Alapon

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মৃত্যু; আমার দেখা সবচেয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু...


আমার ছাব্বিশ বছরের জীবনে আমি সবচেয়ে মর্মান্তিক যে মৃত্যুটা চোখের সামনে দেখেছি, তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মৃত্যু। আমার চোখের সামনে প্রিয় ক্যাম্পাস তিলে তিলে গত আট বছরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছে, এখন ক্যাম্পাস বলতে আমরা যেখানে যাই, তা ক্যাম্পাসের লাশ মাত্র।

২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল আসলেই একটা ক্যাম্পাসের মত। হয়তো তখন এত বিশাল বিশাল একাডেমিক ভবনগুলি ছিল না, কিন্তু তখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নগ্নভাবে দুষণের ছাপ লক্ষ্য করা যায় নি। কার্জন হল থেকে শিক্ষা ভবনের দিকে যাবার সময় সারি সারি কৃষ্ণচুড়া, সোনালু, ঝাউ আর দেবদারু গাছের ডালে বসে থাকা পাখিদের কলরবে মুখর থাকতো কার্জনের চোখজুড়ানো সবুজ প্রাঙ্গন। এই কার্জনে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা এখানে এসে মানসিক অবসাদ ছুড়ে ফেলতো, সবুজ-হলুদ-লালে মেশানো স্কাইলাইনের মাঝে ঢাকায় যে সামান্য এক টুকরো নীল আসমান দেখা যায় তা এখানেই ছিল। বর্ষা, শীত আর বসন্তে ফিজিক্স ভবন থেকে কেমিস্ট্রি, বোটানি, সয়েল সায়েন্স পেরিয়ে পুকুরপাড়ে এসে পৌছাতে পৌছাতে নজরে যেন পেলব ছোয়া দিয়ে যেত অজস্র ফুলের রঙ, চড়ুই, শালিক, ঘুঘু, বুলবুল, দোয়েল আর মাঝে মাঝে কোকিলের ডাক। পুকুরপাড়ের এপার আর ওপারে কুয়াশার ফাক দিয়ে উঁকিঝুকি মারা সোনালি রোদ আর হিমেল হাওয়ার সাথে নারকেল পাতার দুলুনির প্রেমে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে একবার এলে আর যেতে চাইতো না।

ঢাকা শহরের সেরা রাস্তাগুলোর একটা ছিল কার্জন থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসি চলে যাওয়া রাস্তাটা। একপাশে কার্জন, অন্য পাশে মোকাররম, তারপর একদিকে তিন নেতার মাযার আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর অন্য পাশে সায়েন্স লাইব্রেরী, পুষ্টি ভবন, বাংলা একাডেমী, পরমাণু শক্তি কমিশন হয়ে টিএসসি। অবিশ্বাস্য রকমের স্নিগ্ধ এক ঝটকা বাতাস প্রায়ই চোখেমুখে এসে লাগতো এই রাস্তায় হাটার পথে। জ্যোৎস্না রাতে যেন কার্জন, মোকাররম হয়ে টিএসসি পর্যন্ত উপচে পড়তো চাদের আলো। এই পথে দিনে ও রাতে আমি হাজার হাজার বার হেটেছি আমার ক্যাম্পাস জীবনের সাড়ে পাচ বছরে, তার আগে ও পরে।

কার্জন ও তার আশপাশটা নষ্ট হওয়ার শুরুটা অমর একুশে বইমেলা এবং ভ্যালেন্টাইন্স ডে-পহেলা ফাল্গুনকে কেন্দ্র করে যে অপ্রয়োজনীয় সস্তা শো অফের মহড়া চলে তাকে ঘিরে। এই জায়গাটা সমস্ত শহরের কপোত-কপোতীদের বাজারে পরিনত হয়, যাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে থরে থরে ছবি তুলে ফেইসবুক-ইন্সটায় আপলোড দিয়ে নিজ প্রেমের মহত্ব জাতির কাছে তুলে ধরা। সাথে যোগ হয় বইমেলায় আসা ক্রেতাদের ভিড়। ২০১৪ সাল নাগাদ দেখা যায়, ১৪ই ফেব্রুয়ারীর পরের দিন সমগ্র ক্যাম্পাস ফুলের তোড়া, প্লাস্টিকের প্যাকেট, ওয়ান টাইম চিকেন বিরিয়ানীর প্যাকেট, ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের কাপ/গ্লাস, পানির বোতল, সিগারেটের প্যাকেটসহ নানান আবর্জনায় একেবারে উপচে পড়ছে। দোয়েল থেকে টিএসসি যাওয়া রাস্তাটার ফুটপাতের একাংশ পেশাব করে নাইয়ে দিয়ে যেত নাগরিক ভদ্রলোকেদেরই অংশবিশেষ।

সময়ের সাথে সাথে এই ভিড় কেবলই বেড়েছে। কিন্তু তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটা জ্যান্তই ছিল, যতক্ষণ না এখানে মেট্রোরেল প্রকল্প তার দন্ত-নখর বসাতে শুরু করে।

২০১৬ সাল থেকে শুরু হয়ে একটু একটু করে এই প্রকল্প ক্যাম্পাসে জেকে বসেছে আর ক্রমেই ধুসর হয়েছে ওপরের নীল আকাশ, গাছের পাতার চোখজুড়ানো সবুজও এখন ধুসর, শাহবাগ থেকে কেউ যদি টিএসসি হয়ে কার্জনে আসতে চায়, সম্ভাবনা আছে তাকে প্রায় পোয়াটাক ধুলো গলধকরন করে তবেই নিজ গন্তব্যে পৌছুতে হবে।

তিন নেতার মাযার রোডের সেই অনিন্দ্য সুন্দর রাস্তাটাকে খুন করা হয়েছে, তারপর খুন করা হয়েছে শিশু একাডেমী থেকে শুরু করে হাইকোর্ট পর্যন্ত,ওদিকে উন্নয়ন নামের ছুরি সেঁধিয়ে গেছে একেবারে টিএসসি হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত ক্যাম্পাসের মহাধমনীটাকে অচল করে দিয়ে।

ক্যাম্পাসের এদিকটার বাতাস আগের চেয়ে ভারী হয়েছে, পাখির ডাকের চেয়ে এখানে এখন বেশি শোনা যায় ড্রিলমেশিনের বা মোটরের আওয়াজ।

সবুজ আর নীল হারানো ক্যাম্পাসের লাশের গায়ে এখন উন্নয়নের ধুসর কাফন।
দু হাজার তেরো সাল থেকে সতেরো সালের দিকের বিকেলগুলোতে দোয়েল চত্ব্বর থেকে টিএসসি হয়ে শাহবাগের রাস্তায় রাস্তায় বিকেলবেলায় বন্ধুরা দল বেধে গাইতো রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর গান, 'ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো!!'
এখন চিঠি লেখার জন্য আমাদের কোন আকাশ নেই, দম নেয়ার জন্য নেই ক্যাম্পাসের সেই বিখ্যাত বাতাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মরে গেছে মেট্রোরেল প্রকল্পের ধকল সামলাতে না পেরে।
আমি কোনক্রমেই আশা করতে পারছি না জাপানের মত বাংলাদেশের মেট্রোরেলও শব্দহীন হবে, কারন এখানে কাজীর গরু গোয়ালে নয়, কেতাবেই থাকে। আর দু বছর গেলে হয়তো কার্জনের ক্লাস বন্ধ করে দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবে মেট্রোরেলের অবিরাম ঝিকঝিক আওয়াজে। পলাতক পাখিদের মিছিলে শামিল হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আর সেইসব শিক্ষকের পাল, যারা নিজেদের বিবেক বন্ধক দিয়ে শিক্ষকতার নামে রঙ্গশালার প্রম্পটার সেজে বসে আছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এই লাশটার কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে নি, তাই সরকারী ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া এর জানাযার কোন ইন্তেজাম করা যাচ্ছে না। তবু কার্জনের প্রাঙ্গনে কান পাতলে আমি কন্সট্রাকশান সাইটের আওয়াজে পালিয়ে যাওয়া পাখিদের কান্নার আওয়াজে খুজে পাই এই লাশের হাহাকার।
চোখের সামনে আমাদের ক্যাম্পাসটা মরে গেছে।

Muhammad Sajal

পঠিত : ৪৩৩ বার

মন্তব্য: ০