Alapon

ইসলামের চার প্রসিদ্ধ ইমাম যেমন ছিলেন...


চার ইমামের জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ট্র্যাজেডির মধ্যে। কাউকে কারাবন্দী করা হয়, তো কাউকে গৃহবন্দী। কয়েকজনকে তো জীবনের শেষ দিনগুলোতে মসজিদে যেতে দেওয়া হয়নি!

চার ইমামের মতপার্থক্য ছিলো অনেক, কিন্তু জীবনের শেষ পরিণতি ছিলো প্রায় এক। জুলুমের শিকার। তারা জালিমদের অত্যাচার ভোগ করেন, কিন্তু অসত্যের কাছে মাথা নত করেননি। সত্যের প্রতি তাঁদের এই দৃঢ়তার ফলে আল্লাহ সত্যকে বিজয়ী করেন।

ইমামগণ প্রত্যকেই প্রত্যেকের সাথে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করতেন। কিন্তু তাঁদের এই ভিন্নমত তাঁদের মধ্যকার সম্মানবোধকে কমায় নি।
ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) প্রধান দুই ছাত্রের একজন ছিলেন ইমাম আবু ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ)। ইমাম আবু হানিফা (রাহিঃ) তাঁর সেই প্রিয় ছাত্রকে ইমাম মালিকের (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে পাঠান জ্ঞানার্জনের জন্য।

অন্যদিকে ইমাম মালিককে (রাহিঃ) আবু হানিফার (রাহিঃ) ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কয়েকটা পাথরের খুঁটি দেখিয়ে বলেন, “আবু হানিফা যদি এই খুঁটিগুলোকে কাঠের খুঁটি প্রমাণ করতে চান, তাহলে তোমরা তাঁর যুক্তি শুনে মেনে নিতে বাধ্য হবে।”

ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন ইমাম মালিকের (রাহিঃ) ছাত্র। আবার ইমাম শাফে’ঈর (রাহিঃ) ছাত্র ছিলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)।

দুই মাজহাব যাদের নামানুসারে তাঁদের একজন ছিলেন শাফে’ঈর (রাহিঃ) শিক্ষক আর আরেকজন তাঁর ছাত্র! একই সময়ে শাফে’ঈর (রাহিঃ) আরেকজন শিক্ষক ছিলেন ইমাম মুহাম্মহ ইবনে হাসান আশ-শায়বানী (রাহিমাহুল্লাহ), যিনি আবার ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) অন্যতম প্রধান ছাত্র ছিলেন।

ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) ছাত্র ইমাম আশ-শায়বানীর (রাহিঃ) সান্নিধ্যে ইমাম শাফে’ঈ কাটান তিনবছর, ইমাম মালিকের (রাহিঃ) সান্নিধ্যে কাটান ছয় বছর।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে (রাহিঃ) ইরাকে রেখে ইমাম শাফে’ঈ (রাহিঃ) জীবনের শেষদিকে মিসর চলে যাবার সময় বলে যান, “ইরাকে আমার চেয়ে যোগ্য একজনকে রেখে গেলাম।”

অন্যদিকে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে (রাহিঃ) একজন জিজ্ঞেস করলেন, “রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো বলেছেন প্রতি একশোবছরের প্রারম্ভে আল্লাহ একজন মুজাদ্দিদ পাঠান। আপনি কি তাহলে এই শতকের মুজাদ্দিদ?”
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিঃ) বলেন, “না। উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন প্রথম শতকের মুজাদ্দিদ আর আমি আশা করি এই শতকের মুজাদ্দিদ হলেন ইমাম আশ-শাফে’ঈ (রাহিঃ)।”

ইমাম আশ-শাফে’ঈ (রাহিঃ) ইন্তেকালের পর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিঃ) শাফে’ঈর (রাহিঃ) ছেলেকে বলেন, “আমি প্রতিদিন রুটিন মাফিক ছয়জন মানুষের জন্য দু’আ করি। তাঁর মধ্যে একজন হলেন তোমার বাবা।”

যারা ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) বিরোধিতা করতো, তাঁদের জন্য তিনি দু’আ করতেন- “হে আল্লাহ! আমাদের দ্বারা যদি কেউ বিরক্ত হয়, আমাদের হৃদয়কে তাঁদের জন্য উন্মুক্ত করে দিন।”

একবার এক ভরা মজলিশে একজন উঠে জিজ্ঞেস করলো- “আপনি কি শাফে’ঈ?” ইমাম শাফে’ঈ (রাহিঃ) ‘হ্যাঁ’ বললে লোকটি বলে উঠলো- “তুমি একজন নিকৃষ্ট পাপী।” ইমাম শাফে’ঈ (রাহিঃ) তৎক্ষণাৎ দু’আ করলেন, “ইয়া আল্লাহ! লোকটি যা বললো তা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাকে ক্ষমা করুন। আর যা বললো তা যদি মিথ্যে হয় তাহলে মিথ্যে বলার জন্য তাকেও ক্ষমা করুন।”

একদিন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিঃ) দেখলেন তাঁর কিছু ছাত্র তখনকার সময়ের আরেকজন শিক্ষক ইমাম আল-কুরাইবীর কাছে পড়া শেষে বাসায় ফিরছে। ছাত্ররা ইমাম আহমদকে (রাহিঃ) দেখে ভাবলো, তিনি যদি জানতে পারেন যে, তাঁকে ছাড়াও অন্যদের কাছে তারা পড়তে যায়, তাহলে নিশ্চয় তিনি রাগ করবেন। তারা ভয়ে কাচুমুচু করছিলো। ইমাম আহমদ (রাহিঃ) ছাত্রদের দিকে এগিয়ে বললেন, “তোমরা কী শিখে এসেছো? আমাকেও শেখাও।”

ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) মা ছিলেন খুবই ধার্মিক। সুরালো ওয়াজিদের তিনি পছন্দ করতেন। কুফার সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়াজি ছিলেন আমরূদ বিন জারকা। ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) মা ছিলেন তাঁর ভক্ত। কোনো ফতোয়া জানার থাকলে তিনি আমরূদের কাছে লোক পাঠিয়ে জেনে নিতেন।

একবার ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) মায়ের একটা ফতোয়া জানার প্রয়োজন হলো। তাঁর কাপড়ে রক্ত লেগে ছিলো। এই কাপড় পরে কি তিনি মসজিদে যাবেন? ইমাম আবু হানিফা (রাহিঃ) ফতোয়া দিলেন। কিন্তু, ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) ফতোয়া মায়ের পছন্দ হলো না। মা বললেন, “আমাকে আমরূদের কাছে নিয়ে যাও। আমি তাঁর কাছ থেকেই ফতোয়া জেনে আসবো।”

মাকে খচ্চরের পিঠে বসিয়ে ইমাম আবু হানিফা (রাহিঃ) লাগাম টেনে চললেন আমরূদের বাড়ির দিকে। মজার ব্যাপার হলো, আমরূদ ছিলো ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) ছাত্র! আমরূদ নিজেই এই ফতোয়া জানতেন না। ইমাম আবু হানিফা (রাহিঃ) তাঁকে ফতোয়া বলে দেন, আমরূদ সেই ফতোয়া ইমাম আবু হানিফার (রাহিঃ) মাকে বললে তিনি এবার সন্তুষ্ট হলেন। মায়ের মনে আমরূদের প্রতি যে ভক্তি ছিলো, ইমাম আবু হানিফা (রাহিঃ) সেটা ভাঙ্গেন নি। নিজের শান শওকতও বলে বেড়াননি। “আপনি যার কাছে ফতোয়া জানতে গেলেন, সেই লোকটি আমার ছাত্র” এমনটাও বলেননি।

ইমাম মালিকের (রাহিঃ) উল্লেখযোগ্য একটা বৈশিষ্ট্য ছিলো, তিনি যা জানতেন না তা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতেন- ‘আমি জানি না’। কোনো প্রকার ভণিতা করতেন না, লোকে কী বলবে এই চিন্তায় ভুল উত্তর দিতেন না।

একবার মরক্কো থেকে এক লোক দীর্ঘ ছয় মাস সফর করে তাঁর কাছে চল্লিশটি প্রশ্ন নিয়ে আসলো। তিনি চারটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন আর বাকিগুলোর ক্ষেত্রে বললেন, “লা আদরী- আমি জানি না।” লোকটি বেশ অবাক হলো। এতো দূর থেকে সে আসলো, এখন কি খালি হাতে ফিরে যাবে? ইমাম মালিককে (রাহিঃ) অনুরোধ করে বললো, “দেখুন, আমি তো অনেক দূর থেকে এসেছি, আপনি যদি উত্তর না দেন তাহলে যারা আমাকে পাঠিয়েছে তাদেরকে গিয়ে কী বলবো?” ইমাম মালিক (রাহিঃ) সোজাসাপটা বলে দিলেন, “তাদেরকে গিয়ে বলবেন, ইমাম মালিক এগুলোর উত্তর জানেন না।”

ইমাম শাফে’ঈ (রাহিঃ) বিতর্কে পারদর্শী ছিলেন। বিতর্কে কোনোদিন তাঁকে কেউ পরাজিত করতে পারেনি। বিতর্ক শুরুর আগে তিনি দু’আ করতেন- “হে আল্লাহ! আমাদের অন্তর সত্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিন। আমাদের মধ্যে যে পক্ষ সত্যের উপর, তাঁকে বিজয়ী করুন।”

সত্য সন্ধানে তিনি এতোটাই অনুসন্ধিৎসু ছিলেন যে, বিতর্কে বিজয়ী হবার চেয়ে সত্য উন্মোচনের ব্যাপারে ছিলো তাঁর বেশি মনোযোগ।

একবার আবু ইউনুস সিদ্দি নামের একজনের সাথে তিনি বিতর্ক করেন। বিতর্কে পরাজিত হয়ে আবু ইউনুস রাগে-ক্ষেভে মসজিদ থেকে বের হতে চাইলে ইমাম শাফে’ঈ (রাহিঃ) তাঁর হাত ধরে বলেন, “যদিও আমরা কিছু ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করি, তাই বলে কি আমরা দ্বীনি ভাই নয়?”

প্রতিপক্ষকে দলিল-যুক্তি দিয়ে যেভাবে পরজিত করতেন তেমনি ভালোবাসা দিয়ে তাঁদের মন জয় করে নিতেন।

আরিফুল ইসলাম

পঠিত : ৬৫৩ বার

মন্তব্য: ০