Alapon

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং মেরুদন্ডহীণ জাতির আত্মকথা...


ঠিক দশবছর আগে যখন সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করা হয়েছিল, বলা হল, ছেলেমেয়েদের এখন থেকে আর না বুঝে মুখস্থ করতে হবে না, গাইড বই পড়তে হবে না, কোচিং এ দৌড়াতে হবে না। কাগজে কলমে এগুলো ছিল সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির সুফল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, গত দশ বছরে গাইড বইয়ের বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। কারণ স্কুলের পরীক্ষায় শিক্ষকরা এখন গাইড থেকে সরাসরি প্রশ্ন তুলে দেন। এক সেট সৃজনশীল প্রশ্ন বানানোর মত এত সময় এবং সৃজনশীলতা তাঁদের নেই। এদিকে কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য তো কমেই নি, উল্টো কোচিং নির্ভরতা আগের চেয়ে বেড়েছে কারণ শিক্ষার্থীরা বোঝেই না সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখতে হয়। কথা ছিল, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু হলে, শিক্ষার গুণগত মান বাড়বে। উল্টো দেখা গেল, নির্বিচারে প্রশ্নফাঁসের ফলে গোবর গণেশেরাও এখন বলতে পারে, আই আম জিপিএ ফাইভ।

পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন এবং খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি যত কিম্ভূতকিমাকারই হোক না কেন, এতকাল ধরে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে একটা আশা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতা যাচাইয়ের ন্যায্য সুযোগটা পাওয়া যাবে। এবার সে আশায় গুড়ে বালি দিয়ে চালু করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যলয়গুলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। বাংলাদেশের মুমূর্ষু শিক্ষাব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়া হল এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার নামে যে প্রহসন আগামী বছর থেকে চালু হবে, সে ব্যাপারে কিছু কথা না বললেই নয়।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কোন নতুন ধারণা নয়। চীন ও ভারতের মত শতকোটি মানুষের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়, যাতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট করে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াতে হয় না। ফর্মের নামে এক টুকরা কাগজ কিনতে হাজার হাজার টাকা খরচ হয় না। উপরন্তু সবাই একই মূল্যায়ন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যায় বলে, মূল্যায়ন অধিকতর নিরপেক্ষ হয়। এই পয়েন্টগুলোকে হাইলাইট করে অচিরেই হয়ত সাদাসিধে কলাম লেখা হবে। এদেশে কাজীর গরু কাগজে থাকলেও গোয়ালে থাকে না। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল সৃজনশীল পদ্ধতি। তত্ত্ব অনুযায়ী সৃজনশীল খুব ভালো একটা পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশের মত একটা দেশ, যেখানে শিক্ষার অবকাঠামোর একদম নাজুক, সেখানে এই পদ্ধতি মোটেও সময়োপযোগী নয়। শিক্ষাব্যবস্থাকে সৃজনশীল করার জন্য সরকারের অন্তত দশ বছর প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার ছিল। সেটা তো নেওয়াই হয়নি, উল্টো তড়িঘড়ি করে সৃজনশীল চালু করে বহু বছর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটা একটা ব্যবস্থাকে একদম পঙ্গু করে দেওয়া হল। আগামী বছর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু হলে এই পঙ্গু ব্যবস্থার মৃত্যু হবে।

একটা কথা স্পষ্টভাবে বোঝা প্রয়োজন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা যথেষ্ট কার্যকরী একটা ব্যবস্থা। কিন্তু এটাকে কার্যকর করার মত অভিজ্ঞতা প্রশাসনের নেই, প্রশ্নফাঁস ঠেকানোর মত পর্যাপ্ত পরিকল্পনা নেই, নিশ্চিদ্রভাবে পরীক্ষাকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার মত বিশ্বস্ত লোকবল নেই। এসব সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রেখে প্রাথমিকভাবে শুধু চারটি এঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়কে এই ব্যবস্থার আওতায় আনা যেত। অথবা ঢাবি, রাবি, জাবি এবং চবির ভর্তি পরীক্ষাকে একই ছাতার নিচে আনা যেত। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে অংশ নিলে, এর ফলাফল হবে ভয়াবহ, পরিস্থিতি চলে যাবে নাগালের বাইরে।

একজন মানুষ খুব ভালো শিক্ষক হলেই যে, খুব ভালো নীতিনির্ধারক হবেন এমন নয়। আবার কেউ বিজ্ঞানবিষয়ক সুখপাঠ্য বই খুব ভালো লিখলেই যে, স্কুলের পাঠ্যবই ভালো লিখবেন এমনও নয়। যার যেখানে পারদর্শীতা, এর বাইরে তার কাছে কিছু প্রত্যাশা করা একদম বেইনসাফি। যদি কেউ যেচে সেটা করতে যান, সেটা হবে তার অপরিণামদর্শীতা। সম্প্রতি শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যার এবং কায়কোবাদ স্যার নবম দশম শ্রেণীর জন্য যে পদার্থবিজ্ঞান-রসায়ন বই লিখেছেন, হাইস্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষকবৃন্দ বই দুটো নিয়ে যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, বইগুলো সমন্বয়হীন এবং তাড়াহুড়ো করে লিখা। অথচ একই বই ডঃ জাফর ইকবাল এবং ডঃ কায়কোবাদ যদি দুই-তিন বছর সময় নিয়ে, মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে লিখতেন, তাহলে চমৎকার একটা কাজ হতে পারত।

যখন যা খুশি, তাই চালু করে বছরের পর বছর ধরে ছেলেমেয়েদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। এর ফল পাওয়া যাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। ক্রমাগত উন্নয়নের জোয়ার বয়ে চলা এদেশে চারদিকে শুধু সনদ প্রাপ্ত বেকারদের সার্টিফিকেট ভাসছে। এদেশে মেরুদন্ডহীনভাবে গড়ে উঠছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যাদের চাকরি পাওয়ার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হল চাটুকারিতা আর মোটা অংকের ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য।

সাকিব মুস্তাফি

পঠিত : ৫২৬ বার

মন্তব্য: ০