Alapon

বিয়ে কোন সমস্যা না, সমস্যাটা হল বিয়ের স্থান-কাল ও পাত্র।


গুলবাহারকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল মূলত সামাজিক চাপ সামলাতে। ক্লাস সেভেনে না উঠতেই আসতে থাকা পাত্রের ঢল দুবছর ধরে সামলানোর পর শেষে অধৈর্য হয়েই মৌলভী মাহবুব খান মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ যেন তাড়াহুড়ো করে কোন পচনশীল মাল নিলামে ওঠানো, ভাল দরদাতাই যার উপযুক্ত হকদার। দ্রুততম নিলাম এখানে শ্রেষ্ঠতম নিলাম।

দু চার গ্রামে সৌন্দর্যের খ্যাতির কারনে অনেক পাত্রই এসেছিল মেয়েটির পাণিপ্রার্থী হতে, যোগ্যতা অনেকের থাকলেও প্রয়োজনীয় লবিং সবার ছিল না। যেকোন বিয়েতে দুলাভাই এবং খালু/ফুফা শ্রেণীর মুরুব্বিদের লবিং হচ্ছে সবচেয়ে জোরদার লবিং, আর আবুল হাসানের সেটাই ছিল। গুলবাহারের এক খালু ছিলেন আবুল হাসানের কলেজের শিক্ষক, ঘটকালিটা তিনিই সারলেন। তার ঘটকালির দক্ষতা যে আজকালকার কোন শীর্ষ কূটনীতিকের চেয়ে কম ছিল না তা বোঝা গেল যখন ছেলে এবং মেয়ের বয়সের তফাত ছাব্বিশ বছর এবং ছেলের পক্ষ থেকে অসম্মতির পরেও বিয়েটা হয়ে গেল। এক্ষেত্রে ঘটক সাহেবের প্রধান যুক্তি ছিল, আল্লাহর রাসুল(সা) এর যুগে এমন বয়সের ব্যবধানে অনেক বিয়ে হয়েছে, সেগুলোতে তো কোন সমস্যা হয় নি!! ছেলে কোটিপতি, স্বভাব চরিত্রও ভাল, ভাল পরিবার, শুধু বয়স একটু বেশি। পুরুষ মানুষের বয়স একটু বেশি হলে কিইবা হয়??

মৌলভী মাহবুব খান ধর্ম বলতে অজ্ঞান। আল্লাহর রাসুলের(সা) নাম করে তার কাছ থেকে যেকোন কাজ আদায় করে নেয়া যায়। নবীর(সা) যুগের উদাহরনের চেয়ে বড় উদাহরন তার কাছে আর হতে পারে না। ফলে প্রথমে গররাজি হবার পরেও পরে তিনি রাজি হয়ে গেলেন।

আর এটাই তো স্বাভাবিক!! এদেশে প্রতিষ্ঠিত ছেলে মানেই পয়ত্রিশ পেরোনো ছেলে, এদের সাথে পনেরো ষোল বছরের মেয়ের বিয়ে তো নতুন কিছু না।
সওদাটা যখন সম্পদের সাথে সৌন্দর্যের, তখন এটাই হয়ে ওঠে অমোঘ বাস্তবতা।।

বিয়ের কয়েকদিন না যেতেই গুলবাহার অনুভব করলো, এই বাড়িতে তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু হচ্ছে আবুল হাসানের ভাগ্নীরা। এদের সাথে খেলতে আর আড্ডা দিতে তার খুবই ভাল লাগে। বিশেষভাবে, রাতের বেলা চুপিচুপি বরইগাছ থেকে বরই পাড়ার আনন্দের তার কাছে কোন তুলনাই ছিল না। এটা সেই জীবন, যা সে বিক্রমপুরে নিজের গ্রামে ফেলে এসেছে।
সময় গড়াবার সাথে সাথে গুলবাহারও একটু একটু করে মানাতে শুরু করেছিল তার নতুন সংসারে। স্বচ্ছল পরিবারে তাকে বেশি কাজ করতে হত না, কাজের লোক ছিল। তার সাথে দেখা করতে প্রায়ই আসতো ননদদের মেয়েরা, সমবয়সী হওয়ায় আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি।
আবুল হাসান অত্যন্ত সুহৃদ মানুষ, সুন্দর একটা পুতুলের মত বৌটাকে শোকেসে সাজিয়ে রেখেই জীবনটা পার করে দেবে বলে সে ভেবে রেখেছিল। যৌনতা নিয়ে তার তেমন আগ্রহ ছিল না, এত ছোট একটা মেয়ের কাছে সেটা নিয়ে আবদার করাও তার লাজুক ব্যক্তিত্বের সাথে খাপ খায় না। ওসবের চেয়ে বরঞ্চ সাইফুল্লাদের বাড়ির ছাদে ক্যারম খেলা আর তাস পেটানোতেই সে আগ্রহী ছিল। তবে আগেকার চেয়ে এখন সে আগেভাগেই বাড়ি ফিরতো। এই মেয়েটা এতই সুন্দর যে একে দেখলেও মনটা ভাল লাগে।

শীতের মাঝামাঝিতে এক রাতে ঘুমোবার সময় অচেতন গুলবাহারের হাত পড়লো আবুল হাসানের গায়ের ওপর। আবুল হাসানের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
অধরা নববধুর অবিন্যস্ত পোশাকের ফাকে ফাকে বেরিয়ে আসা শুভ্র শরীর তার ভেতরের পুরুষকে সেরাতে জাগিয়ে তুললো। গুলবাহার প্রথমে বাধা দিতে চাইলেও তাতে খুব একটা লাভ হল না। পুরো ব্যাপারটার স্থায়ীত্ব ছিল খুবই কম, গুলবাহার ঠিকঠাক সামলে নেয়ার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। চরম সুখ নিয়ে আবার ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো আবুল হাসান, তার চল্লিশ বছরের কুমার জীবনের অবসান ঘটলো।

পরদিন গুলবাহার নিজে নিজেই সকালে গোসলটা সেরে ফেললো।

এরপরের কয়েক সপ্তাহে প্রতিরাতেই আবুল হাসান নিজের সেরাটা স্ত্রীকে দিতে চেষ্টা করলো, কিন্তু নিজের প্রতি দীর্ঘ অযত্ন তাকে শেষ করে ফেলেছিল। কোন প্রচেষ্টাই তাকে বিছানার পিচে পুরো দুটো মিনিট টিকিয়ে রাখতে পারে নি।

স্ত্রীর সামনে আরো লজ্জিত হয়ে পড়া ছাড়া আবুল হাসানের এই এডভেঞ্চার বাড়তি কোন ফল বয়ে আনলো না, আর গুলবাহারের জন্য এটা নিয়ে এল একরাশ বিরক্তি।

এমনিতেই এই বাচ্চা মেয়ের সাথে আলাপের কোন বিষয়বস্তু খুজে না পাওয়া আবুল হাসান এবার নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে রীতিমত পালিয়ে বেড়াতে লাগলো। লজ্জায় সে কাউকে নিজের দুর্বলতার কথাও বলতে পারলো না, পুরুষালী ইগোর কারনে গেল না ডাক্তারের কাছেও।

এদিকে গুলবাহারকে কড়া নজরে রাখতে ননদরাও নুরুন্নাহার বেগমের কাছ থেকে বিশেষ নির্দেশনা পেল। আবুল হাসান যেন বউয়ের কব্জায় চলে না যায় সেজন্য গুলবাহারকে সকাল-সন্ধ্যা ননদেরা ঘিরে রাখতো। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একান্তে কথা হওয়া ছিল অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ। প্রায় সারাদিনই তাদের ভেতর দেখা হত না।
বরঞ্চ, গুলবাহারের সাথে বেশি দেখা হত তার দেবর বাশার ও নন্দাই মামুন মিয়ার। বাশারও তার চেয়ে কম করে হলেও পনেরো বছরের বড়, যথারীতি নুরুন্নাহার বেগম মনে করতেন, তার এই ছেলেরও বিয়ের বয়স হয় নি।

বাড়ির মেয়েদের পর্দার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিল গুলবাহারের পরিবার। দিল্লী থেকে বিহার হয়ে সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করা এই পরিবারটার আগের প্রজন্ম ছিলেন রাজনৈতিক ইসলামের প্রবক্তা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর মাধ্যমে সরাসরি প্রভাবিত। মৌলভী মাহবুব খান নিজেই বহু দরস নিয়েছেন মাওলানা আব্দুর রহীম, আব্বাস আলী খান, একেএম নাজির আহমেদদের সাথে, তাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ছিল কঠোর ইসলামী চর্চা। গুলবাহারের বড় ভাই বিয়ের আগ তক বোনকে কঠোরভাবে দেখে রেখেছেন, মেয়ের বেড়ে ওঠার দিকে সালমা খানমের নজরও ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। মুফতী কাজী ইবরাহীমের ভক্ত এই পরিবারটির মেয়েদের জন্য ১২ বছর বয়সের পর থেকে পরপুরুষকে চেহারা দেখানো ছিল আদবের পরিপন্থী। ছেলেদের ক্ষেত্রেও কঠিনভাবে মানা হত পর্দার বিধান, তাই কখনো গ্রামের কোন মেয়েদের বিরক্ত করার নালিশ এই পরিবারের ছেলেদের ব্যাপারে আসে নি।

কিন্তু গুলবাহারকে যে পরিবারটায় বিয়ে দেয়া হল, পর্দা তাদের কাছে ছিল স্রেফ কিছু ধর্মীয় আইন, যা মানা না মানা অনেকটাই নির্ভর করে ইচ্ছার ওপরে, কেননা এগুলো না মানলে খোদা এসে কাউকে চাবুক মেরেছেন বলে কখনো কেউ দেখেনি। এই পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের সামাজিক প্রথাগুলো, যেগুলো তারা এতদিন ধরে অনুসরন করে এসেছে।
আবুল হাসানের বড় ভাই তাদের সাথে থাকতো না, তবে চাচাতো ভাইয়েরা থাকতো তাদের পাশের বাড়িতেই। আবুল হাসানের বাড়িতে চাচাতো ভাবীদের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। এই পরিবারগুলোর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীদের ভেতর বয়সের তফাত ছিল উল্লেখযোগ্য, একেবারে কম করে হলেও দশ বছর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পনেরো থেকে বিশ বছর। স্বাভাবিকভাবেই, স্বামীর সাথে স্ত্রীর মানসিক দুরত্ব থাকতো। সেই দুরত্বকে আরো বাড়াতো ননদ ও শ্বাশুড়িরা, যাতে ছেলে তাদের হাত থেকে ছুটে না যায়। এমনকি, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কেও হস্তক্ষেপ করতে এই পরিবারের শ্বাশুড়ি-ননদদের বাধতো না। প্রায়শই দেখা যেত রাত দশটার পর ছেলের বউকে শ্বাশুড়ির ঘরে ডেকে রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত বিভিন্ন কথায় আটকে রেখে তারপর ছাড়া হত। ননদরা আসলে তাদের সাথে গল্প করতে হত রাতভর।

নুরুন্নাহার বেগম বা তার জা'রা স্বামীসঙ্গ উপভোগ করেছেন খুবই কম। স্বামী তাদের কাছে ছিলেন মৃত্যুদূতের মত, যার আদেশের কোন অন্যথা কখনো তারা করার সাহস করে ওঠেন নি। দাম্পত্য সম্পর্ক তাদের কাছে ছিল ততটাই, যতটা তাদের স্বামী চেয়েছেন। পারিবারিকভাবে মেয়েদের জগতটা ছিল ছেলেদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। শ্বাশুড়ী-দাদী স্বাশুড়ী-চাচী শ্বাশুড়ী-ঝি-বউদের ছিল একটা নিজস্ব সমাজ।
এই সামগ্রিক পুরুষশুন্যতা স্বাভাবিক নয়। প্রকৃতিতে কোন প্রজাতির ভেতরেই নারী ও পুরুষ বিচ্ছিন্নভাবে থাকে না, কারন তারা পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। মানুষ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আরো বেশি নির্ভরশীল, তাই এই সর্বাত্মক বিচ্ছিন্নতা এক প্রকার অস্বাভাবিকতা।

সুন্দরী নারী আর শক্তিমান পুরুষের কখনো শত্রুর অভাব হয় না, গুলবাহারেরও হল না। শ্বশুরবাড়িতে আসার কিছুদিনের মধ্যেই সে বিবাহিত জীবনের প্রথম চ্যালেঞ্জের ভেতর পড়লো।
গুলবাহার সকালে রোদ পোহাচ্ছিল ছাদের ওপর গিয়ে। শাল খুলে নিজের হাটু পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো রোদে মেলে দিয়ে সে হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল ফাল্গুনের হাওয়ায়, এমন সময় ছাদের দরজা দিয়ে তার বড় ননদ বড় ননদ ও তার স্বামী প্রবেশ করলো। সোনালি রোদের ঝলকানিতে ঝিকিয়ে ওঠা উড়ন্ত কুচকুচে কালো চুলের ভেতর প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটা ছিপছিপে দুধে গোলাপমাখা অবয়ব মামুন মিয়ার নজর এড়ালো না। মামুন মিয়ার নজর কোনদিকে গেছে সেটা আবার নজর এডালো না তার স্ত্রী জামিলার। ঠান্ডা লড়াইয়ের শুরুটা এখান থেকেই।

পরদিন থেকে শ্বশুরবাড়িতে মামুন মিয়ার যাতায়াত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেল। প্রায় সারাদিনই সে শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকতো, কখনো নুরুন্নাহার বেগম, কখনো গুলবাহার, কখনো আবার শালী নাসিমার পেছনে। সুন্দরী শালী বাঙ্গাল পুরুষদের অনেকেরই টপ প্রায়োরিটি, এতদিন নাসিমাও মামুন মিয়ার কাছে তাই ছিল, সেটা নিয়ে জামিলারও খুব একটা আপত্তি ছিল না। কিন্তু ফোকাসটা যখন নাসিমা থেকে গুলবাহারে সরে এল, জামিলার খুতখুতে মন তাকে সম্ভাব্য বিপদসংকেত সম্পর্কে সজাগ করে দিলো। এখান থেকেই স্বামীর সাথে তার বিবাদ শুরু। এই বিবাদের গোড়া কোথায়, তা এমনকি মামুন মিয়া নিজেও জানলো না।

স্বামীকে ট্র‍্যাক করতে স্বামীর লেজে লেজে জামিলাও শুরু করলো ঘন ঘন বাপের বাড়ি আসা।

প্রজনন একই প্রজাতির সমলিঙ্গের প্রাণীদের ভেতর যে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা তৈরি করে, জামিলা এর বাইরে ছিল না। জামিলা গুলবাহারকে নিজের প্রতিদ্বন্দী মনে করতে শুরু করলো, যদিও এই বাড়ন্ত কিশোরীর এসব প্রতিদ্বন্দিতা সম্পর্কে তেমন কোন ধারনাই ছিল না।

জামিলার এই প্রতিদ্বন্দিতা এক সর্বাত্মক রুপ ধারন করতে বেশি সময় লাগে নি। ক্রমেই জামিলা রান্নাবান্না, ঘরদোর গোছানো, কাপড় সেলাই আর নুরুন্নাহার বেগমের সেবায় কিভাবে গুলবাহারকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায় সেই প্রচেষ্টায় মনপ্রাণ দিয়ে নামলো।
এতে তিনটা সমস্যার সৃষ্টি হল।
প্রথম সমস্যা ছিল, সে মামুন মিয়াকে আগের মত সময় দিতে পারতো না, ফলে মামুন মিয়ার উডুউড়ু মন আরো বেশি গুলবাহারের দিকে ঝুকতে লাগলো।
দ্বিতীয় সমস্যা, নিজের মেয়েদের দেখে রাখতে যে সময়টা দেয়ার প্রয়োজন ছিল, তা জামিলা দিতে পারছিল না। বড় মেয়েটা এসএসসিতে খারাপ করে বসলো।
তৃতীয় সমস্যাটা ছিল আসলে মামুন মিয়ার। পেছন পেছন বউকে শ্বশুরবাড়িতে আসতে দেখাটা তার মেজাজ বিগড়ে দিতো, কিন্তু এব্যাপারে তার আসলেই কিছু করার ছিল না। রাগ সামলাতে না পেরে সে ভেতরে ভেতরে একা একাই ফুসতো।

মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা খারাপ হবার দায়টা স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে মামুন মিয়া একদফা ঝাল ঝাড়লো ঠিকই, কিন্তু এই ঝালটা গুলবাহারের ওপর ঝেড়ে দিতে জামিলা খুব বেশি সময় নিল না।

বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রান্নায় দেরি হওয়া নিয়ে সবার সামনে গুলবাহারকে একদফা অপমান করতে জামিলার কোন ভুল হয় নি।

সময়ের সাথে সাথে নাসিমাও খেয়াল করলো, প্রাণপ্রিয় দুলাভাইয়ের কাছে তার গুরুত্ব কমে গেছে, এবং এর ফলে বাড়িতে জামিলার পক্ষের সদস্য আরো একজন বাড়লো। গুলবাহারের এসব নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। ননদদের কথা সে খুব একটা গায়ে মাখতো না। তার প্রধান সমস্যা ছিল নিজের পাশে কথা বলার একটা মানুষের অভাব।

আবুল হাসান তার আগের জগতেই বাস করছিল। স্ত্রীকে সময় দেয়ার ব্যাপারে তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। নুরুন্নাহার ছিলেন মেঝ ছেলের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিন্ত, আর যাই হোক, এই ছেলেটা অন্তত বড় ছেলের মত বউয়ের গোলাম হয় নি। বড় মেয়ে-জামাইয়ের বাপের বাড়িতে আসার পরিমান বেড়ে যাওয়া তার মনে তেমন কোন ভাবান্তর না ঘটালেও দুই মেয়ের মধ্যে ক্রমেই গুলবাহারের প্রতি বিদ্বেষ বেড়ে যাওয়ায় তিনি চিন্তিত হলেন।
তিনি কি তবে ছেলের বউয়ের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন??

মানুষ "আমরা ও তোমরা" নামের এক স্বনির্মিত দেয়ালের ভেতর নিজেকে আটকে রাখে। "আমরা ও তারা"র বাইরে কোন পরিচয় মানুষের কাছে স্বাভাবিক নয়। প্রত্যেক মানুষ তার নিজের মত করে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে। গুলবাহারকে ঘিরে আবুল হাসানের মা ও বোনেরাও তাদের "অপর" (the Other) নির্মান করলো।

সেবছর বর্ষা আসার আগেই গুলবাহার অনুভব করলো, এই পরিবারে সে আর থাকতে পারছে না। আবুল হাসানের কাছে সে বাপের বাড়ি যাবার জন্য কড়া বায়না ধরলো।

আবুল হাসান ঝামেলা পছন্দ করা লোক না। পরের সপ্তাহে গুলবাহারকে এক মাসের জন্য বাপের বাড়ি পাঠানো হল।
আবুল হাসান চলে আসার পরদিনই গুলবাহারদের বাড়িতে চলে এল তার খালাতো বোনরা।

সেদিন রাতে ওরা কাউকে না বলে চুপিচুপি পুকুরে মাছ ধরতে নামলো।

লুডু খেলা আর কিশোরী বয়সের মুহুর্মুহু অকারন হাসির বন্যায় কেটে গেল বেশ কিছুদিন। শ্বশুরবাড়ি ফেরার আগে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদলো গুলবাহার।

সে এমন এক বাড়িতে যাচ্ছে যেখানে তার কোন মা নেই।

Muhammad Sajal

পঠিত : ৮৩০ বার

মন্তব্য: ০