Alapon

কিশোর মতিউরের গল্প



মাত্র ষোল বছর বয়সের এক কিশোর। নবম শ্রেণি পাশ করে সবে দশম শ্রেণিতে উঠেছে। পুরোনো ঢাকার বকশিবাজারে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী স্কুল নবকুমার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র সে। তার নাম মতিউর, পুরো নাম মতিউর রহমান মল্লিক। মা-বাবার কাছে শুধু মতি। তার বাবা আজহার আলি মল্লিক স্বল্প বেতনের এক ব্যাংক-কর্মচারি। বেশ টানাটানির সংসার।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে মিশে আছে তার নাম। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর তার পতন হয়, সেই সংগ্রামের এক পর্যায়ে কিশোর মতিউরের সাহস ও আত্মত্যাগ চলমান আন্দোলন-সংগ্রামকে আরও বেগবান করে। আরও প্রসারিত করে।

১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবসহ আরো অনেক বিশ্বাসঘাতক আগরতলায় ভারতের সাথে একটা চুক্তিতে মিলিত হওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলো। তাদের টার্গেট ছিলো পাকিস্তান ভাঙার। এজন্য মুজিবরা বিদ্রোহ করবে আর ভারত তাদের সব ধরনের সাহায্য করবে। আইয়ুব সরকার হাতে নাতে ষড়যন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে। মুজিবসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তাঁকে এবং অন্য সহযোগীদের গ্রেফতার করে জেলে দেয়া হলো।

কিন্তু মুজিব অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগাররা এটিকে মিথ্যা মামলা হিসেবে উপস্থাপন করে। দেশের মানুষ মুজিবের কথাই বিশ্বাস করে। কারণ আইয়ুব খান একজন স্বৈরাচারী শাসক। সে তার বিরোধীদের যে কোনো মামলায়ই ফাঁসাতে পারে। এই বিশ্বাস ছিলো সবার।

পাকিস্তানকে ভাগ করতে চাওয়া আরেক নেতা ভাসানী এটিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি মুজিবের মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো মুজিব আওয়ামীলীগের নয়, ন্যাপের সভাপতি। তারাই বেশি এগ্রেসিভ ছিলো। চারদিকে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু হলো। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনেম খান পরিস্থিতি কনট্রোল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলেন।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাস। আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার রুখতে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে আইয়ূবের সরকার। ন্যাপ, আওয়ামীলীগ একত্রে আন্দোলন করে। ঢাকা ভার্সিটি ছিলো আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। ভাসানীর গরম বক্তব্য বাঙালিদের উত্তপ্ত করে তোলে। এমন একটি বক্তব্য শোনে কিশোর মতিউর। তার ভেতরে ঘৃণা আর প্রতিবাদের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলে।

এক সময় সেও একাত্ম হয়ে যায় আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে। মিটিং-মিছিলে যোগ দিতে থাকে বড়দের সাথে। প্রায়ই মিছিলের সামনের সারিতে দেখা যায় তাকে। এর আগে সে ন্যাপের সংস্পর্শে এসেছিলো।

২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়। এতে মৃত্যুবরণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান। মতিউরও ছিল সেই মিছিলে। নিজের দেশের পুলিশ কী নৃশংসভাবে গুলি চালিয়ে পাখির মতো নিজের দেশের মানুষ মারতে পারে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য খুব কাছে থেকেই দেখেছিল মতিউর।

এই ঘটনায় সে ভীত বা আতঙ্কিত হয়নি বরং তার মধ্যে প্রতিবাদী মনোভাব আরও জোরালো হয়। আইয়ুবের স্বৈরশাসনের প্রতি তার ঘৃণা আরও তীব্র হয়। সে যেন রাতারাতি হয়ে ওঠে আন্দোলনের এক লড়াকু সৈনিক। সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আসাদ হত্যার ঘটনায় প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ২৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে হরতাল ডাকা হয়। ঢাকার রাজপথ সেদিন মিছিলে মিছিলে উত্তাল।

মতিউর যোগ দেয় বিক্ষোভ মিছিলে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মিছিল চলছে। মুখে তাদের নানা স্লোগান। আকাশ-বাতাস কাঁপানো প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের অগ্নিঝরা ধ্বনি। পুলিশ গুলি চালায় মিছিলে। আর তাতেই মৃত্যুবরণ করেন কিশোর মতিউর। গুলিতে ঝরে পড়ে আরও ক’টি তাজা প্রাণ। এই নৃশংস ঘটনা যেন জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিলো। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ক্ষোভ আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আরো তীব্র হয়ে উঠলো।

এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানে ভুট্টোর নেতৃত্বে চলছে আইয়ুব পতনের আন্দোলন। পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা ছিলো সেই আন্দোলনের প্রাণ। আইয়ুব পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন দমাতে মুক্তি দেয় মুজিবকে। মুজিবের সাথে আইয়ুবের আগেই কথা হয় তাকে সমর্থন করা নিয়ে। মুজিব বের হয়েই সব রাজনৈতিক দলকে শান্ত হওয়ার আহবান জানান। তার জন্য জীবন দেয়া ন্যাপ কর্মীদের আত্মত্যাগকে পায়ে ঠেলে মুজিব। আইয়ুবের গোল টেবিল বৈঠকে বসার জন্য সবাইকে আহবান করে মুজিব।

যদিও এসবের কোনটাই আইয়ুবকে রক্ষা করেনি। ভুট্টোর নেতৃত্বে আইয়ুবের পতন হয়।

পঠিত : ৫০৫ বার

মন্তব্য: ০