের গাঁথুনি ঠিক করা। একজন বাগ্মীর ব্যক্তির পরিচয় ঘটে এখানেই। অনেকের বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে, ইংরেজির প্রভাবেই আজহারির ওয়াজে মানুষের জমায়েত বাড়ছে। তাই নিজেরাও যে যতটুকু ইংরেজি জানে ততটুকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ময়দানে! তারা ভেবেও দেখছে না যে, তার এই ওয়াজ শুনে কতজন গিলছে, আর কতজন হাসছে। মূলত বক্তার ব্যক্তিত্ব, প্রচার ও বিষয়বস্তুর কারণেই জমায়েতের উপস্থিতির ধরণ পাল্টে যায়। তারপরও ওয়াজ নসিহত কে উপস্থিতি দিয়ে বিবেচনা করা উচিত নয়। বিবেচনা করতে হবে বক্তার বাগ্মিতা দিয়ে। সেটা কি? একজন বক্তার কথা শোনার জন্য যদি দশ জন মানুষ আসে এবং সেই তিনি যদি দশ জনের সবাইকে তার কথা বুঝাতে সক্ষম হয়, তাহলে তিনি সফল বক্তা। একশ জনে যদি এক'শ তে সফল হয় তাহলে তিনি চরম সফল। রাসুল (সা) তো মক্কার জীবনে এভাবেই সফলতা পেয়েছিলেন। একলক্ষ মানুষ হাজির হয়ে, সারারাত ওয়াজ শুনে, যদি দশ জন মানুষ নামাজী হয়, তাহলে এটি সফল মাহফিল হতে পারে না।

গ্রামীণ জীবনে আঞ্চলিক ভাষায় মাহফিল হবে এটা সঠিক। সেখানে উপস্থিতি কম হতে বাধ্য। এটার সাথে ওয়ায়েজীনের যোগ্যতার সাথে কোন সম্পর্ক নাই। তিনি তখনই অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন যদি তিনি মানুষকে আসল কথাগুলো বুঝাতে অক্ষম হন। স্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ ও দৃষ্টি নিবদ্ধে বিদেশী ভাষার উপমা কিংবা ব্যবহার তারা করতেই পারেন কিন্তু কখনও ভুল উচ্চারণে নয়। খ্যাতিমান প্রাজ্ঞ পণ্ডিতের লাখো মানুষের পিন-পতন জমায়েতে একটি অশুদ্ধ বাক্য ও ভুল উচ্চারণে সকল মানুষের মনোযোগ ও ধ্যানে বিভ্রাট ঘটবে। সে যায়গায় যদি হাসির উপাদান হাজির হয়, তাহলে সবই শেষ। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদের মুখে, বাংলায় বলা বক্তৃতা শোনার জন্য বহু উচ্চ শিক্ষিত মানুষ হাজির হয়। তাই বলে কি স্রোতারা কি সবাই বেকুব না মূর্খ? ব্যাপার একটাই, সেটা হল কথার মাধুর্যতা। কথার মাধুর্যতা না থাকলে যতই ইংরেজি জানা মানুষ হউক, যতই সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী হউক, যত বড় জ্ঞানী ব্যক্তি কিংবা বহু বইয়ের রচয়িতা হউক, এই গুনের অভাবে দর্শক-স্রোতা সাড়ি পুরা করতে বরাবরই ব্যর্থ হবে। টিভিতে কিংবা স্টেজে বক্তব্য দিয়ে বসে থাকা বেকার দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা হয়ত কিছুটা হাসিল হবে। কিন্তু ভয়ানক কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে, নিজের গ্যাঁটের টাকা খরচ করে, হাঁটুর জোড় কমিয়ে, হেঁটে এসে ময়দান ভরিয়ে তোলার মধ্যে বিস্তর তফাৎ আছে। তাই আসুন আগে নিজের ভাষায় দক্ষ হই, এই ভাষাতেই কারিশমা দেখাই। শুদ্ধ, সুন্দর ও প্রাঞ্জল শব্দের ব্যবহার করি। এতে করে কম কথার প্রয়োগ হলেও, ফুলের মালার মত প্রতিটি শব্দ মানুষের অন্তরে বিধে থাকবে। আরো যোগ্যতা থাকলে বিদেশী ভাষার প্রয়োগ ঘটাই। আমি কি কম জানি নাকি? এই ধরনের হঠকারিতায় আচ্ছন্ন হয়ে, ভুল-ভাঙ্গা উচ্চারণে ওয়াজ করলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তো বাড়বেই না; অধিকন্তু আগে যারা বক্তব্য শুনেছিল তারাও বলতে বাধ্য হবে, এতদিন এক বেকুব-ওজনহীন মানুষের কথা গিলে সময় নষ্ট করেছি।

Nazrul Islam Tipu

পঠিত : ৪৮৩ বার

মন্তব্য: ০