Alapon

আপনি জাতীয় জাদুঘরে কেন যাবেন...?


ঢাকা শহরে এমন একটা জায়গা আছে যেখানে গেলে আপনি অভিভূত না হয়ে পারবেন না।আমি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কথা বলছি।সকালে আজ হঠাৎ করেই জাতীয় জাদুঘরে চলে গেলাম। মাত্র বিশ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করতেই মূল ভবনের প্রবেশ পথের দুই পাশে দুটি কামান দেখতে পেলাম।

২০ মার্চ ১৯১৩ সালে বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এই জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন এবং ১৯৮৩ সালে এটি জাতীয়করণ করা হয়।শাহবাগের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরের মোট চার তলার মধ্যে প্রথম তিনটি তলা প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত। চতুর্থ তলা নারীদের জন্য নামাজের স্থান(পুরুষদের নামাজের জন্য সুব্যবস্থা আছে)।

১ম তলা শুধুই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অবস্থান, মুদ্রা, জীবজন্তু, বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ, পোশাক,প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি আছে।
আমি ১ম তলায় গিয়ে প্রথমে বিশাল একটা বাংলাদেশের মানচিত্র দেখতে পেলাম। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার অবস্থান বৈদ্যুতিক লাইটের মাধ্যমে খুব ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে। তারপর যে কক্ষে প্রবেশ করলাম সেটা শুধুই সুন্দরবন।সুন্দরবনের যাবতীয় বাস্তুসংস্থান এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী দেখে মনে হবে বাস্তবিকই সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
তারপর এই তলাতেই দেখলাম বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ এবং ফল,মসলার গাছ এবং মসলা,শাক-সবজির গাছ,ওষুধি গাছ,কাঠ উৎপাদনকারী গাছ ইত্যাদি।তারপর গেলেই দেখতে পেলাম বাংলাদেশের মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র, বাদ্যযন্ত্র,পোশাক,আসবাবপত্র। এর আগে অবশ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের গ্যালারী দেখলাম। বিশেষ করে হাতির বিবর্তন সম্পর্কে চমৎকার ধারণা পেলাম। আর করাত মাছ এবং নীল তিমির বিশাল কঙ্কাল সবাইকে অভিভূত করল।
সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশের বিশেষ করে যারা ঢাকাতে বড় হয়েছে তাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা আছে। তারা যে ভাত খায় বা রুটি খায় সেই ভাত কোন গাছ থেকে আসে সেই ধান গাছটা চিনতে হলেও অন্তত জাতীয় জাদুঘরে যাওয়া উচিত। এটা তো মাত্র একটা উদাহরণ দিলাম। এমন অনেক কিছু আছে যেটা আমরা সবসময় ব্যবহার করি বা আহার করি কিন্তু এটা কোথা থেকে আসে এটা জানি না।জানতে হলে জাতীয় জাদুঘরে যেতেই হবে।

২য় তলায় গিয়ে দেখলাম বাংলাদেশের সভ্যতা, ইতিহাসের ক্রমবিকাশ।বাংলাদেশের উৎপত্তি, বিভিন্ন পটপরিবর্তন, শিলালিপি,ভাস্কর্য একটার পর একটা সাজানো আছে। মনে হচ্ছে আমি টাইম মেশিনে চড়ে অতীত বাংলার বৈচিত্র্য দেখছি।
২য় তলায় আর যেটা দেখা গেল তার মধ্যে মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার ক্রমবিকাশ।একই কক্ষে দাঁড়িয়ে আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিবেন তবুও আপনার দেখা আর জানার আগ্রহ কমবে বলে মনে হয় না।ভাষা শহীদ,বীরশ্রেষ্ঠ, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা এবং আলোক চিত্র, দুর্লভ দলিল এবং ছবি সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর অবদান সুনিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
একই তলায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে স্পেশাল একটা গ্যালারী করা হয়েছে। উনার দুর্ভিক্ষের স্কেচ গুলো দেখলে পাষাণ হৃদয়ের মানুষের চোখেও দুফোঁটা অশ্রু আসলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। এছাড়া শিল্পী কামরুল হাসান,নভেরা আহমেদসহ অসংখ্য শিল্পীর কর্ম স্থান পেয়েছে।
হজরত ওসমান (রাsmile এর হাতে লেখা আল কোরআন এর একটা কপিও পরম যত্নে স্থান করে নিয়েছে।

৩য় তলাটা সারাবিশ্বের জন্য। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস ছড়িয়ে আছে গ্যালারী জুড়ে।যত্নসহকারে দেখলাম বিশ্বের বিখ্যাত সব আবিষ্কার এবং তাদের আবিষ্কারককে।এছাড়া বিখ্যাত এবং কুখ্যাত ব্যক্তি এবং তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে চমৎকার আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। সেটাও দেখলাম।
তারপর একই তলায় ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস, চীনা সভ্যতার ইতিহাস, কোরীয় সভ্যতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। একই সাথে ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ছবি স্থান পেয়েছে।এমনকি লিউনার্দো দ্যা ভিঞ্চির বিখ্যাত মোনালিসা'র একটা কপিও দেখতে পেলাম।
প্রায় চার ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে দেখে বের হলাম। কিন্তু এই চার ঘণ্টায় ভালো ভাবে সবকিছু দেখা সম্ভব ছিল না।অনেক কিছু চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। আবার অনেক কিছু এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।তবে অন্তত তিনবার গেলে সম্পূর্ণ জাদুঘরটি দেখার মতো দেখা সম্ভব হবে মনে করি।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বৃহত্তম এই জাদুঘরে একটি গ্রন্থাগার,একটি মিলনায়তন এবং একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনাগার চোখে পড়ল।আছে একটি বিশ্রামাগারও।বাচ্চাদের স্তন পান করানোর জন্যও বন্দোবস্ত আছে।

বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক ২০ টাকা এবং বার বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য ১০ টাকা টিকেটের মূল্য। এছাড়া বিদেশীদের জন্য ৫০০ টাকা হলেও সার্কভুক্ত নাগরিকদের জন্য ৩০০ টাকা টিকেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

আপনারা যারা এখনও জাতীয় জাদুঘরে আসেন নি।এসে দেখে যান বাংলাদেশের বর্তমান আর অতীত। সাথে আপনাদের বাসার ছোট ছোট বাচ্চাদের অবশ্যই এটা দেখানো উচিত। কারণ ঢাকায় যে সব শিশু ছোট থেকে বড় হচ্ছে তারা প্রকৃত শেকড়ের সন্ধান জানে না।জানে না তার আসল চেহারা।তাই জাতীয় জাদুঘরে আসলে তারা নিজেদের নতুন ভাবে, নিজের দেশকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারবে।

কিছু সতর্কতা:
*পরিদর্শনের সময় ছবি তোলা একেবারেই নিষিদ্ধ।
*প্রয়োজন ছাড়া ফোন বাইরে রাখা ঠিক হবে না। অহেতুক কথা শুনতে হতে পারে।
*বাইরে থেকে খাবার ও পানি নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন না(ভিতরে বিশুদ্ধ পানি এবং খাবারের ব্যবস্থা আছে)।
*ধুমপান নিষিদ্ধ।
* ব্যাগ নিতে পারবেন না (ভিতরে রাখার জায়গা আছে)।

আপনারা একবার হলেও ঘুরে আসুন বাংলাদেশে জাতীয় জাদুঘরে। আর হ্যা, জাদুঘরটি সাপ্তাহিক ছুটি বৃহস্পতিবার এবং সরকারি ছুটির দিনও বন্ধ থাকে।
অন্যান্য দিন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

Mostofa Zaman

পঠিত : ১০৩০ বার

মন্তব্য: ০