Alapon

কুদস ফোর্সের তিন দশক



ইরাকের মার্কিন হামলায় জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহতের পরপরই কুদ্‌স ফোর্সের নতুন প্রধান নিয়োগ দেন ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। প্রায় তিন দশক অভিজাত এই বাহিনীটির নেতৃত্বে ছিলেন সোলাইমানি। তার মৃত্যুর পর বাহিনীটির নেতৃত্ব দিতে তার ডেপুটিকে বেছে নিয়েছেন সুপ্রিম লিডার। কুদ্‌স ফোর্সের নতুন কমান্ডার হয়েছেন জেনারেল ইসমাইল গণি।

গণিকে নিয়োগদানের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে এক নতুন বার্তা পাঠিয়েছেন খামেনি। এক নির্দেশনায় তিনি বলেছেন, কুদ্‌স ফোর্সের কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক গতিতেই চলবে। শহীদ জেনারেল সোলাইমানি যেরকম পরিকল্পনা করেছিলেন সেভাবেই।

কিন্তু সোলাইমানির দেখানো পথে হাঁটতে যাওয়া গণি ও অন্যান্য কমান্ডাররা আদতে কারা? প্রয়াত প্রধানের ফেলে যাওয়া পথ অনুসরণের সামর্থ্য রয়েছে তাদের?
এসব প্রশ্নেরই উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে রেডিও ফ্রি ইউরোপের ইরানি শাখা রেডিও ফার্দার এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুসারে, কাগজ-কলমে কুদ্‌স ফোর্স হচ্ছে ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশন গার্ডস কর্পস (আইআরজিসি)’র একটি শাখা। বাহিনীটির অন্যান্য শাখা হচ্ছে নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, স্থল বাহিনী ও বাসিজ অর্গানাইজেশন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কুদ্‌স ফোর্সের প্রধানকে সুপ্রিম লিডার ছাড়া অন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সরাসরি সুপ্রিম লিডারের সঙ্গেই তাদের যোগাযোগ।

ইরানের বাইরে বিভিন্ন সামরিক অভিযান পরিচালনায় তারা সিদ্ধহস্ত। সামরিক গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অভিজ্ঞ দলটি। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন দেশে বহু দলের প্রতি তাদের সমর্থন রয়েছে। যেমন, লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজায় হামাস, ফিলিস্তিনে ইসলামী জিহাদ, পশ্চিম তীরে ইয়েমেনি হুতি এবং ইরাক, আফগানিস্তান ও বাহরাইনে শিয়া মিলিশিয়া। এসব দলের বেশির ভাগগুলোকেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকান দেশগুলোতেও প্রভাব ছড়িয়েছে কুদ্‌স ফোর্স।

দেশের বাইরে অভিযান পরিচালনার স্বার্থে ১৯৮৮ সালে একটি নির্দিষ্ট সামরিক ছত্রছায়ার অধীনে সক্রিয় দল স্থাপনের পরিকল্পনা করেন ইরানের নেতারা। সে সামরিক ছত্রছায়া হিসেবেই কুদ্‌স ফোর্সের জন্ম। দলটির প্রথম প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল আইআরজিসি’র এক কমান্ডার আহমাদ বাহিদিকে। পরবর্তীতে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী (২০০৯-২০১৩) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮৬ সালে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এক গোপন আলোচনায় আইআরজিসি’র একমাত্র সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে (১৯৮৮-১৯৯৭) কুদ্‌স ফোর্স আড়ালে থেকেই কাজ করে যায়।

সোলাইমানির উত্থান:
১৯৯৭ সালে বাহিদির স্থলাভিষিক্ত হন সোলাইমানি। তিনি দলটির নেতৃত্ব গ্রহণের পরপরই দলটি ইরানের বাইরে দ্রুত শাখা-প্রশাখা গজাতে শুরু করে। সুপ্রিম লিডারের সবচেয়ে প্রিয় কমান্ডারদের একজন ছিলেন তিনি। দ্রুতই ইরানজুড়ে বিশেষ খ্যাতি পান নতুন এই নেতা। তিনি কুদ্‌স ফোর্সকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে দেন। এক একটি বিভাগ এক একটি দেশে অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। প্রত্যেক বিভাগের জন্য নিয়োজিত ছিল নতুন একজন কমান্ডার। তারা প্রত্যেকেই সরাসরি তার কাছে জবাবদিহিতা করতো। এ ছাড়া, নতুন কমান্ডার দিয়ে আরো পাঁচটি নতুন শাখা খোলেন তিনি- গোয়েন্দা, অর্থনীতি, রাজনীতি, নাশকতা ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা। আলাদা হলেও বিভাগগুলো তার নেতৃত্বে গঠিত ‘কমান্ডারদের পরিষদ’-এর আওতায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল। কুদ্‌স ফোর্সের প্রধান হিসেবে বহু বছর গণমাধ্যম উপেক্ষা করে চলেছেন সোলাইমানি। তবে ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় ধীরে ধীরে আবির্ভাব হয় তার। সুপ্রিম লিডারের অনুমতি নিয়ে সে যুদ্ধে বাশার আল-আসাদ সরকারকে সহায়তা করেন তিনি।

নতুন কমান্ডার:
গত শুক্রবার মার্কিন হামলায় প্রাণ হারান সোলাইমানি। তার উত্তরসূরি নির্বাচিত হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল গণি (৬২)। গণির জন্ম ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও খোরাসান প্রদেশের রাজধানী মাশাদে। সেখানে আইআরজিসি আফগান শিয়াদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সোলাইমানির মতো তিনিও ইরান-ইরাক যুদ্ধে লড়েছেন। নাসর-৫ ও ইমাম রেজা-২১ ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গণি কুদ্‌স ফোর্সের শুরু থেকেই এর সদস্য ছিলেন। গত ২২ বছর দলটির অন্যতম গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও উপ-প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। তাকে বাহিনীটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সময় সুপ্রিম লিডার খামেনি বলেন, গণি আইআরজিসি কমান্ডারদের মধ্যে সবচেয়ে আলাদা একজন। ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় গণিকে ‘সেপশাল ডেজিগনেটেড ন্যাশনাল’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। লেবাননের হিজবুল্লাহ ও কুদ্‌স ফোর্স সমর্থিত অন্যান্য দলকে সহায়তার অভিযোগে এই তালিকাভুক্ত হন তিনি।

এদিকে, সোলাইমানির জায়গায় গণি বসলেও তার জায়গায় কে বসবেন তা বলা কঠিন। আজ পর্যন্ত কুদ্‌স ফোর্সের কমান্ডারদের পরিষদে কারা আছেন তা পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি। তবে গণির সম্ভাব্য একজন ডেপুটি হতে পারেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ সাবৌরি। বর্তমানে কুদ্‌স ফোর্সের উপ-সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কুদ্‌স ফোর্সের অপর এক পরিচিত কমান্ডার হচ্ছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইরাজ মাসজেদি। বর্তমানে বাগদাদে ইরানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত আছেন তিনি। ভবিষ্যতে গণির স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার।

পঠিত : ৬০৩ বার

মন্তব্য: ০