Alapon

বিজয়ী জাতির পরাজিত চেহারা...


আমার কাছে এক বন্ধু আসল। তার চোখে-চেহারায় ছোপ ছোপ বিস্ময়। বুকবিদ্ধ বিষন্নতা তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। যন্ত্রণায় সে স্থির দাঁড়াতে পারছে না। হেলে-দুলে পড়ি-মরি করছে।

কেন?

বৈরুতের নির্মম হত্যাযজ্ঞ তাকে নির্বাক করে দিয়েছে, অস্থির করে তুলেছে। সবরা ও সাতিলায় হাজারে হাজারে মুসলিম লাশ হয়েছে, রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে। নির্বিচারে শিশু, নারী, বৃদ্ধদের হত্যা করা হয়েছে নির্ভয়ে, নির্লজ্জ্বভাবে। গুড়িয়ে দিয়েছে ঘর-বাড়ি। নির্মমভাবে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে তাদের শেষ আশ্রয়টুকুও!

আরবরা কোথায় তাহলে?

আরবরা তো বটেই সমগ্র মুসলিম বিশ্ব নীরব, নিশ্চুপ। যেন কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে তাদের মাঝে। কোথাও কোনো রা শব্দ নেই। নেই কোন হৃদকম্পন, প্রাণের তড়পানি। আর সভ্য পৃথিবী নির্বাক তাকিয়ে ছিলো শুধু। না দিয়েছে কাউকে আশ্রয় না কোন আশ্রিতকে সরিয়েছে! ‘আচ্ছা এসব কি তুমি দেখনি? শোননি??’

আমি জবাব দেই, ‘শুনেছি তো, কেন শুনবো না? এই নির্মম গণহত্যা দেখে দেখেই তো কোনোরকম বেঁচে-বর্তে আছি। হৃদয় ফেঁটে যায়। শিরা-উপশিরা নেচে ওঠে, রক্ত লাফিয়ে ওঠে। আরবদের পরাজয় আর মুসলমানদের অক্ষমতা দেখতে দেখতে মন বিষিয়ে ওঠে।’

তার আগেও মুসলিম দেশগুলোতে যুদ্ধের দামামা বেজেছে। হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত শহর বিরান হয়েছে। শহরের বাসিন্দাদের লাশের মিছিল গিয়েছে। মসজিদ গুড়ানো হয়েছে। নামাজরত মুসল্লিকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মুসলিম মা-বোনের ইজ্জ্বত ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। আব্রæহীন হয়েছে হাজার হাজার মুসলিম রমণী। কিন্তু কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই। নেই কোন প্রতি উত্তর। কি আরব কি মুসলিম, কি প্রাচ্যে কি পাশ্চাত্যে সবাই নীরব, নির্বিকার। অত্যাচারী নিপীড়কের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার কেউ নেই। বুক চেতিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবার কোন মর্দে মু’মিন নেই। হুংকারে-হুংকারে কাঁপিয়ে তোলার মতো ব্যাঘ্রব্যক্তিটা আজ কোথায়? দুর্বল ও নিপীড়তদের পাশে এসে দাঁড়ানোর সাহসী কোন মুসলিম কি নেই? সর্বত্র অদ্ভুত কবরের নীরবতা! রাতের গভীর নিস্তব্ধতা চেপে বসেছে পুরো মুসলিম বিশ্বজুড়ে। চারদিকে নিঃসীম শূন্যতা। কোথাও কেউ নেই!

তবে মাঝে মাঝে তাদের আওয়াজ শুনতে পাবে। তাদের বিকট চিৎকার তোমার কান ঝালাপালা করে তুলবে। সেই চিৎকার কোন শত্রæর বিরুদ্ধে নয়; নিজেদের বিরুদ্ধেই। নিজেরই আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে তাদের ভোঁতা হাতিয়ার! আর যদি কখনো তাদের বেশ চেতনাদীপ্ত হয়ে বীরদর্পে লড়ে যেতে দেখ, বুঝে নিবে অন্য কোন মুসলিম শাসককে উৎখাত করতে সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মনে হয় যেন তারা সাহাবাচরিত্রের বিপরীত হওয়ার জন্য গোঁ ধরে বসেছে। কারণ, সাহাবারা ছিলেন, “কাফেরদের প্রতি অতিশয় কঠোর আর নিজেদের মাঝে পরম কোমল” (সূরা : ফাতহ : ২৯) অপরদিকে এরা নিজেদের মাঝে খুবই হিংস্র, অথচ শত্রæদের প্রতি সদয়-সহৃদয়, মু’মিনদের প্রতি খড়গহস্ত, কাফেরদের জন্য বিনয়াবনত। যেন কোরআনে বর্ণিত ইহুদিদের গুণাবলি তাদের মুগ্ধ করে রেখেছে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “তাদের নিজেদের মাঝে অর্ন্তদ্বন্দ্ব অতি তীব্র, আপনি মনে করেন তারা ঐক্যবদ্ধ। আসলে তাদের হৃদয় বিক্ষিপ্ত। কারণ, তারা এক নির্বোধ জাতি।” (সূরা : হাশর, আয়াত: ১৪)

এবার আমার বন্ধু হকচকিয়ে বলে ওঠে, ‘কিন্তু এই নিকষ কালো অন্ধকারের কি কোন অন্ত নেই? দীর্ঘ এই রাতের অবসান হবে কি? রাতের আঁধার ছিঁড়ে কি সকালের কোমল আলোয় পৃথিবী উদ্ভাসিত হবে না? এই জাতির কি এখনো আপন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিনে নেওয়ার সময় হয় নি? আর কত পথ চললে সৎ পথে ফিরে আসার উপলব্ধি হবে? এখনো কি শত্রæর বিরুদ্ধে একযোগে লড়ে যাওয়ার সময় হয়নি? কখন একই মঞ্চে এসে সমস্বরে গেয়ে উঠবে বিজয়ের গান? আর কতকাল নিজেদের গর্দান নিজেরা কাটব? এখনো বিস্মৃতি থেকে জেগে উঠার সময় হয়নি? এখনো কি এই জাতির পরাজয়ের গ্লানি মুচে ফেলে সামনে চলার সময় আসেনি? আর কতকাল এই নিঃসীম অন্ধকারে পরাজয়ের ব্যর্থতা আর গ্লানি নিয়ে পথ চলবে? কখন মিলবে জয়ের দেখা? এই দুর্দিনের কি অবসান হবে না? আলোয় স্নাত সোনালি দিনগুলো কি আর আসবে না? ইয়ারমুখের যুদ্ধে ত্রাতা হয়ে আসা কোন খালিদ কি আর আসবে না? কাদেসিয়া প্রান্তরের দুর্বিনীত বীর সেনানী সা’দের আবির্ভাব আর হবে না? আজনাদাইনের মতো কোন আমির কি হুংকার দিবে না? কিংবা স্পেনের মাটিতে তারেক বিন যিয়াদের দেখা মিলবে না? হিততীনের ময়দানে কি কোন সালাহুদ্দিনের জন্ম হবে না? কিংবা আইনে যালুত কি কনস্টান্টিনোপল পদানত করা কুতুজ ও মুহাম্মদ ফাতিহের জন্ম দিতে মুসলিম মায়েরা কি বন্ধ্যা হয়ে গেছে?

আমি স্থির-শান্ত কণ্ঠে বললাম, ‘হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। এত ভেঙ্গে পড়লে কি চলে? হতোদ্যম নয়; আমাদের হতে হবে আরও শক্ত মনোবলশালী। সবকিছুতেই আল্লাহ তা’য়ালার একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম অলঙ্ঘনীয়। তাতে কোন হেরফের হয় না। আঁধার কেটে যাবে। অবশ্যই সকালের রাঙ্গা আলোয় উদ্ভাসিত হবে প্রতিটি জনপদ, পুরো বিশ্ব। আর শেষ রাতের অন্ধকার হয় ঘন জমাটবদ্ধ। তারপর ধীরে ধীরে ফর্সা হয়ে ওঠে, ভোরের আলো ফোটে, অরুণোদয় হয়। এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। তাই আমাদের আল্লাহর নিয়মের প্রকৃতি মাথায় রেখেই চলতে হবে। নিজেদের কর্মপ্রচেষ্টা ধরে রাখতে হবে। কিছুতেই পিঁছু হঠা যাবে না। খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। সন্তর্পণে এগুতে হবে। আর দুইটা ব্যাপার অবশ্যই মনে রাখতে হবে।’

আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভী...

পঠিত : ৫১০ বার

মন্তব্য: ০