Alapon

রাজীব গান্ধি হত্যাকান্ড এবং অজানা ইতিহাস...


রাজীব গান্ধী শ্রীপেরামবুদুর শহরের জনসভাস্থলে পৌছান রাত ১০টায়। আর তার হত্যাকারী ধানু পৌছায় দুই ঘন্টা আগে , রাত ৮টায়। তারিখ ১৯৯১ সালের ২১শে মে। ধানু ছিল শ্রীলংকার লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) বাহিনীর আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। সে শ্রীলঙ্কা থেকে নৌপথে দুই মাস আগে এল টি টি ই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নির্দেশে ভারতের মাদ্রাজ ( এখনকার চেন্নাই ) শহরে আসে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার জন্য।

বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন ১৯৯০ সালে সানডে ম্যাগাজিনে ২১শে আগস্ট সংখ্যায় রাজীব গান্ধী একটা সাক্ষাতকার দেন। সেই সাক্ষাতকারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন , পরবর্তী নির্বাচনে যদি তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব পান তাহলে শ্রীলঙ্কায় আবার ইন্ডিয়ান শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো হবে।এই সাক্ষাতকার প্রকাশ হবার পরপরই লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম মরিয়া হয়ে উঠে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার জন্য কারন সে সময় সব জরিপেই রাজীব গান্ধী এগিয়ে ছিলেন।

এলটিটিই হিসাব করে দেখেছিল যে রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস ক্ষমতায় আসলে ইন্ডিয়ান শান্তিরক্ষী বাহিনী এসে যোগ দিবে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সাথে। কঠিন হয়ে যাবে তাদের যুদ্ধ। সাথে যোগ হয়েছিল আগের পুষে রাখা ক্ষোভ। এর কারন ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় এলটিটিইকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এলটিটিইর জঙ্গীরা প্রশিক্ষণ পেত ইন্ডিয়ান গোয়েন্দাদের কাছে। ইন্দিরা গান্ধী মারা যাবার পর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন।

সে সময় এলটিটিই বেশ লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। ইন্ডিয়ান অফিসিয়ালদের তোয়াক্কা করত না তারা। তার উপর 'গেরিলা মনোভাব' ও 'সব তামিলদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বীজ' বপন করা শুরু করেছিল ইন্ডিয়ার তামিলনাড়ুতে বসবাসকারী তামিলদের মধ্যেও। রাজীব গান্ধীর প্রশাসন তাই ঠিক করেছিল লাগাম টেনে ধরার। বন্ধ করে দিয়েছিলো অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ । এতেও এল টি টি ই নেতা প্রভাকরণের ঔদ্ধত্য না কমলে পাঠিয়ে দেয়া হয় ইন্ডিয়ান শান্তিরক্ষী বাহিনী। এলটিটিই এটাকে দেখেছিল বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে।

এল টি টি ই ঠিক করে যে নির্বাচন প্রচারণা চলাকালীন সময়ে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করতে হবে কারন এ সময়ে তিনি বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে নিরাপত্তা পাচ্ছেন। আবার প্রধানমন্ত্রী হলে গেলে তাকে ঘিরে শক্ত নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলা হবে; তখন আর তাকে সহজে হত্যা করা যাবে না।

১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে এল টি টি ই নেতা প্রভাকরণ তার চার বিশস্ত যোদ্ধা বেবী সুব্রামানিয়াম , মুরুগান , মথুরাজা এবং শিভারাসানকে নির্দেশ দেন রাজীব গান্ধীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার। বেবী সুব্রামানিয়ামের মাদ্রাজ (এখনকার চেন্নাই) শহরে একটা প্রিন্টিং প্রেস ছিল। সেই সুত্রে সে ইন্ডিয়ান তামিলদের মধ্যে এলটিটিই এর এজেন্ডাগুলো ছড়াত এবং সহানুভুতি আদায় করত।

মুরুগান ছিল একজন গেরিলা প্রশিক্ষক এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। মুরুগান মাদ্রাজে বসবাসকারী তিন তামিল-আরিভু, ভাগ্যনাথান এবং তার বোন নালিনীকে দলে ভিড়ায়। এই তিনজনই আগে ত্থেকেই এল টি টি ইর প্রতি সহানুভুতিশীল ছিল। আরিভুর কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ছিল এবং সে বোমা বানানোতে পারদর্শি ছিল। সুব্রামানিয়াম তাদেরকে বুঝায় যে রাজীব গান্ধীর পররাষ্ট্রনীতির কারনেই শ্রীলঙ্কায় তামিলদের এতো খারাপ অবস্থা।
মথুরাজার পরিচয় ছিল স্থানীয় সংবাদকর্মী ও ফটোগ্রাফারদের সাথে। সে সেখান থেকে হারিবাবু নামে এক তরুণ বেপরোয়া ফটোগ্রাফারকে দলে টানে।

১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারীতে শিভারাসন শ্রীলংকা থেকে মাদ্রাজ আসে অগ্রগতি পর্যাবেক্ষণে। ততোদিনে সুব্রামানিয়াম , মুরুগান ও মথুরাজা আরিভু , ভাগ্যনাথান এবং নালিনীকে পুরোপরি ব্রেইন ওয়াস করে ফেলেছে যে রাজীব গান্ধীর আবার ক্ষমতায় আসা মানে তামিলদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন পুরোপুরি বিলিন হয়ে যাওয়া। শিভারাসন , যে নিজেও একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ , আরিভুকে নির্দেশ দেয় এরকম একটা বিস্ফোরক বানাতে যা লুকিয়ে বহন করা যায়। আরিভু কাজ শুরু করে দেয়।

শিভারাসন র্মাচ মাসে ফেরত যায় শ্রীলঙ্কায়। সেখান থেকে এল টি টি ই আত্মঘাতী স্কোয়াডের দুইজন সদস্য - ধানু এবং সুভাকে নিয়ে আবার মাদ্রাজ আসে। ধানু এবং সুভা দুইজনই শিভারাসনের চাচাতো বোন। মাদ্রাজে এসে ধানু এবং সুভা নালিনীর বাসায় উঠে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শিভারাসন আরিভুকে নির্দেশ দেয় ঠিক কি রকম বোমা লাগবে। আরিভু অল্প দিনের মধ্যেই একটা বোমা বানিয়ে দেয় যা সহজেই একজন মহিলা লুকিয়ে তার শরীরে বেধে নিতে পারবে। মরুগান স্থানীয় একজন দর্জিকে দিয়ে একটি হাতা কাটা জামা বানিয়ে নেয় যেখানে বিস্ফোরকগুলো বেধে নেয়া যাবে। জামা বানানো হলে গেলে আরিভু তার তৈরী করা বিস্ফোরক তাতে ভরে দেয়।

এপ্রিল এর ২১ তারিখ ও মে এর ১২ তারিখ মরুগান হারিবাবু, ধানু এবং সুভাকে নিয়ে দুইটি জনসভায় যায়। দুইজনকে নির্দেশ দেয়া হয় মঞ্চের কাছে যেতে এবং যদি পারা যায় নেতাদের প্রণাম করতে। ধানু দুই যায়গাতেই প্রণাম করতে সফল হয়। মরুগানের নির্দেশে প্রণাম করার ছবি তুলে হারিবাবু।

এবার শিভারাসন আর মরুগান অপেক্ষা করতে থাকে সঠিক সুযোগের। মে মাসের ১৯ তারিখ পত্রিকায় খবর আসে রাজীব গান্ধী শ্রীপেরামবুদুর আসবেন ২১ তারিখে জনসভায় যোগদান করতে। শিভারাসন পত্রিকার একটা কপি নিয়ে আসে নালিনীর বাসায়। ধানু এবং সুভা কে বুঝিয়ে বলে ২১ তারিখে কি করতে হবে। ২০ তারিখে কয়েকবার রিহার্সেল দেয়া হয়।

২১ তারিখ বিকালে শিভারাসন, ধানু , সুভা ও নালিনীকে নিয়ে রওনা হয়। বাস স্ট্যান্ডে এসে মিলিত হয় হারিবাবুর সাথে। হারিবাবুকে এর আগেই বলা ছিল ফুলের মালা নিয়ে আসার জন্য। একসাথে মিলিত হয়ে পাচজন বাসে চড়ে যায় শ্রীপেরামবুদুর। রাত ৮টায় দলটি পৌছে শ্রীপেরামবুদুর সভাস্থলে। ধানুর শরীরে তখন বাধা আরিভুর তৈরী বিস্ফোরক।

তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়গা করে নেয় ভি এই পি পরিবেষ্টনির কাছে। অপেক্ষা করতে থাকে রাজীব গান্ধীর আসার। সাড়ে আটটার সময় আনুসয়া কুমারী নামের একজন মহিলা সাব-ইন্সপেক্টার এসে তাদের নাম ও পরিচয় জানতে চায়। হারিবাবু আনুসয়া কুমারীকে জানায় যে সে একজন প্রেস ক্যামেরাম্যান এবং আজ তার ডিউটি হলো এই মহিলা (ধানু) যখন রাজীব গান্ধীকে মালা পরিয়ে দেবে সেটার ছবি তোলা। আনুসয়া কুমারী তাদের এখান থেকে সরে দাড়াতে বলে কারন রাজীব গান্ধীর আসতে আরও দেরী আছে।

তারা সরে যায়। সুভা এবং নালিনী একটি দুরে যেয়ে বসে , হারিবাবু ও ধানু রেড কার্পেটের কাছে যেয়ে দাড়িয়ে থাকে আর শিভারাসন মঞ্চের কাছে যেয়ে দাড়ায়। ধানুর গতিবিধি এবং চাহুনি দেখে একটু সন্দেহ হওয়াতে আনুসয়া কুমারী তাদের প্রতি নজর রাখতে শুরু করে।

রাজীব গান্ধী ঠিক ১০টায় এসে পৌছান। সমর্থক পরিবেষ্টিত হয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান। অনেক সমর্থক তাকে মালা পরিয়ে দিতে থাকে। একসময় ধানুও এগিয়ে যায়।আনুসয়া কুমারী কি মনে যেন ধানুকে বাধা দেন। রাজীব গান্ধীর নজর পরে সেই দিকে। তিনি আনুসয়া কুমারীকে ইশারা করেন ধানুকে আসতে দিতে।

আনুসয়া কুমারী সরে দাড়ান , ধানু রাজীব গান্ধীর কাছে পৌছে তাকে মালা পরিয়ে দেয়। একটু দূর থেকে এর ছবি তুলে হারিবাবু। মালা পরিয়ে দিয়ে ধানু রাজীব গান্ধীকে প্রণাম করার জন্য নিচু হয় এবং পোষাকের নিচে বাধা ৭০০ গ্রাম ওজনের আরডিএক্স ভর্তি বেল্টটি ফাটিয়ে দেয়। বিস্ফোরণের আঘাতে রাজীব গান্ধীর দেহ দুই মিটার দূরে ছিটকে যায়, মৃত্যু হয় তাৎক্ষনিক।

ধানুর শরীরও ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। মাথা যেয়ে পরে ২৪ মিটার দূরে। আরও মারা যায় চোদ্দজন মানুষ যার মধ্যে হারিবাবু একজন । হারিবাবু হয়তো শুধু জানতো ধানু প্রনাম করে চলে আসবে। হারিবাবুর প্রাণ চলে যায় বিস্ফোরণের আঘাতে কিন্তু তার ক্যামেরায় প্রাণ থেকে যায়। ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা পরে সেই ক্যামেরার ফিল্ম ডেভেলপ করে বিস্ফোরণের ঠিক আগ মুহূর্তের কয়েকটা ছবি পায়।
.
Akash Choudhury Lemon

পঠিত : ৮৪৯ বার

মন্তব্য: ০