কবি আল মাহমুদ তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্যকর্মের মাঝে আজও বেঁচে আছেন ...
তারিখঃ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১৮:০৭
বছর তিনেক আগে কবি আল মাহমুদের মগবাজারস্থ বাসা ‘আয়শা ভিলা’ তে গিয়েছিলাম। কবি তখন ভীষণ অসুস্থ। স্পষ্ঠ করে কথা বলতে পারেন না। ঠিক করে শুনতেও পারেন না। আমরা সেদিন কবির হাতে আমাদের প্রকাশনীর কয়েকটি বই তুলে দিয়েছিলাম। কবি বইগুলোর উপর এমন মায়া নিয়ে হাত বুলাচ্ছিলেন, যেন বইগুলো কোমল সন্তান।
এরপর কবির বাসায় বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম। কবি যতোই দেখতাম ততই মুগ্ধ হতাম। কবির চেহারায় কী যেন একটা ছিল। তাকে দেখলে মনে হতো জাদুকর। সাহিত্যের জাদুকর, ছন্দের জাদুকর, উপমার জাদুকর, শব্দের জাদুকর। আর তিনি এই জাদু ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় এনেছিলেন ভাঙা একটি স্যুটকেসে করে। চলুন কবির ভাষাতেই সেই কাহিনি শুনি-
‘আমি ঢাকায় এসেছিলাম খদ্দরের পিরহান গায়ে, পরনে খদ্দরের পায়জামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল এবং বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা ভাঙা সুটকেস নিয়ে। এসেছিলাম অবশ্যই কবি হতে। আজ অনেক বছর শহরে আছি। আমার সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারীসহ বহমান আস্ত এক বাংলাদেশ।
যেমন, যাদুকররা তাঁদের দ্রষ্টব্য দেখান। তেমনি আমি ভাঙা সুটকেস থেকে জাতিকে দেখিয়েছি। আমার দ্রষ্টব্য দেখে বাংলার মানুষ কখনো কখনো হাততালি দিয়েছেন, আবার কখনো অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমার বন্ধুদের বগলের নিচে থাকতো সিলেক্টেড পয়েমস জাতীয় ইউরোপের নানা ভাষার নানা কাব্যগ্রন্থ।
আমি যেমন আমার ভাঙা সুটকেস থেকে আমার জিনিস বের করে দেখিয়েছি তারাও তাঁদের বগলের নিচের পুঁজি থেকে নানা ভেলকি দেখিয়েছেন। এখনো আমি এই শহরেই আছি। আমার সেসব বন্ধুদের আমার মতো সৌভাগ্য হয়নি। এই নগরীতে তাঁদের নাম তরুণরা উচ্চারিত হয় না। একটি কথা মনে রাখবে - সাহিত্য কোন প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিলো না, এখনো নেই। এটা ছিলো আনন্দের বিষয়, ভষ্যিতেও তাই থাকবে।’
কবি সেই ভাঙা স্যুটকেঠে মাটি ও মানুষের গল্প নিয়ে এসেছিলেন। সেই গল্প দিয়ে তিনি কোটি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। আজ ১৫ ফেব্রুয়ারী। আজকের এই দিনে কবি আল মাহমুদ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি মহান আল্লাহর সাথে দেখা করার জন্যও উদগ্রিব ছিলেন। কবি তাঁর ‘স্মৃতির মেঘলাভোরে কবিতায় লিখেছেন-
কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
ফেলে যাচ্ছি খড়কুটো, পরিধেয়, আহার, মৈথুন–
নিরুপায় কিছু নাম, কিছু স্মৃতি কিংবা কিছু নয়;
অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে জমে আছে শোকের লেগুন
কার হাত ভাঙে চুড়ি? কে ফোঁপায়? পৃথিবী নিশ্চয়।
স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপিণ্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ?
নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার
যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।
আল্লাহ কবির সেই ফরিয়াদ কবুল করেছেন। কবির দুনিয়া থেকে বিদায়ের দিনটিও ছিল শুক্রবার।
কবি যে ভাঙা স্যুটকেসে ভরে বাংলার মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির গল্প নিয়ে এসেছিলেন, ফিরে যাওয়ার সময় সেই ভাঙা স্যুটকেসে ভরেছেন কোটি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা।
প্রিয় কবি! আপনাকে আমি কখনোই ভুলতে পারি না। আপনার সেই শুভ্র চেহারা আমার আজীবন মনে থাকবে। আল্লাহ আপনাকে ওপারেও সম্মানিত করুন।
মন্তব্য: ০