Alapon

গল্পটা এখন তেতাল্লিশে...


মালেকের রক্তের ঘ্রাণ তখনো বাতাসে জীবন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের বারান্দায় কিছু যুবকের পায়চারী। কপালে ভোরের কুয়াশার মতো বিন্দু বিন্দু জল। দুশ্চিন্তার ভাজের অলিগলি পথ পেড়িয়ে থুতনিতে এসে মাটিতে আছড়ে পড়ছে রুপালি ঘামের বিন্দু। একটি নবজাতকের আসার অপেক্ষা . . .

৭৭'র আজকের দিনটাই। কেঁদে উঠলো শিশুটি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের কান্নার আওয়াজ বেজে ওঠে নবজাতকের কন্ঠ থেকে। কিন্তু এ কান্নার অর্থ শুধুই সুখের ছিলোনা। এ কান্না একটি স্বপ্নের চিৎকার। এ কান্না মসজিদের পাশে শুয়ে থাকা দ্রোহের কবির বিদ্রোহী বাসনার প্রতিচ্ছবি। এ কান্না মালেকের কফিনের মরচেধরা পেরেকের ধারালো প্রতিশোধ। এ কান্না উচ্ছ্বল তারুণ্যের স্বপ্নিল ক্যানভাস . . .

ছয় জন যুবক কোলে তুলে নিলো শিশুটিকে। ভরণপোষণ, আদরযত্ন দিয়ে গড়ে তুলতে হবে তাকে। মীর বাড়ীর সাহসী এক তরুণ কাসেমের বুকে মাথা রাখলো শিশুটি। পরম মমতায় বুকে আগলে শপথ নিলো কাসেম। শিশুটির জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী নয় বরং এই শিশুটিকে দিয়েই বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলা হবে। যার স্পর্শ মোহিত করবে তারুণ্যের উদ্দীপ্ত মূহুর্ত গুলোকে। ঘন কালো অন্ধকারে টিমটিম করে আলো হয়ে পাশে দাঁড়াবে পথ তালাশি পথিকের। শিশুটি বেড়ে উঠছে চারপাশে বাড়ছে মমতার হাত . . .

শৈশবের দুরন্তপনায় ছুটে চলছে মাঠঘাট থেকে অলিগলিতে। ফুটফুটে শিশুটির প্রতি দরদ বাড়ছে মানুষের। অসুন্দরের পাশ কাটিয়ে মায়াজালে বাঁধছে একেরপর এক মানুষকে। শিশুর সরলতা আর কোমলতায় মুগ্ধতা ছুঁয়ে দিচ্ছে সবার মনে। আস্তে আস্তে বাড়ছে তার দৈহিক গঠন। কৈশোরের আবিস্কারের নেশায় জীবন পেয়েছে গতিময়তা। শহর, গ্রাম, বন্দর, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে কিশোরের নাম। তার বুদ্ধিদীপ্ত চালচলন যেমনি ভাবে সবার নজর কেড়েছে ঠিক তেমনিভাবে চক্ষুশূল হয়েছে মূর্খতা আচ্ছন্ন কিছু মানুষের। শুরু হলো উচ্ছলতা ভরা কিশোরকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা . . .

পৃথিবীতে নাকি কিছু তৎপরতাকে পূর্ণতা দিতে পেছন থেকে অপতৎপরতার জন্ম হয়। ছেলেটিকে দমাবার চেষ্টাও সেই একই সূত্রে রুপান্তর হলো। মুর্খামির আঘাত গুলো সহ্য করতে করতে ছেলেটি এখন তারুণ্যের ঝলমলে রেখা ছুঁয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ইয়াং স্টারের নামটি তার। যৌবনের রঙ্গিন ভাবনা গুলো ছড়িয়ে দিয়েছে সবার মনে। সমাজটাকে সভ্যভুক্তির এক আপ্রাণ চেষ্টা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। একই সাথে যুবকটি নিজেও ঘুম কেড়ে নিয়েছে কিছু মূর্খ বিবেকের। তারা আর এক পা সামনে আগাতে দিতে চায়না সম্ভাবনার এই ফেরিওয়ালাকে . . .

শুরু হলো দাবিয়ে দেবার চেষ্টা। সুঠাম দেহটা টেনে হিচড়ে রাস্তায় নামিয়ে আনা হলো। আঘাতে আঘাতে থেঁতলে দিলো পরিপাটি দেহটাকে। এক একটা অঙ্গ নিস্তেজ করে দেয়া হলো লগি-বৈঠার আঘাতে। অবশ দেহের উপর চললো উন্মত্ত নৃত্য। এরপর একেএকে হাত হারালো, পা হারালো এমনকি চোখ গুলোও তুলে নিলো! বুলেটের দাবানলে বুকের ফুসফুসটাও বেড়িয়ে এলো। তবু যুবকের মৃত্যু হয়নি। বিশ্বাস করুন, তবুও যুবক মরেনি, ওরা তাকে মারতে পারেনি। আহত যৌবন তবু তাকে হতাশ করেনি। সে জানে তার পূর্বসূরিরা এর চাইতেও তীক্ষ্ণ সময়ের বুকচিরে স্রোতহীন সমুদ্রে ঢেউ তুলেছে। এখন সেই সমুদ্র আরো উত্তাল। তাই এমনটাই স্বাভাবিক। তীরের কাছাকাছি এলে ঢেউ গুলো একটু বেশীই গর্জে ওঠে . . .

মালেকের সেই রক্তের ঘ্রাণ এখনো বাতাসে জীবন্ত। তবে আগের চেয়ে ঘ্রাণ তীব্রতা পেয়েছে বহুগুণ। এক একটি ফোঁটা রক্ত ঝড়িয়ে বেড়ে উঠেছে দেহটা। সময়ের ঘাতপ্রতিঘাত সহ্য করে জীবনের পরিণত সময়ে এসে আজ দাঁড়িয়ে সেই ছোট্ট শিশুটি। স্বপ্নজয়ের দুর্বার পথচলায় আজো অপ্রতিরোধ্য তার হিম্মত। কোটি প্রাণের নিরন্তর ভালোবাসা প্রতিটি মূহুর্তে শিহরিত করে অন্তর আত্মা। অকৃত্রিম এই ভালোবাসার দায়বদ্ধতা থেকেই তাকে বাঁচতে হবে শতাব্দীর থেকে শতাব্দী। মূর্খতার ফুৎকারে এ আলো নিভে যাবার নয়। ৪৩ বছরের পথচলায় চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সে শিখে নিয়েছে এক'শ একটা উপায় ।

- স্বার্থান্বেষী

পঠিত : ৫৩৮ বার

মন্তব্য: ০