Alapon

ফতোয়া পরিবর্তন হয় কেন...?


যেকোন নতুন বিতর্কে- আরে হুজুররা এসব বলেই, দুদিন পর ঠ্যালায় পড়ে টিকতে না পারলে দেখবি আবার জায়েয বলে পিঠ বাঁচাচ্ছে- কথাটা খুবই কমন। তাই না?

সবসময় নতুন কিছুর বিরোধিতা করা আলেমদের বৈশিষ্ট্য এমন একটা ধারণা অনলাইনে খুব তীব্র।

রিসেন্ট উদাহরণ হচ্ছে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বিতর্ক।

যেকোন বিষয়ে ইসলামের দিকনির্দেশনা সামনে এলে সেটা যদি কারো মনঃপূত না হয় তবে প্রথম রিএ্যাকশন হচ্ছে উপরের ডায়ালগটা।

এক্ষেত্রে ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়। তন্মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি হচ্ছে টাই! পুরো তুলকালাম কাণ্ড।

মূল কথায় যাওয়ার আগে আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে- কোন কিছু অবৈধ বা হারাম বিবেচিত হওয়ার অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও সুগঠিত নীতিমালা রয়েছে ইসলামে। সেই সাথে একটি অবৈধ বিষয় কখন, কোন প্রেক্ষকাপটে, ঠিক কতটুকু অনুমোদিত হয় তারও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।

ইংরেজ শাসনের শুরুতে উপমহাদেশের প্রায় সব মুসলিম স্কলাররা টাই অবৈধ হিশেবে ঘোষণা করেছিলেন। কেন?

কারণ এটি ছিল বিজাতীয় নিদর্শন। ইসলামে বিজাতীয় নিদর্শন ধারণ করা সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু কথা হল বিজাতীয় নিদর্শন কোনটি? এমন কোন প্রতীক যা দেখলে প্রথম দেখায়ই তাকে ভিন্ন ধর্মের বলে অনুমিত হয়।

টাই এদেশের পোশাক ছিল না। ইংরেজরাই এটি এই অঞ্চলে আমদানি করেছে। তখন সিচুয়েশানটা আদতেই এমন ছিল যে টাই পরা কাউকে দেখলে প্রথম দর্শনেই ভাবা হত লোকটা ইংরেজ অথবা এদেশি খৃষ্টান।


কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই ধারাটা আর বাকি থাকে নি। দেশি-বিদেশি, খৃষ্টান-হিন্দু-বৈদ্ধ-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই টাই ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে যে পরিবর্তনটা হয় সেটা হচ্ছে- টাই পরিহিত দেখলেই ইংরেজ ভাবার সেই চলটা আর থাকেনি। আজকে আপনি আমি কাউকে টাই পরা দেখলে ভাবি না সে খৃষ্টান।

এখানে বিষয়টা লক্ষ্য করুন, টাই নিষিদ্ধ হওয়ার যে ভিত্তিটা ছিল- বিজাতীয় নিদর্শন- সেটা কিন্তু নেই। তো যে ভিত্তির উপর নিষেধাজ্ঞা দাঁড়িয়ে ছিল সেটাই যদি না থাকে, নিষেধাজ্ঞাও থাকবে না তা খুবই স্বাভাবিক। এজন্যই ফাতাওয়া চেইঞ্জ হয়েছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু আপনি সাদা চোখে দেখছেন, অহ! কুলোতে না পেরে এখন মেনে নিচ্ছে। আদতে তা নয়।

বিজাতীয় নিদর্শন বনাম বিধর্মী নিদর্শনঃ

এখানে অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন এবং ভেবে বসেন তাইলে তো সবকিছুই যখন ব্যাপকহারে প্রচলন শুরু হবে, সেটা বৈধ হয়ে যাবে। না, এমন অনেককিছুই রয়েছে যা পৃথিবীর সবাই এতে লিপ্ত হয়ে গেলেও সেটা হারাম হারামই থাকবে।

এই পার্থক্যগুলো না জানার কারণে গুগল স্কলাররা কত যে উদ্ভট গবেষণা আর অভিযোগের ঢালি নিয়ে হাজির হয়! সেদিন দেখলাম একজন খুব খেদ ঝাড়ছেন এই যে এত এত ইসলামি টিভি সিরিয়াল। যেগুলো দেখে নাকি তাদের অনেক ঈমান বৃদ্ধি পায়। গোটা বিশ্বের স্কলাররা প্রায় সবাই ই একে অবৈধ বলেছেন। তাই এই গুগল স্কলার বেজায় চটেছেন।

এখানে আমি শুধু একটি উদাহরণ দিব যেসব জিনিস কখনোই পরিবর্তন হবে না। আমাদের হাল ফ্যাশনের অনেক ছেলে মেয়েই ক্রুশযুক্ত লকেট ঝুলায় গলায়। ক্রুশ সরাসরি ভিন্ন ধর্মের নিদর্শন, শুধুমাত্র বিজাতীয় নয়। এই দুটোর মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ভিন্ন ধর্মের নিদর্শন ধারণ ইসলামে কক্ষনো বৈধ না।

সুতরাং বাংলাদেশের সতের কোটি মানুষের সবাই যদি গলায় ক্রুশের লকেট ঝুলায় তবুও দেখবেন স্কলাররা সেটা হারামই বলছে। আপনি কিন্তু সাদা চোখে দেখবেন, আরে! এসব মোল্লাদের প্রব্লেমটা কোথায়! টাই সেই কবেই মেনে নিল, আর ক্রুশে এত্ত চুলকানি কেন?

পার্থক্যটা আপনি গুগলের মহান স্কলার না জানলেও সেই মোল্লারা ঠিকই জানে এবং বুঝে।

দ্বিমত হয় কেন?

একেক হুজুর একেক কথা বলে। কারটা শুনব, আর এত্ত ঝগড়া কেন? এক কথা বলতে পারে না সবাই? আরেকটি কমন অভিযোগ। এক্ষেত্রেও আমি শুধু উদাহরণই দিব, ইন ডেপথ কিছু বলব না।

আমাদের আলোচ্য উদাহরণ টাই-য়ের কথাই ধরা যাক। এখনো অনেক স্কলার একে হারাম হিশেবেই বিবেচনা করেন। কেন?

এই ভিন্নতার সূত্র গ্রোথিত শুরুতে কেন টাই অবৈধ বলা হয়েছিল তার মধ্যে। এখানে একটি বিতর্ক রয়েছে যে টাই কি শুধু পশ্চিমা পোশাক নাকি খৃষ্টীয় পোশাক, অর্থাৎ এটা তাদের ধর্মীয় প্রতীক কিনা।

অনলাইনে সার্চ দিলেও আপনি টাইয়ের প্রচলন সম্পর্কে অনেক রকম মত পাবেন। তাছাড়া এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার একটা সংস্করণেও টাইকে ক্রুশের প্রতীক হিশেবে বলা হয়েছিল, পরবর্তী সংস্করণে বিষয়টা রিমুভ করে দেওয়া হয়।

এখন কথা হল তারা কেন এটা রিমুভ করল? প্রকৃত তথ্য গোপণ করার জন্য? নাকি তথ্যটা কর্তৃপক্ষের নিকট অথেনটিক ছিল না তাই? এখানেই সমস্যার গোড়া।

যারা ভাবেন টাই শুধু বিজাতীয় কালচার নয়, এটি তাদের ধর্মীয় প্রতীকও বটে যা ক্রুশের প্রতিনিধিত্ব করে, তারা একে হারাম হিশেবেই বিবেচনা করেন। কারণ ভিন্ন ধর্মের প্রতীক ইসলামে কক্ষনো অনুমোদিত নয়। পক্ষান্তরে যারা বিষয়টিকে শুধুমাত্র বিজাতীয় কালচার হিশেবে দেখেন যা এখন তার পূর্বের নির্দিষ্ট গণ্ডি ছেড়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার ব্যবহার্য হয়ে উঠেছে, তারা একে বৈধ হিশেবে দেখেন। কারণ যে ভিত্তিতে অবৈধ বলা হয়েছিল তা আর নেই এখন।

কিছু শাস্ত্রীয় কথা:

এতক্ষণ যা বললাম তা শুধুমাত্র উদাহরণেই সীমাবদ্ধ ছিল। মূলত এই বিষয়গুলো উসুলুল ফিকহ এবং উসুলুল ইফতার অত্যন্ত্য উঁচুস্তরের আলোচ্য বিষয়। সচরাচর সাধারণ আলেমরাও এগুলো নিয়ে কথা বলেন না।

শুধুমাত্র ইসলাম বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী গোটা বিশ্বে হাতেগোনা কিছু স্কলারই এসব নিয়ে গবেষণা করেন, অন্যরা তাদের অনুসরণ করেন। কারণ বিষয়গুলোর স্পর্শকাতরতা নিয়ে তারা সম্যক অবগত।

আমাদের গুগল স্কলারদের মত আধাঘন্টা সার্চ দিলা্ম‌ আর দু চারটা স্ট্যাটাস মেরে, গোটা দেড় হাজার বছরের ধারাবাহিক ডেডিকেটেড স্কলারদের সব গবেষণাকে শাপশাপান্ত করে ধর্ম উদ্ধার করে ফেললাম- এমন নয়।

হাজাহ, যরুরাহ, সাদ্দু বাবিয যারায়ে’ এগুলোর ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় একটা হারাম বিষয় কখন হালাল হবে। অথবা একটা হালাল বিষয়ই কখন হারাম হিশেবে বিবেচিত হবে।

এর প্রত্যেকটা উসুলুল ফিকহের কিতাবগুলোর শত শত পৃষ্ঠার চ্যাপ্টার। আমি এখানে অতি সাধারণ দুয়েকটা উদাহরণ দিলাম শুধু। এগুলো পড়েই কেউ আবার ভেবে বসবেন না যে অ! এই তাহলে বিষয়!! বুঝে গেলুম।

কোথায় পেলো এসব নীতিমালাঃ

এতক্ষণ পরে এসে আপনার মাথায় নিশ্চয়ই উদয় হচ্ছে এসব ছাঁইপাশ মূলনীতি আর নীতিমালা তারা নিজেদের সুবিধামত বানিয়ে নেয়। যাতে তাদের স্বার্থরক্ষা হবে তাই মূলনীতি।

সত্য বলতে আমি নিজেও একাধিক মানুষের কাছ থেকে এই কথাটা শুনেছি। তারা যখন কথা বলে সুবিধা করতে পারেন না, তখন এটা হয় শেষ অস্ত্র। ভিন্ন কথায় তারা নিজেদের অজ্ঞতাটা মেনে নিতে একদমই পারেন না। বলতে পারেন না যে আসলেই আমি এ বিষয়ে পড়াশোনা করি নি, তাই বিষয়টা জানি না।

বরং তারা এক অজ্ঞতা ঢাকতে গিয়ে আরো বড় শঠতার আশ্রয় নেন। “যা তোমাদের জন্য হারম তা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে, তবে যার প্রতি তোমরা নিরূপায় হও”। সূরা আনআম, ১১৯। সুরা বাকারার ১৭৩ নম্বর আয়াতে এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

একটা কথা অনেকেই শুনে থাকবেন যে বিপদে পড়লে শুকরও হালাল। হ্যাঁ, এটা খোদ কোরআনুল কারিমের কথা। কিন্তু কতটুকু হলে সেটা বিপদ কিংবা নিরূপায় হিশেবে ধর্তব্য, সে অবস্থায় কতটুকু খাওয়া যাবে, পেট পুরে নাকি জান বাঁচানো পরিমাণ, এই সবকিছুই কোরআন, হাদিস, সালাফে সালেহিনের কর্ম ও গবেষণা থেকে উৎসারিত।

কেউ নিজের মন মতো নীতিমালা বানিয়ে নিচ্ছে না নিজের সুবিধার জন্য। এগুলো বুঝার জন্য আপনাকে যা করতে হবে সেটা হচ্ছে পড়াশোনা। আর অবশ্যই সেটা গুগলে নয়। প্যাশোনেট হয়ে, ডেডিকেটেড হয়ে।

একটা প্রশ্ন দিয়ে শেষ করি। ইংরেজ শাসনামলের প্রারম্ভে উপমহাদেশের আলেমরা ইংরেজি শিখতে বারণ করেছিলেন। অবশ্য তাদের দেড়শ বছর পর ১৯০৫ এ স্বদেশীরাও একই ট্যাকটিক নিয়েছিল।

কিন্তু এখন মাদরাসাগুলোতেই প্রথমিক ইংরেজি শেখানো হয়। এককালের নিষিদ্ধ বিষয়টা আজকে কেন নিজেরাই শিখছেন, শেখাচ্ছেন? খুবই পরিচিত একটা অভিযোগ। উত্তরটা খুঁজে পেতে চেষ্টা করুন।

আল্লাহ আমদেরকে বুঝার তৌফিক দান করুন।

.......
রাকিবুল হাসান

পঠিত : ৬৮৮ বার

মন্তব্য: ০