Alapon

ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ভিড়ে ক্ল্যাসিক্যাল ক্রিকেট আজ মৃত্যুর মুখে...


ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। দাদু-দাদী পছন্দ করতেন না, তাই আব্বা তখন পর্যন্ত টেলিভিশন কিনেননি। তবে আমার বড় ভাই আর আমি ছিলাম ক্রিকেটের ভক্ত! বিশেষ করে পাকিস্তানের ভক্ত।

পাকিস্তানের খেলা হলেই আমাদের দু ভাইকে আর বাড়িতে পাওয়া যেত না। আমরা চলে যেতাম ইয়াং সোসাইটি ক্লাবে। মিঠাপুকুর বাজারের এক কোনায় এই সোসাইসিটি ছিল। মনে হতো যেন, বিশেষত ইয়াং সোসাইটির জন্যই সেই ঘরটি বানানো হয়েছিল। সেই ইয়াং সোসাইটির এখন আর অস্তিত্ব নেই।

আমার এখনো মনে আছে, শোয়েব আকতার যখন প্রথম ওভারের প্রথম বল করার জন্য দৌড় শুরু করত, আর তার চুলগুলো বাতাসে উড়তো, তখন মনে হতো আমার মনটাও যেন উড়ছে। শোয়েব আকতারের দৌড়ানো আর বোলিং অ্যাকশনটা ছিল আমার ভীষণ প্রিয়। আর উইকেট পাওয়ার পর যখন সে দুই হাত প্রসারিত করে ঈগল হওয়ার চেষ্টা করতো, তখন মনে হতো আমিও ওভাবে দৌড়াই!

খুব সম্ভবত তখন সারজাহ কাপ চলছিল। সারজাহ কাপের ফাইনাল খেলা চলছে। রাত বাজে ১১ টা। আব্বা বাড়িতে ফিরে দেখেন তার বড় ছেলে ঘরে নেই। আব্বা খেলা না দেখলেও পত্রিকার মাধ্যমে খোঁজ-খবর কিছুটা রাখতেন। আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, ‘বড়জন কই?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘খেলা দেখতেছে মনে হয়!’
আব্বা মুখ গম্ভীর করে বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে। যাও ওকে বাড়িতে নিয়ে আসো।’

আব্বার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নাচতে নাচতে ইয়াং সোসাইটির মুখে দৌড় শুরু করলাম। গিয়েই ভাইয়াকে পেয়ে গেলাম। তার দিকে চোখ দুইটা বড় বড় করে, মুখে ভয়ের প্রতিচ্ছবি নিয়ে বললাম, ‘বাড়ি চলো। আজকে আব্বা তোমার খবর করবে! আজ তোমার একদিন কি আব্বারই একদিন!’

সে আমার চেয়ে অধিক চালাক। মিষ্টি সুরে বলল, ‘ভাইয়া, রাত তো আসলেই অনেক হয়ে গেছে। এখনো বাড়ি গেলে আব্বা রাগ হবে। একঘণ্টা পরে গেলেও রাগ হবে। আসো, দু-জনে ফাইনাল খেলাটা দেখে বাড়ি যাই। ঝাড়ি যখন খেতেই হবে তখন খেলাটা শেষ করেই ঝাড়ি খাই। আর তাছাড়া তোমার পাকিস্তানের খেলা। এই একটু পরে শোয়েব আকতার বল করবে। দেখবা না?’

শোয়েব আকতারের বোলিং দেখার জন্য থেকে গেলাম। তারপর খেলা শেষ করে দু-ভাই ঘাড় ধরাধরি করে রাত দুইটায় বাড়ি ফিরলাম।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমরা জল্পনা করছিলাম, আজ আব্বা আমাদের কী শাস্তি দিতে পারে! বড় ভাইয়া বলল, ‘আজকে তো মনে হয় আমার বিশেষ খবর আছে।’ আমি বললাম, ‘আমার আরও বিশেষ খবর আছে। তোমাকে ডাকতে গিয়ে আমিও খেলায় মজে গেছি। আমার অপরাধ বিরাট। আজ কেয়ামত ঘটে যাবে।’

বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে দেখি বন্ধ! অতঃপর দেয়াল টপকে বাড়িতে ঢুকে পা টিপে টিপে যখন ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন অন্ধকার থেকে আব্বার গলা ভেসে এলো- ‘এইগুলা তোমাদের কাজ! ঘরে খাবার দেওয়া আছে, খেয়ে ঘুমাও।’

এমন করে কত যে ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছি তার কোনো ইয়াত্তা নেই। অথচ এখন আর ক্রিকেট খেলা দেখতেই ইচ্ছে করে না। বিপিএল হচ্ছে অথচ একটা ম্যাচও দেখিনি। চাইলেই ষ্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখতে পারতাম। কিন্তু ভুল করেও মনে হয়নি, যাই একবার!

অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। আগে ক্রিকেট দলগুলোর মধ্যে ত্রি-দেশীয় ক্রিকেট সিরিজ হতো। এখন আর হয় না। আগে পাকিস্তান ভারতের নিয়মিত সিরিজ হতো, এখন আর হয় না। এখন সবাই আইপিএল, পিসিএল, সিপিএল, বিপিএল আর বিগব্যাশে ব্যস্ত। এই লীগগুলো ক্রিকেটের সৌন্দর্য বর্ধন করেছে কিনা জানি না, তবে এগুলো ক্ল্যাসিক্যাল ক্রিকেটকে হত্যা করেছে। ক্রিকেটের আসল সৌন্দর্যই নষ্ট করে ফেলেছে!

আহা! সেই রোমাঞ্চকর ক্রিকেট যদি আবারো ফিরে পেতাম।

পঠিত : ৬৭০ বার

মন্তব্য: ০