Alapon

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী : জীবন ও তৎপরতার সংক্ষিপ্ত রূপ...


সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে একজন মহত্তম ব্যক্তিকে তুলে ধরা—অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। তারপরও কিংবদন্তী মহাপুরুষ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে, ছোট পরিসরের একটি আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছিলাম। কারণ, মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে তাঁর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। যদিও অল্প কথায় এরকম একজন ব্যক্তিত্বকে চিত্রিত করা একটি দুঃসাহসিক বিষয়। তারপরও আগ্রহী পাঠকরা এ থেকে উপকৃত হবেন বলে আশা করি।

১) শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ভারতের দিল্লীতে—১৭০৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম গ্রহন করেন। ১৭৬৩ সালের ২০ আগস্ট, তাঁর মৃত্যু হয়।

২) জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রতি শৈশব থেকেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ ভীষণ রকম অনুরক্ত ছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে দিল্লীতে তাঁর পিতা শাহ আবদুল রহিম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশণা লাভ করেন।

৩) কুরআনের পাশাপাশি তিনি আরবি ও ফারসি ব্যাকরণ, সাহিত্য এবং উচ্চস্তরের দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, অতীন্দ্রিয়তা ও আইনশাস্ত্রের উপর পাঠ নেন। মাদ্রাসায়ে রহিমিয়াতে তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৭১৮ সালের শেষ দিকে পিতার মৃত্যুর পর, তিনি মাদ্রাসার প্রধান হন এবং ১২ বছর যাবত শিক্ষাদান করেন।

৪) শিক্ষা জীবনের এক পর্যায়ে তিনি হাদিস শাস্ত্রে অধিক জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। সেই লক্ষ্যে ১৭২৪ সালে, তিনি প্রথমে হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমন করেন। এরপর হেজাজে আট বছর অবস্থান করে, আবু তাহের বিন ইবরাহিম আল কুর্দি আল মাদানির মত পন্ডিতদের কাছ থেকে হাদিস ও ফিকহ শিক্ষালাভ করেন। একই সময়ে তিনি মুসলিম বিশ্বের আরো বিভিন্ন প্রান্তের লোকের সংস্পর্শে আসেন এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশের অবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। অর্জিত এ সকল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি ‘ফুয়ুদ আল হারামাইন’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন।

৫) ১৭৩২ সালে, তিনি পুনরায় দিল্লীতে ফিরে আসেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনের বাকি সময় এখানেই তাঁর লেখালেখি ও কর্ম তৎপরতা চালিয়ে যান।

৬) ১৭০৭ সালে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতে মুসলিম শাসনের বিপর্যয় শুরু হয়। অর্থাৎ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী এই পরিস্থিতি সামনে রেখেই তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন।

৭) সেসময় তাঁর প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল—উপমহাদেশের মুসলিম সমাজকে ইসলামের মূল আদর্শের দিকে ধাবিত করা। আর এই কাজে ব্যাপক জ্ঞান-গবেষণা, লেখালেখি ও রাজনৈতিক তৎপরতাই ছিল তাঁর কর্মকাণ্ডের সারবস্তু। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল— দিল্লীর মসনদকে যাবতীয় দুর্বল শাসন থেকে মুক্ত করে ইসলামের অনুকূল শাসন ব্যবস্থা নিয়ে আসা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন মতভেদে আক্রান্ত মুসলিম সমাজকে একটি অভিন্ন ও মৌলিক চিন্তার আলোকে সমবেত করা। চতুর্থত, ব্রিটিশদের উত্থানকে রুখে দেয়ার জন্য জ্ঞানভিত্তিক এমন একটি পরম্পরা তৈরী করা : যাতে করে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবেও তাদের পরাস্ত করা সম্ভব হয়। সর্বোপরি ভারতের মুসলিম সমাজের উপরে আরোপিত সব ধরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিপর্যয় রোধকল্পে স্বতন্ত্র্য শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা।

৮) আল কুরআনের ব্যবহারিক মূল্য প্রদর্শন এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর সামগ্রিক সংস্কার প্রস্তাবের মূল বুনিয়াদ। মানুষ যদি জীবনের অধিকাংশ সময় অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের পথেই সংগ্রাম করতে থাকে, তবে সে কখনোই জীবনের বৃহত্তর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের জন্য কাজ করতে পারবেনা—শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী তা ভালোভাবেই জানতেন। এজন্য সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। যাতে উচ্চশ্রেণীর অতিরিক্ত ভোগ-বিলাসের দরুণ মধ্য ও নিম্নশ্রেণীর মানুষরা নিষ্পেষিত না হয়। জীবিকার জন্য সব শ্রেণীর মানুষ যদি একটি ভারসাম্যে উপস্থিত হয়, তবে জীবনের মূল উদ্দেশ্যের দিকে আলোকপাত করা সবার জন্যই সহজতর হবে বলে তিনি মনে করতেন।

৯) কুরআনের আনীত শিক্ষা ও আদর্শকে তিনি সর্বাগ্রে গুরুত্বারোপ করতেন। যদি কুরআনের প্রস্কাবিত আদর্শের আলোকে সমাজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যায়, তবে
যেকোনো যুগে, যেকোনো সমাজেই নব জাগরণের সূচনা অবশ্যম্ভাবি হয়ে উঠবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

১০) চারটি মৌলিক নীতির আলোকে তাঁর কর্মপ্রক্রিয়া অগ্রসর হত। যথা : ১) তাহারাত বা পবিত্রতা, ২) মহান প্রতিপালক আল্লাহ’র সমীপে বিনয় ও ভীতি, ৩) সংযম ও ৪) ন্যায়নিষ্ঠা।

১১) শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে তিনি দিল্লী থেকে শাহজাহানাবাদে তাঁর মাদ্রাসাকে সরিয়ে নেন। এখান থেকেই তাঁর প্রচুর শিষ্য ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মত মানুষ তৈরী হতে থাকে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পর, এই মাদ্রাসার আদর্শেই প্রখ্যাত দেওবন্দের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।

১২) শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর রচিত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ কে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করা হয়। এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন—“যদি কোনো মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সভ্যতার বিকাশধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে তাদের শিল্পকলা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে। তারপর যদি শাসকগোষ্ঠী ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ও ঐশ্বর্যের মোহে আচ্ছন্ন জীবনধারা বেছে নেয়, তাহলে সেই আয়েশী জীবনের বোঝা মজদুর শ্রেণীর উপরে এসে পড়ে। ফলে সমাজের অধিকাংশ মানুষ মানবেতর পশুর জীবনে যাপনে বাধ্য হয়। গোটা সমাজ জীবনের নৈতিক কাঠামোই তখন বিপর্যস্ত হয়। সবাইকে তখন অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থেকে জীবন প্রক্রিয়া চালানোর জন্য বাধ্য করা হয়। তখন মানুষকে রুটি-রুজীর জন্য পশুর মতই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। মানবতার এ চরম নির্যাতন ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহ’তায়ালার পক্ষ থেকে কোনো পথ নির্দেশ অবশ্যই এসে থাকে। অর্থাৎ, স্রষ্টা নিজেই বিপ্লবের আয়োজন করেন।”

১৩) শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী হাদিস গ্রন্থ সমূহের মধ্যে ইমাম মালিক প্রণীত ‘মুয়াত্তা’কে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন। কারণ, ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তার সূতিকাগার হিসেবে খুলাফায়ে রাশেদার যুগে মদীনার প্রাধান্য ছিল প্রশ্নাতীত।পরে হযরত আলী (রাঃ) ইরাকের কূফায় তাঁর রাজধানী সরিয়ে নেন। উমাইয়া শাসনামলে তা সিরিয়ার দামেস্কে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ইমাম মালিক সরাসরি মদীনাকে কেন্দ্র করে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থটি প্রণয়ন করেন। ফলে এর বিশুদ্ধতা ও তাৎপর্যকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ অপরাপর হাদিস গ্রন্থসমূহের আগে স্থান দিতেন।

১৪) জীবনের শেষদিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীকে রাজনৈতিকভাবে একটি বড় ভূমিকা নিতে হয়। সেসময় তিনি মারাঠাদের অব্যাহত শক্তিবৃদ্ধি থেকে দিল্লীর শাসনকে নিরাপদ করার দিকে মনোনিবেশ করেন। এজন্য আহমদ শাহ আবদালীকে পত্র লিখে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানান। ফলে ১৭৬১ সালে, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পরাস্ত করে আহমদ শাহ আবদালী দিল্লীকে নিরাপদ করেন।

১৪) তাঁর চিন্তা ও জ্ঞান ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ শাস্ত্র সহকারে পাশ্চাত্যের অনেক জ্ঞান সম্পর্কেও বিশদ ধারণা রাখতেন। ফার্সি ভাষায় কুরআনের তরজমা করে, তৎকালীন অনেক ধর্মীয় নেতাদের ভ্রান্ত চিন্তার অপনোদন ঘটিয়েছিলেন। এছাড়া হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমর (রাঃ) এর খিলাফত নিয়ে শিয়া মতাবলম্বীদের ভুল প্রচারকে মোকাবেলার জন্য ‘ইযালাতুল খিফা’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। অন্যদিকে শরীয়তের মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে উত্তম ফয়সালা নির্ধারণের জন্য ‘আল ফাউযুল কবীর ফি উসুলিত তাফসীর’ নামক একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া আরো অনেক বিষয়ে তাঁর প্রচুর লেখা ও গবেষণা রয়েছে। তার মাঝে আল কাউলুন নাসীর, আল আকিদাতুল হাসানাহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

১৫) মৃত্যুর আগে তাঁর তৎপরতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি প্রচুর শিষ্য তৈরী করে যান। তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আযীয—প্রায় ৬০ বছর ধরে উপমহাদেশে সেই লক্ষ্যে অব্যাহতভাবে কাজ করেন। শাহ শহীদ ইসমাইল, শাহ ইসহাক ও আহমেদ ব্রেলভী তাঁরই চিন্তা ও আদর্শের উপযুক্ত সৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হন। এছাড়া আরো অনেক ইসলামী স্কলার ও পুনর্জাগরণ কর্মীদের উপরে তাঁর জীবন ও তৎপরতার প্রভাব ছিল অসামান্য।

শেষ কথা হল—ইউরোপীয় রেঁনেসা ও শিল্প বিপ্লবের শক্তি সমৃদ্ধ চতুর ব্রিটিশরা যদি এই আন্দোলনের বিরোধিতা না করত, তবে উপমহাদেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর চিন্তা ও সংস্কার আন্দোলন অবশ্যই চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করত। অবশ্য ব্রিটিশদের অব্যাহত বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রভাব সর্বাংশে ম্লান হয়নি। বরং, ১৯০ বছরের শাসনামলে ইংরেজরা যে বারংবার বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে; তাঁর অন্যতম কারিগর ছিলেন—শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। আজ অনেক ধরণের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার শিকার হলেও, এই উপমহাদেশে মুসলমানদের স্বতন্ত্র্য শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনসহ আরো অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তার সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাই। এর মাস্টার মাইন্ড হিসেবে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর কৃতিত্ব অপরিসীম। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার অব্যাহত নৈতিক স্খলন ও ভারসাম্যহীনতার সমাধানকল্পে তাঁর জীবন ও তৎপরতা নিয়ে পর্যালোচনার গুরুত্ব অপরিসীম।

সহায়ক গ্রন্থাবলী :
১) শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা
২) Shah Waliullah al-Dehlawi : Thoughts and Contributions by Kunju, Saifudheen
৩) Muslim Philosophy and Philosophers by Mohammad Sharif Khan, Mohammad Anwar Saleem
৪) উইকিপিডিয়া।

আরেফিন আল ইমরান

পঠিত : ৮৩১ বার

মন্তব্য: ০