Alapon

মিজানুর রহমান আজহারীকে কাফের ঘোষণা দেওয়া প্রসঙ্গে কিছু কথা...


অন্তরঙ্গ বন্ধু হলেও মিজানুর রহমান আযহারীর কোন ভুল বা কুফুরির বাক্যকে যেন আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদেরকে দিয়ে সমর্থন না করান। আল্লাহ্‌ তায়ালা উনাকে এবং আমাদের সবাইকে গুণাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখুন এবং হয়ে যাওয়া গুণাহগুলো ক্ষমা করুন। আমি যেমন আমার বন্ধুর নামটা দিয়ে এখানে শুরু করেছি, এই নামটার জায়গায় আপনার শায়খ বা বন্ধুর নামটা দিয়ে দয়া করে প্রথম দুইটা লাইন আরো একবার পড়ুন! উদাহরণ স্বরুপ, এভাবে… ড এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী সাহেবের কোন ভুল বা কুফুরির বাক্যকে যেন আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদেরকে দিয়ে সমর্থন না করান। আল্লাহ্‌ তায়ালা উনাকে এবং আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন।

আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রঃ) কাজী আয়্যায (রঃ) -এর “আশ-শিফা বি তা’রিফি হুকুকিল মোস্তাফা” গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেছেন, যদি ৯৯ টা কারণ পাওয়া যায় কাউকে কাফের ফতোয়া দেয়ার জন্য, পক্ষান্তরে একটা কারণ পাওয়া যায় তাকে ইসলামে অবশিষ্ট রাখার জন্য, তাহলে মুফতি এবং কাজিগণের জন্য সেই একটি কারণকে কেন্দ্র করে তাকে মুসলিম ফতোয়া দেয়া কর্তব্য হবে। (শরহে আল-শিফা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং ৪৯৯) কেউ কেউ বলেছেন, সে একটি কারণ হল, কেউ তাকে কাফের বলুক এটা সে অপছন্দ করে এবং সে স্বাচ্ছন্দে পরিচয় দেয় এই বলে যে আমি মুসলমান।

যদি কোন মুফতি এবং কাজি কাউকে কাফের বলে, আর যাকে কাফের বলা হবে সে যদি বাস্তবে কাফের সাব্যস্ত না হয়, তাহলে ফতোয়াদানকারীর উপর তার ফতোয়া ফিরে আসবে। এ ব্যাপারে সহীহ বুখারীতে হাদীস এসেছে, আবদুল্লাহ্ ইব্নু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, যদি কেউ নিজের কোন ভাইকে কাফের বলে, তবে এতদুভয়ের মধ্যে একজন (নিশ্চয়ই) কাফের হল। (বুখারী ৬১০৪, মুসলিম ৬০)
অর্থাৎ কাউকেও কাফের বলে ফতোয়া দিলে ইহা আর ব্যর্থ বা অনর্থ হয় না। সুতরাং যাকে কাফের বলা হয়েছে সে যদি প্রকৃতপক্ষে কাফের হয়, তবে ফতোয়া ঠিক। অন্যথায় কাফের বলে যে ফতোয়া দিয়েছে ফতোয়া তার দিকে ফিরে আসবে। অতএব, কাফের হওয়ার ফতোয়া দেয়ার বেলায় অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

একজন সত্যিকারে মুমিনকে কেউ কাফের ফতোয়া দিলে ফতোয়াদানকারী কেন কাফের হবে, সে নিয়ে বেশ কয়েকদিন ভাবছিলাম। হঠাৎ মাথায় আসল, যে মুমিন ব্যক্তিকে কাফের ফতোয়া দেয়া হয়েছে, সে যদি সত্যিকারের রবের প্রতি ঈমান এনে মুমিন হয়ে থাকে, আর সত্যিকারের রবের প্রতি ঈমান আনার পরও যদি কাফের বলা হয়ে থাকে, তাঁর মানে হল ফতোয়া দানকারী মুমিন ব্যাক্তিকে কাফের ফতোয়া দিয়ে ঐ সত্যিকারের রব কে অস্বীকার কারী হয়ে যায়। যেমনটা আমরা দেখি যে, মক্কার কাফেররা রাসূল (সাঃ) কে ধর্মত্যাগী বা কাফের বলত। মানে রাসূল (সাঃ) যে সত্যিকারে রবের প্রতি ঈমান এনেছেন সেই সত্যিকারের রবকে তারা অস্বীকার করেছে তাই তারা কাফের হয়েছে।

এ ব্যপারে ইসলাম এত মজবুত ভূমিকা নেয়ার কারণ হচ্ছে, ইসলামে এক মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের সন্মান নষ্ট করা, সম্পদে হস্তক্ষেপ করা এবং রক্ত ঝড়ানোকে হারাম করে দেয়া হয়েছে। (আবু হুরায়রা রাঃ বর্ণিত হাদীস, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৪৩৫, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৯৩৩, ঈমাম নাওয়ায়ীর ৪০ হাদীসের ৩৫ নং হাদীস।) আর কাফের ফতোয়া দেয়ার মাধ্যমে একজন মুসলমানের সন্মানে আঘাত করা হয়।

হাসান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যদি কেউ বলে আমি জান্নাতি তাহলে সে জাহান্নামি। (কারণ জান্নাত জাহান্নামের ফায়সালার দায়িত্ব নিয়ে সে টানাটানি করেছে। যে দায়িত্বটা মূলত সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্‌ তায়ালার)।

কাউকে কাফের ফতোয়া দেয়ার আগে যে বিষয় গুলো জানা শর্ত,
১। কেউ যদি কুফুরির বাক্য উচ্চারণ করে অথবা কোন কাজ করে যেটা বাহ্যত কুফুরী মনে হয়, তাহলে ঐ কর্তাকে তার নিয়তের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে হবে। হাদীসের দুটি উদ্ধৃতি ভালো করে খেয়াল করুন…

ক। কুফুরির বাক্য উচ্চারণ করার পরও একজন আল্লাহ্‌ পাকের অনেক প্রিয় হওয়ার দালীল, যেমন এক সাহাবী (রাঃ) মরুভূমিতে হারানো উট ফিরে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে বলে ফেলেছিল اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ যার অর্থ হচ্ছে “হে আল্লাহ্‌। তুমি আমার গোলাম , আর আমি তোমার রব। যেখানে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উনি বলতে ছেয়েছিলেন যে, “আল্লাহ্‌ তুমি আমার রব আর আমি তোমার গোলাম। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৪৭)

খ। কোন মুমিনের কাছ থেকে প্রকাশিত যে কোন কাজ যেটা বাহ্যত কুফুরী বা মুনাফেকি মনে হয়, কিন্তু নিয়ত প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত তাকে কাফের বা মুনাফেক বলা যাবেনা। কারণ নিয়ত প্রকাশ করার পর তা স্পষ্ট হয় যে তা আসলে কুফুরী বা নিফাকী কি না। হাতিব বিন আবু বালতা’আহ নামে একজন সাহাবী মক্কায় বিজয়ের ঠিক আগ মূহুর্তে একটি চিঠি দিয়ে রাসূল (সাঃ) -এর মক্কায় আগমনের খবর মক্কায় অবস্থানকারী তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। আর তিনি তা মক্কা অভিমুখী এক নারীর কাছে দিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌ তায়ালা জিব্রাঈল পাঠিয়ে জানিয়ে দিলে, রাসূল (সাঃ) সেই চিঠি উদ্ধার করলেন। খবর পাঠিয়ে আবু বালতা’আহ (রাঃ) আনা হলে, তিনি বললেন, আমি রাসূল (সাঃ) -এর অভিযানের গোপনীয়তা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য ছিলনা। বরং আমার পরিবারের লোকদেরকে সতর্ক করা উদ্দেশ্য ছিল। ওমর (রাঃ) বলেই ফেললেন যে, এই মুনাফিকটাকে হত্যা করার অনুমতি দিন। রাসূল (সাঃ) বললেন, থাম। আবু বালতা’আহ সত্য বলেছে। সে বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সাহাবীদের একজন, যাদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ্‌ তায়ালা খুশি হয়ে বলেছেন তোমরা যা ইচ্ছা তাই কর। (সহীহ আল-বুখারীঃ ৩০৮১)

২। আরেকটি শর্ত হলো, কুফুরির বাক্য বলতে কেউ যদি বাধ্য করে, বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য কেউ বললে সে কাফের হবে না। যেমন ভারতে “জয় শ্রী রাম” বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। যারা বাধ্য হয়ে “জয় শ্রী রাম” বলতে হচ্ছে তারা কাফের হবেনা। আর এটা নতুন নয় বরং মাক্কী জীবনে আবু জাহল, আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) কে “মুহাম্মাদ (সাঃ) মিথ্যাবাদী” এ কথা বলতে বাধ্য করেছিল। তখন আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) দেখলেন এ কথাটি না বলায় তাঁর মাকে তাঁর চোখের সামনে হত্যা করা হয়েছে । আর তিনি এ কথা না বললে আবু জাহল তাকেও হত্যা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তখন তিনি জীবন বাঁচাতে এটা বলেছেন। আর ছাড়া পেয়ে তৎক্ষণাৎ উনি রাসূল (সাঃ) কাছে উপস্থিত হয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন, ইয়া রাসূল আল্লাহ্‌! আমার অন্তরে আপনি সত্য নাবী এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, কিন্তু জীবন বাঁচাতে আমি ওটা বলেছি। আল্লাহ্‌ তায়ালা তখন সূরা নাহলের ১০৬ নং আয়াত নাযিল করে জানিয়ে দিলেন যে, কেউ বাধ্য হয়ে কুফুরীর বাক্য বললেও সে কাফের হবেনা।

মিজানুর রাহমান আযহারীকে কাফের ফতোয়া দিলেন। আর কাউকে কাফের ফতোয়া দিলে, উপরে উল্লেখিত কোরআন এবং হাদীস মোতাবেক অবশ্যই অবশ্যই এই কাফের ফতোয়া দুজনের একজনের দিকে যাবেই যাবে। কাফের হওয়ার নিয়ত ছাড়া কুফুরির বাক্য বলেও হাদীস থেকে পাইলাম যে, একজন মানুষ মুসলিম থাকবে। মিজানুর রাহমান আযহারিতো উনার নিয়তের কথা সাড়া দুনিয়া বাসিকে জানিয়ে দিলেন। এখন আপনার উপায় কি? হাদীসতো বলে আপনার ফতোয়া আপনার দিকে ফিরে গেছে। আর আপনার ফতোয়া যদি আপনার দিকে ফিরে গিয়ে থাকে, তাহলে আপানার কি করতে হবে?

আহমেদ দীদাতের ব্যাপারে বললেন যে, উনি নাকি খ্রিষ্টান পাদ্রী ছিলেন। পরে একজন মুসলমান স্কলারের সাথে বিতর্ক হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আহমেদ দীদাত মাওঃ রাহমাতুল্লাহ কাইরানাওয়ির বই পড়ে পরের দিন বিতর্কে এসে বলেছেন যে আমি বুঝতে পেরিছি ইসলামই সত্য ধর্ম। কোন বিতর্ক নাই, আমি কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলাম। (অথচ এটা একটা ডাহা অসত্য কথা) কারণ আহমেদ দীদাত একজন জন্মগত মুসলিম। উনার বাবার নাম হল হোসাইন দীদাত। হোসাইনের সন্তানকে খ্রিষ্টান বানিয়ে দিলেন।

মুসলমানকে কাফের, খ্রিষ্টান বানানোর দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়ে রাসূল (সাঃ) -এর রেখে যাওয়া “দাওয়াতি কাজ”; যে দাওয়াতি কাজ শুরু করেছিলেন একা আর ২৩ বছরে সেই এক থেকে এক লক্ষাধিক মুসলিম সাহাবীদেরকে রেখে গিয়েছিলেন, সেই দায়িত্বটা দয়া করে গ্রহণ করুণ।

ভুলত্রুটি ক্ষমা করার ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌ তায়ালার দয়ার বিশালতা আমাদের সবারই কম বেশী জানা আছে। তারপরও এখানে দুটো হাদীস উল্লেখ করলামঃ-

আমরা প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) -এর উম্মাত হওয়ার বরকতে আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের ৪ প্রকারের বিষয় মার্জনা করে দিবেন। নীচে হাদীস (ক) -তে ৩ টি ও হাদীস (খ) -তে ১ বিষয়ের উল্লেখ আছেঃ-

(হাদীস ক)। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমার খাতিরে আল্লাহ্ তায়ালা আমার উম্মাতের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ও ভুলে যাওয়ার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তার সে কাজ যা সে করতে সে বাধ্য হয়েছে।
(ঈমাম নাওয়ায়ীর ৪০ হাদিস, হাদিস নং ৩৯, [এ হাদীসটি হাসান। ইবনে মাজাহ্ (নং-২০৪৫), বায়হাকী (সুনান, হাদীস নং-৭) ও আরো অনেকেই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।] হাদিসের মান: হাসান হাদিস)

এই হাদীসে তিনটি পয়েন্টঃ
১। কোন ঈবাদাত বা কাজ করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে ঐ ঈবাদাত বা কাজের ভিতরে হয়ে যাওয়া ত্রুটিগুলো যে গুলো আমরা জানিওনা যে ভুল করেছি ঐগুলো আল্লাহ্‌ তা’য়ালা ক্ষমা করে দেন।

২। আল্লাহ্‌ তায়ালা কোন ঈবাদাত বা কাজ করতে ভুলে যাওয়ার অপরাধ ক্ষমা দেন। যেমন, কেউ যদি রামাদান মাসে দিনের বেলায় ভুলবশত খেয়ে ফেলে। তাহলে তার রোযা ভঙ্গ হবেনা। অথবা কেউ নামাজ পড়তে সম্পূর্ণ ভুলে যায় এবং এই অবস্থায় নামজের ওয়াক্তও চলে যায়, স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে সে পড়ে নেবে। ইচ্ছাকৃত নামাজ কাজার যে গুনাহ হয় তার সে গুনাহ হবেনা।

৩। কোন পাপকাজ করতে অন্য কেউ বাধ্য করলে আল্লাহ্‌ তায়ালা ঐ পাপ ক্ষমা করে দেন। যেমন, উপরে আমরা ‘আম্মার ইবনে ইয়াসিরের কথা আলোচনা করেছি।

সহীহ বুখারীর বর্ণনায়, আরো একটি বিষয় এসেছে যেটা আল্লাহ্‌ তায়ালা ক্ষমা করে দিবেন। সেটা হলোঃ-
(হাদীসঃ খ)
৪। মনের ভিতরে যে কুচিন্তার উদয় হয় তা না বললে এবং কাজে পরিণত না করলে আল্লাহ্‌ তায়ালা তার জন্য কোন মুমিন ব্যক্তিকে শাস্তি দিবেন না। (আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৫২৮)।

তার মানে যে গুলো দিয়ে আপনারা কাফের বানাতে চাচ্ছেন, আল্লাহ্‌ তায়ালা সেগুলো ক্ষমা করে দিতে চান। চলুননা, আল্লাহ্‌ যেটা চাচ্ছেন সবার জন্য সেটা চাই, সবার জন্য ক্ষমা চাই। যাদের জন্য ক্ষমা চাইব তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার আগে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন, ইন শা আল্লাহ্‌।

কার্টেসিঃমুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম আল আযহারী।

পঠিত : ৭৭৮ বার

মন্তব্য: ০