Alapon

শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা উপাধি এবং ডাকসুর সদস্যপদ প্রত্যাহার প্রসঙ্গে



আমাদের দেশে নতুন এক ট্রেন্ড চালু হয়েছে। শেখ হাসিনা খারাপ হলেও জয় বাংলা ভালো, মুজিবতো অসাধারণ ভালো। মুজিবের মতো নেতাই হয় না। আগের আওয়ামীলীগ ভালো। এখনকার আওয়ামীলীগ খারাপ। কথিত স্বাধীনতার পর দেশে সোনালী যুগ নেমে আসছে। কোটা আন্দোলনের ছাত্রদেরও দেখেছি বলতে "মুজিবের বাংলায় বৈষম্য চলতে পারে না"। আজ আপনাদের মুজিবের একটি ঘটনা বলবো, যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার 'বঙ্গবন্ধু' ও 'জাতির পিতা' উপাধি প্রত্যাহার করা হয়েছে। একজন সন্ত্রাসী এবং স্বৈরাচার কখনোই জাতির সম্মানিত ব্যক্তি হতে পারে না।

১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি, নববর্ষে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে নিহত হন মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদিরুল ইসলাম। আহত হন অনেক ছাত্র-ছাত্রী, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন ১৪ বছরের স্কুলছাত্র পরাগ।

আজ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির যিনি সভাপতি, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, তিনি ১৯৭৩ সালে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ ‘ডাকসুর নির্বাচিত সহ-সভাপতি। সেদিন সেলিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা ভিয়েতনামে মার্কিন হামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঢাকায় মার্কিন তথ্যকেন্দ্র’র সামনে বিক্ষোভ জানাতে গিয়েছিলেন।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ যেমনটি করছে আফগানিস্তানে কিংবা যেমনটি করেছে লিবিয়াতে ও ইরাকে, তেমনি ভিয়েতনামে চার দশক আগে গ্রামের পর গ্রাম, জনপদের পর জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল নাপাম বোমার আঘাতে। লাখ-লাখ ভিয়েতনামী নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ প্রাণ হারিয়েছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র আক্রমণে।

সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন কিশোর পরাগ। সেখান থেকে মিছিলের সঙ্গে গিয়েছিলেন বর্তমান ঢাকা প্রেসক্লাবের বিপরীতে অবস্থিত তকালীন ‘যুক্তরাষ্ট্র তথ্য কেন্দ্র’র সামনে। বাংলাদেশে বিক্ষোভের জবাবে মিলবে বুলেট-বৃষ্টি তাও বিক্ষোভ মার্কিনীদের বিপক্ষে এটা ধারণাই করতে পারেনি তৎকালীন ঢাবি ছাত্ররা।

শেখ মুজিবের মার্কিনীদের প্রতি টান ছিলো অন্যরকম। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের মার্কিন-সহযোগী অংশের নেতা ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান। আর মার্কিন-বিরোধী ছিলেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৫৭ সালে মার্কিন চুক্তিতে পাকিস্তানের স্বাক্ষর করা না-করা নিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরে চুক্তি-বিরোধীদের শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমা করেননি। নির্মমভাবে পিটিয়েছিলেন পাক-মার্কিন চুক্তি-বিরোধী বামপন্থী আওয়ামী লীগ কর্মীদের।

কাগমারি সম্মেলনে ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানের গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেন, ‘শহীদ, তুমি আজ আমাকে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সমর্থন করতে বলছো। তুমি যদি আমাকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো, আমি বলবো, না। তুমি যদি আমাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো- আমি বলবো ‘না’! ‘না’! তুমি আমাকে যদি আমার কবরে গিয়েও জিজ্ঞাস করো সেখান থেকে আমি চিৎকার করে বলবো, ‘না’! ‘না’! ‘না’!

কোনো ব্যক্তিই তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর উত্তরসূরি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আদর্শিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক। শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো প্রয়োজন ছিল, ভিয়েতনাম প্রশ্নে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে পাকিস্তান আমলেও দাঁড়িয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ আমলেও দাঁড়াবেন। কারণ, তিনি সমর্থক ছিলেন সেই সিয়েটো চুক্তির, যে চুক্তিতে ভিয়েতনামকে রক্ষার নামে আক্রমণ করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সিয়েটো চুক্তির উল্লেখ করেই ভিয়েতনামে মার্কিন অভিযানের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে ১৯৫৭ সালে নেতা হয়ে নিজদলের কর্মীদের মার্কিন-বিরোধিতা সহ্য করেননি, সেই তিনি ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে কমিউনিস্টদের মার্কিন-বিরোধিতা সহ্য করবেন, এটি হতেই পারে না।

১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারী, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে নিহত হন মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদিরুল ইসলাম। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন অনেক ছাত্র-ছাত্রী।

ঢাবির ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নেতার উপর পুলিশের আক্রমণ দেখে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকেন। যে-ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা তাঁদের শান্তিপ্রিয়তার জন্য প্রায়শঃ ‘হারমোনিয়াম পার্টি’বলে উপহাসিত হয়ে থাকেন, সেই সংগঠনের কর্মীদের হটিয়ে দেবার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গুলিবর্ষণের হুকুম দিলো। প্রায় আধাঘন্টা টানা গুলিবর্ষণ হলো।

ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে গুলিবর্ষণ করে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছিলেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি তার পুরনো অবস্থান পরিবর্তন করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান সেই মার্কিন-আস্থা লাভ করতে চেয়েছিলেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে গুলিতে নিহত দুইজনের লাশ সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিম্নোক্ত ঘোষণা পাঠ করেন।

‘‘এই সমাবেশের সামনে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি যে, বিগত ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসু’র পক্ষ থেকে আমরা যে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিলাম ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আজ সেই 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি প্রত্যাহার করে নিলাম। আমরা দেশের আপামর জনসাধারণ, সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে তার বঙ্গবন্ধু বিশেষণ ব্যবহার করবেন না।

একদিন ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা শেখ মুজিবকে 'জাতির পিতা' আখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবার ছাত্রের রক্তে তার হাত কলঙ্কিত করায় আমরা ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি, আজ থেকে কেউ আর জাতির পিতা বলবেন না। শেখ মুজিবুর রহমানকে একদিন ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল। আজকের এই সমাবেশ থেকে ডাকসু’র পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ বাতিল করে দেয়া হলো।’’
(৩ জানুয়ারী ১৯৭৩, দৈনিক সংবাদ)

সভাশেষে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের নির্মম গুলির শিকার মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদেরের লাশ নিয়ে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন শ্লোগান সহকারে শহরের প্রধান রাজপথগুলো প্রদক্ষিণ করে বায়তুল মোকাররমে এসে সমাপ্ত হয়। সেদিন বিক্ষোভ মিছিলে উচ্চারিত শ্লোগানগুলো হচ্ছে—

‘নিক্সন-মুজিব ভাই ভাই,—এক রশিতে ফাঁসি চাই,’
'খুনিশাহী মুজিবশাহী, ধ্বংস হোক,ধ্বংস হোক'
'বাংলার মীরজাফর, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব'

পঠিত : ১৯০৫ বার

মন্তব্য: ০