Alapon

একগুঁয়েমিপনা: মূর্খকে করে হঠকারী আর জ্ঞানীকে বানায় উদ্ধত!


বেশীরভাগ মানুষের ধারণা মূর্খ-গোঁয়ার স্বভাবের মানুষগুলোকেই বুঝি একগুঁয়ে বলে! বস্তুত একগুঁয়ে চরিত্র শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সবাইকে আক্রান্ত করতে পারে। অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ একগুঁয়ে হলে ক্ষতির প্রভাব তার পরিবার ও সংসারে কেন্দ্র করে থাকে। কিছু বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা কমে যেতে পারে মাত্র কিন্তু উচ্চশিক্ষিত ও ক্ষমতার চৌহদ্দির মধ্যে থাকে; এমন মানুষ একগুঁয়েমীনায় আক্রান্ত হলে সমাজ ও রাষ্ট্র তছনছ হয়ে যায়। কোন ধর্মীয় নেতা এ রোগে আক্রান্ত হলে দলে দলে মানুষ পথভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে।

একগুঁয়েমীপনা ব্যক্তিরা কোন বস্তু, মতাদর্শ কিংবা চিন্তা-চেতনার মাত্র একটি দিক দেখতে পায়। ভিন্ন দিক দেখার ইচ্ছা কিংবা আগ্রহ তাদের থাকেনা। সারাজীবন এভাবেই তারা একটা দিক দেখেই মন্তব্য ও বিশ্লেষণ করে। সিদ্ধান্ত নেবার জন্য অতটুকুকেই তারা যথেষ্ট মনে করে এবং নিজের পক্ষ হতে যা বিশ্লেষণ করে, সেটাকে যথার্থ ও সঠিক মনে করে। দীর্ঘদিন এই অভ্যাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চরিত্র থেকে বস্তুর দুটো দিক দেখার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলে। তার জ্ঞান তখন তাকে উপকৃত করেনা। ফলে তাদের জীবন একমুখী স্বভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তারা নিজেকে ছাড়া কিংবা তিনি যার অনুসারী সে ব্যতীত, আর কাউকে সঠিক হিসেবে দেখতে পায়না। কেউ দলীল, যুক্তি, তথ্য উপস্থাপন করে প্রমাণ করলেও, তারা নিজের সিদ্ধান্তে অনড়-অটল থাকে। এমন কি, তার অতীতের কোন একটি ভুল কথা, বক্তব্য তাকে শুনিয়ে যদি বলা হয় এটা মিথ্যা তথ্য, এটাই তার প্রমাণ। সে ক্ষেত্রেও তারা স্বীয় বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হয়না। বরং উত্তেজিত হয়ে বলে দিবে সে কথা যখন বলা হয়েছিল, তখনকার পরিস্থিতি সেই বক্তব্যের উপযোগী ছিল। সুতরাং অতীতের কথা এই মুহূর্তে বেঠিক হলেও, তখনকার সময়ের বিচারে সঠিক ছিল!

সত্য হউক, মিথ্যা হউক, একগুঁয়েমীপনা মানুষেরা সারা জীবনভর একটি সিদ্ধান্তের উপর অটল থাকতে জেদ করে। যিনি পীরের মুরিদ তিনি ভুলেও তার পীরের যোগ্যতা তলিয়ে দেখতে আগ্রহী হবেন না! যিনি রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী তিনি ভুলেও তার দলের মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি থাকতে পারে, একথা মনে ঢুকাতেই চাইবেন না। যিনি ওস্তাদের উপর প্রগাঢ় ভালবাসা রাখেন, তাকে কোন মতেই বিশ্বাস করানো যাবেনা যে, তার ওস্তাদের বলা সকল কথা সঠিক নাও হতে পারে। তারও জানার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। এতে করে তাদের অনুসারীদের মধ্যেও একগুঁয়েমীপনা ভর করে। তারা তাদের উপরস্থ বিজ্ঞজনের মুখ থেকে যা শুনে তাকে সঠিক মনে করে নিজ দায়িত্বে প্রচার চালাতে থাকে। এরা এমন অন্ধ অনুসারী হয়ে বেড়ে উঠে, মৃত্যু ব্যতীত তারা এমন অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনা।

মূর্খ ব্যক্তি যখন একগুঁয়ে হয়:

মূর্খ ব্যক্তি একগুঁয়ে হলে, সে সংসারের শুভাকাঙ্ক্ষীর পরিধি ছোট হতে থাকে। স্ত্রী যদি স্বামীর মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে তাহলে, সংসার জীবনে অহর্নিশি জ্বালাতন ছাড়া আর কিছু থাকেনা। এরা স্ত্রীকে ত্যাগ করেনা বটে কিন্তু স্ত্রীর উপর সদা প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। স্ত্রী-সন্তানদের সদা ধমকের উপর রাখতে চায়। স্ত্রীকে বুঝাতে চায় তোমার স্বামী বড় বুঝদার মানুষ, তিনি জগত সংসারের সমস্যা গুলো একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিমাপ করতে পারেন কিন্তু সমাজের পাপী মানুষেরা একথা বুঝে না! মুখেই তার যত যুদ্ধ, চাতুর্য তার অজ্ঞানতায়, ফলে তাদের বন্ধু সংখ্যা কমে যায়, স্ত্রী-সন্তানেরা অসুখী থাকে। সমাজ তাদের এড়িয়ে চলে এভাবে একগুঁয়ে মানুষও জীবনে একলা চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।

রাজনৈতিক ব্যক্তি একগুঁয়ে হলে যা হয়:

তিনি সর্বদা তার চিন্তা, চেতনা, আদর্শকে অন্য সকল মতাদর্শের উপরে স্থান দিবেন। এটাই তার রাজনৈতিক দর্শন। এটা বাস্তবায়ন করার দুটো দিক,

ক) নিজের মতাদর্শকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে নেবার জন্য জোড় প্রচেষ্টা চালাবে।

খ) অন্যের মতাদর্শ পরিত্যক্ত, পরিত্যাজ্য ও ঠুনকো সেটা প্রচারে আত্মনিয়োগ করবে।

নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করে, জনগণকে নানাবিধ প্রলোভন দেখিয়ে একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে চলে। দুনিয়াতে কোন সরকারী দল সারাজীবন জনপ্রিয় থাকেনা, তাছাড়া ক্ষমতায় গেলে দুর্নামের পরিধিও বাড়তে থাকে। তখন এসব ধামাচাপা দিতে দ্বিতীয় কার্যকরণ তথা বিরোধীদের বদনাম শুরু করে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে কর্মী ও অনুসারীদের মধ্যে। বিরোধী মত দমন, বাক অধিকার হরণ এমনকি ঠুনকো অজুহাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার মত ব্যাপারও ঘটে যায়। পৃথিবীর হাজারো বছরের লিখিত ইতিহাসে এসব ঘটনায় ভরপুর যে, নেতার একগুঁয়েমির কারণে, নিজের দলের অনুসারীরা ভিন্নমতকে দলিয়ে দিয়েছে। অনর্থক বহু যুদ্ধ বিগ্রহে রাষ্ট্র জড়িয়ে পড়েছে। হঠকারিতা অবলম্বন; একগুঁয়ে নেতার অন্যতম আদর্শে পরিণত হয়। নেতার অনুসারীদের চরিত্রও সমান তালে বিপর্যয়কর হয়ে উঠে। দাম্ভিকতা, হঠকারিতা, জেদ, ধৈর্য-হীনতা ও উদ্ধত-পনা দেখাতে কাল বিলম্ব চিন্তা করেনা এবং এক মুহূর্তের জন্যও পরিণতির কথা ভাবে না।

ধর্মীয় ব্যক্তি একগুঁয়ে হলে:

কৌতূহলের ব্যাপার হল একগুঁয়েমি একটা খারাপ গুন আবার ধর্মীয় নেতাদের কাছে ভাল গুন বেশীই থাকে। কিন্তু এটাই একমাত্র বদগুণ যা ধর্মীয় নেতাদেরকেও পাইয়ে বসে। কদাচিৎ এটা বেশী মাত্রায় ঘটে। সম্মানী গ্রহণযোগ্য মানুষেরা এ রোগে আক্রান্ত হলে, সামাজিক ও নৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। গ্রহণযোগ্য ধর্মীয় নেতারা একগুঁয়ে হলে, তার অনুসারী-সমর্থকেরাও বেপরোয়া হয়ে উঠে। তাদের ঝগড়া-বিবাদের মানদণ্ড হয়, নেতার কথার সূত্র অনুসারে। নেতাদের জ্ঞান ও জনপ্রিয়তার কারণে, তারা সেই নেতাকেই নিজের জীবনের আদর্শ বানিয়ে নেয় এবং স্বীয় জীবনাচরণে তার কথার প্রাধান্য পায়। অধিকন্তু অন্যকেও মানতে চাপ সৃষ্টি করে। এমন জ্ঞানী হবার পরও এসব ধর্মীয় নেতারা ঠুনকো ওজনের মানুষের কথার উত্তর দেয়। যে সব প্রশ্ন অবান্তর, সত্য-মিথ্যার চাদরে দোলায়িত, কু-মতলবে তোলা প্রশ্ন, বিভ্রান্তি বাড়াতে প্রশ্ন বানিয়ে জিজ্ঞাসা, অধিকন্তু যে কথাটি কেউ বলেই নাই, সে ধরনের কথা তার নামে তুলে উত্থাপন করা হলে, এসব ধর্মীয় নেতারা সেটি লুফে নিয়ে কুড়াল ছাটা উত্তর দেয়। অনুসারীরা মরিচ মাখানো উত্তর পেয়ে হল্লা করে এবং নব উদোমে নতুন আইটেম নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসব নেতারা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনা যে, অন্যকে লক্ষ্য করে যে উত্তর হানা হল তিনি সেটা আদৌ বলেছেন কিনা? শুরুতেই বলা হয়েছে তারা সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে তাই এই ধরণের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়ে থাকে। দলে দলে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে, পথভ্রষ্টটায় আচ্ছন্ন হয়, ঝগড়া বিবাদের আইটেম বাড়ানো হয়। বেকার মানুষ পরনিন্দা করার মসল্লা পায়। বেকুব মানুষ চায়ের দোকানে বসে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করে।

একটিই গুনের কথাই বলছিলাম, সেটির নাম একগুঁয়েমীপনা। শিক্ষিত অশিক্ষিত যাকে আক্রান্ত করে কবরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্তই তাকে ব্যস্ত রাখে এবং তিলে তিলে ধ্বংস করে। তাই আসুন আমরা কোন বিষয়ে বলতে গিয়ে, কারো বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে, কোন বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে, আগে যেন তলিয়ে দেখার অভ্যাস করি। যা জেনেছি, যা শুনেছি সেটা আদৌ সঠিক কিনা বিচার করি। সঠিক-বেঠিক যাই হউক না কেন, সেটা এড়িয়ে যাওয়া চলবে না, যেহেতু শোনার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছি, তাই মূল ব্যাপারটির ব্যবচ্ছেদ করতে আরো বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা উচিত। কেননা এভাবেই সত্য নিরূপণ হয় এবং মিথ্যার বিনাশ ঘটে। আর সমাজ থেকে দূর হয় বিবাদ।

Nazrul Islam Tipu

পঠিত : ৫২৯ বার

মন্তব্য: ০