Alapon

কাগজ, কলম, কুরআন ও মুসলমান...


পূর্ব উজবেকিস্থান, দক্ষিণ কিরঘিস্থান আর উত্তর তাজিকিস্থানের মধ্যবর্তি তিব্বত মালভূমির এক মরুময় ও পাহাড়ি জনপদ। মরুচারী চীনা গোত্র ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের কোল ঘেঁসে তাসখন্দের চারশত কুড়ি কিলোমিটার পূর্বদিকে ফারগানা শহর। এখানেই তাং সাং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।

এই শহরের প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে বিখ্যাত সির দরিয়া (Syr Daria)। এই সির দরিয়ার তীর ঘেঁষে ছোট্ট জনপদ তালাস নামক একটা গ্রাম। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সির দরিয়ার শাখানদীর দুই ধারে সমবেত হয়েছে লাখ দেড়েক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী।

এক পক্ষে আব্বাসীয় খেলাফতের মুসলিম সেনাপতি জিয়াদ ইবনে সালেহ’র নেতৃত্বে প্রায় তিরিশ হাজার যোদ্ধা। আর অপরপক্ষে দূর্ধষ্য চীনা সেনাপতি ঝাও সিয়াংঝি’র (Gao Xianzhi ) নেতৃত্বে প্রায় একলক্ষ চীনা সৈন্য ৭৫১ খৃষ্টাব্দের মে মাস থেকে জুলাই পর্যন্ত উত্তপ্ত মরুভুমির প্রচন্ড গরমের মধ্যে মুখোমুখি।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে চীনা সৈন্যবাহিনীতে ভাড়ায় খাটতে আসা স্থানীয় কারলুক তুর্কিরা (Karluk Turk) পক্ষত্যাগ করে আব্বাসিয় মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং চীনারা পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার মাধ্যমেই এতদ্বাঞ্চলে চীনা তাং রাজবংশের শাসনের ইতি ঘটে। বিখ্যাত সিল্করুটের উপরে আব্বাসীয়দের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধটাই বেটল অব তালাস (Battle of Talas) বা তালাসের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে।

সদ্য প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় সা¤্রাজ্যের জন্য এটা ছিল এক ঐতিহাসিক মহুর্ত। কারণ পরবর্তিতে তাদের হাতে যে অকল্পনীয় বিত্ত বৈভব আর সম্পদ এসে জমা হয়েছে ব্যবসা বাণিজের মাধ্যমে, তার পেছনে এই সিল্ক রটের উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা একটা বড় কারন।

বিশ্ব ইতিহাসে এই যুদ্ধের ফলাফল ঐতিহাসিক ও অভাবনীয় হলেও অবাক কান্ড হলো এই যুদ্ধটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। হয়না। অথচ এই যুদ্ধ ও মানবসভ্যতার উপর তার ফলাফল নিয়ে এক মহা উপাখ্যান রচিত হতে পারে অনায়াসে।

যুদ্ধে চীনাপক্ষে তিরিশ হাজারেরও বেশি সৈন্য নিহত হয়। ছত্রভঙ্গ হয় পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর আগে বেশ কয়েক হাজার সৈন্য মুসলমানদের হাতে ধরা পড়ে। ধৃত চীনা যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে দুইজন বন্দি কাগজ তৈরিতে দক্ষ ছিল। চীনে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দি থেকেই কাগজ তৈরি হতো। কিন্তু সেই প্রযুক্তি ও জ্ঞান কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। চীনা স¤্রাটগণ কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কাগজ উৎপাদন করাতেন আর তার ব্যবহারও কেবলমাত্র চীনা রাজবংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন তারা।

মুসলিম সেনাপতি জিয়াদ ইবনে সালেহ এই দুইজন চীনা বন্দীর একজনকে প্রেরণ করলেন খেলাফতের অন্যতম প্রাশাসনিক কেন্দ্র হিরা নগরীতে আর অপরজনকে সমরখন্দে। ধৃত চীনা সৈনিকরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে মুসলমানদের এই কাগজ তৈরির কৌশল শেখায়।

শুরু হয় মানবিতিহাসের মোড় পরিবর্তন। প্রথমবারের মতো মুসলমানদের হাতে কাগজ বানানো শিখলো। ঠিক এ সময়টাতেই আব্বাসীয় সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, ওদিকে ফ্রান্সের দক্ষিণে পাইরেনিস পর্বতামালার ওপারে স্পেনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে উমাইয়া প্রিন্স আব্দুর রহমানের হাত ধরে উমাইয়া শাসন, ইতিহাসের কল্পরাজ্য; স্বপ্নের আল আন্দালুস। আর এ সময়েই মুসলমানদের হাতে এলো কাগজ তৈরির প্রযুক্তি ও জ্ঞান!

অষ্টম শতাব্দির শেষ দিকে; ৭৯২ খৃষ্টাব্দ অথবা ৭৯৫ খৃষ্টাব্দে সমরখন্দে কাগজ তৈরির কল প্রতিষ্ঠিত হলো। মুসলিম বিশ্বের প্রথম কাগজের কল।

চীনারা কাগজকে গু জি বলে অভিহিত করতো। আরবদের কাছে এটা অপরিচিত একটা বস্তু। এর কোন নামও তাদের অভিধানে বা ভাষায় নেই। তারা একে বলতো ‘গু জি’র মতো’। আরবি ভাষায় এই গু জি’র মতো বাক্যটিকে বলতে হয় ‘কা আল গু জি’। আরবি ‘কা’ শব্দটির অর্থ; ‘অনূরুপ’ বা ‘মতো’ ইংরেজিতে ‘like, as’ ইত্যাদি।
আল কুরআনেও আল্লাহপাক কর্তৃক আমরা এই ‘কা আল’ বাক্যটির ব্যবহার দেখি। আল্লাহর উপরে ঈমান আনতে অস্বীকারকারী মানুষকে পশুর সাথে তুলনা করতে গিয়ে তিনি এই ‘কা আল’ বাক্যটি ব্যবহার করেছে দেখুন;আল কুরআনে সুরা আ’রাফের ১৭৯)।

এখানে উক্ত আয়াতে ‘পশুর মতন’ বুঝাতে ‘কাআল আনআম’ বা কালআনআ’ম বলেছেন। ঠিক একইভাবে আব্বাসীয় সা¤্রাজ্যে সমকালীন আরবরাও চীনা কৌশলে নির্মিত নতুন এ বস্তুটিকে চীনাদের নামেই ডাকতো। বলতো গু জি’র মতো বা ‘কা আল গু জি’ বা ‘কালগুজি’। এই ‘কা আল গু জি’ই পরিবর্তিত হয় ‘কালগুজি’তে। পারস্যবাসী তথা ইরানিদের ভাষায় আরবি ‘আল’ শব্দটা নেই।

বাগদাদ সমরখন্দ মুসলিম তথা আব্বাসীয় ইসলামি সা¤্রাজ্য হলেও ৬৯০ খৃষ্টাব্দের পর থেকেই ফারসিভাষী ইরানিরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আর আরবি ভাষী আরবরাই সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। যদিও সকলেই এক ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

পারসিক ইরানিরা কালগুজি’ শব্দ থেকে আরবি ‘আল’ শব্দটি বাদ দেয়। অথবা তা এক সময় বাদ পড়ে যায়। এভাবে কা আল গু জি থেকে কালগুজি ও সেখান থেকে পারসিকদের ‘আল’ শব্দটি বর্জিত হয়ে কাগুজি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

আর সেই কাগুজি থেকেই সর্বশেষ কাগজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এভাবেই ‘কাগজ’ শব্দটি আজকের বাংলা বা ফরাসি’সহ উপমাহেদশীয় ভাষার অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হিসেবে বরিত হয়ে গেছে।

বাগদাদ, সমরখন্দ, হিরা, মসুল, সেভিল, কর্ডোভা, দামেশক ও আলেকজান্দ্রিয়া’সহ মাত্র কয়েকটি দশকের মধ্যে প্রায় তিনশত কাগজের কল দিনরাত কাগজ উৎপাদন করে গেছে। সেই সব কাগজের পাতায় ইবনে সিনা, আল জাওয়াহিরি, আল রুশদ, আল রাজি, আল জাবির, আল ফারাবি, ইবনে হায়সাম, ইমাম কুরতুবি, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, জালালুদ্দিন রুমি, গাজ্জালি প্রমুখ বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন জ্ঞান বিজ্ঞান আর দর্শসের এক বিশাল ভান্ডার। সমৃদ্ধ হয়েছে মানবতা, সমৃদ্ধ হয়েছে পুরো বিশ্ব!

যে মুসলমানরা কাগজকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিল, যে কাগজের উপরে ভর করে তারা বিশ্বকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করলো, একের পর এক রেনেসাঁর জন্ম দিল, বিজ্ঞানময় আধুনিক বিশ্বের গোড়াপত্তন করলো, বিশ্বকে দেখালো উন্নতি আর প্রগিতির পথ, মানবতাকে করলো সমৃদ্ধ আর যথার্থ মানবিক, সেই মুসলমানরাই আজ পথের দিশা পেতে চেয়ে থাকে একদিন যাদের তারা পথ দেখিয়েছে সেই তাদেরই দিকে! কি নিদারুণ অধোপতন!

যে মুসলমানদের ধর্ম, শিক্ষা ও দর্শনে খোদ আল্লাহপাকই কলমের কসম কেটে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যে মুসলমানদেরকে স্বয়ং আল্লাহপাকই নির্দেশ দিয়েছেন; ‘পড়ো’ বলে, সেই মুসলমানরাই আজ বিশ্বের বুকে জ্ঞানে বিজ্ঞানে অন্যতম পশ্চাদপর জাতি! কি অবমাননাকর জিল্লতী!!

দু:খ আর লজ্জা, ক্ষোভ আর অপমানে মাথায় হেট হয়ে আসে। আজও কাগজ আছে, আছে কলমও। আরও আছে উম্মুল কুরা; ‘মাদার অব অল নলেজ’ হিসেবে বিষ্ময়কর গ্রন্থ; আল কুরআন।

আফসোস! নেই শুধু কাগজের সমঝদার কলম সৈনিক। নেই আর কুরা বা ‘মাদার অব অল নলেজ’; আল কুরআনের বোদ্ধা পাঠক!
সত্যিই কি নিদারুণ দীনতা এ জাতির! এ অধোপতন কবে কাটবে? এমনতর জিল্লতী থেকে এ জাতি, এ উম্মাহ কবে মুক্তি পাবে?

Ziaul Huq

পঠিত : ৭৯২ বার

মন্তব্য: ০