Alapon

জেনারেল আতাউর গনি ওসমানীর অজানা ইতিহাস...


পাকিস্তানীরা তাঁকে ডাকতো পাপা টাইগার! তাঁর নাম শুনলে ত্রাস সৃষ্টি হতো পাকিস্তানি ক্যান্টনমেন্টে। তিনি ছিলেন ৩টি দেশের সেনাবাহিনীর অফিসার। ১৯৪২ সালে তৎকালীন বৃটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ মেজর ছিলেন তিনি। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি হলেন একটি ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক।

একটি দেশের স্বাধীনতার পথে মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, একটি দেশকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার রনাঙ্গনের অন্যতম মহারথী; অথচ সেই স্বাধীনতার পক্ষে দাবী করা দলগুলোর কাছেই তিনি বরাবর উপেক্ষিত। এড়িয়ে চলে তাঁকে সচেতনভাবে। কারন তিনি ছিলেন নির্লোভ স্পষ্টভাষী।

মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। বাংলার সূর্যসন্তানদের মধ্যে অন্যতম। ছিলেন ভীষণ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এক মহাপ্রাণ।

একটি ঘটনাই তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট এবং একই সঙ্গে আত্মসমর্পণের মুহূর্তে কেন আতাউল গণি ওসমানী ছিলেন না তারও প্রমাণ মিলবে।

“১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দুপুর প্রায় বারো’টা নাগাদ কলকাতাস্থ থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদের কাছে খবর এসে পৌঁছালো, ঢাকায় হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছে। আজ বিকেলেই ঢাকায় আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পণ হবে। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে এই অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য উচ্চপদস্থ কাউকে উপস্থিত থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে তখন কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী জেনারেল ওসমানী) দেখে আনন্দে এক রকম চিৎকার করে উঠলেন, সি-ইন-সি সাহেব ঢাকায় সর্বশেষ খবর শুনেছেন বোধহয়?

এখনতো আত্মসমর্পণের তোড়জোড় চলছে। …প্রধানমন্ত্রী বাকী কথাগুলো শেষ করতে পারলেন না। ওসমানী তাঁকে করিডোরের আর এক কোণায় একান্তে নিয়ে গেলেন। দুজনের মধ্যে মিনিট কয়েক কি কথাবার্তা হলো, আমরা তা শুনতে পেলাম না। ... ওসমানী সাহেবের শেষ কথাটুকু আমরা শুনতে পেলাম- ‘নো নো প্রাইম মিনিস্টার, মাই লাইফ ইজ ভেরী প্রেশাস, আই কান্ট গো’।” . সূত্র - এম.আর.আক্তার মুকুল (‘আমি বিজয় দেখেছি)

(২)

“১৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে, শুনে ছুটে গেলাম আঁট নং থিয়েটার রোডে তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। তিনি হয়তো ততক্ষণে ঢাকায় চলে গেছেন অথবা যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তাজউদ্দিন সাহেব স্বাভাবিক পোষাকে বসে আছেন। তিনি কখন যাবেন জিজ্ঞাসা করায় বললেন তিনি যাবেন না। তখন আমি আশ্চর্য্য হলাম। এতদিন পর দেশ স্বাধীন হচ্ছে, শত্রু বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে এ সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেই বোধগম্য হলো না। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন- ‘শেখ মণি ও মুজিব বাহিনীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো আপনার জানা আছে।

সৈন্যবাহিনীতে আমার শুভাকাঙ্খীদের কাছ থেকে আমি জানতে পেরেছি এই মুহূর্তে ঢাকায় সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থা চলছে। ঠিক এসময় ঢাকায় কোন জনসমাবেশের মধ্যে আমার উপস্থিত থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। জনতার ভিড়ের মধ্যে মুজিব বাহিনীর লোকেরা যে কোন মুহূর্তে আমাকে গুলি করে হত্যা করে ফেলতে পারে কিন্তু দোষ চাপিয়ে দিতে পারে আল-বদর, আল-শামসের ঘাড়ে এবং লোকেরাও সেটা বিশ্বাস করবে। তাই আমার শুভাকাঙ্খীরা বলেছে, ঢাকার অবস্থা মোটামোটি আয়ত্বে আসলে তারা আমাকে জানাবে এবং আমি আশাকরি দু’একদিনের মধ্যে আমি যেতে পারব।’ ওসমানী সাহেব যাচ্ছেন কিনা জিজ্ঞাস করায় তিনি বললেন-‘তিনিও যাচ্ছেন না’।”

এম.এন.এ. মোহাইমেন – (‘ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর’, পৃষ্ঠা – ১৬০)

ওসমানীর পি.আর.ও. নজরুল ইসলামের বক্তব্যঃ-

ঢাকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে কে উপস্থিত থাকবেন- এ নিয়ে যখন নানা গুজব ও কানাঘুষা চলছিলো, সে সময় জেনারেল ওসমানী কলকাতায় অনুপস্থিত। তিনি কোথায় গেছেন বা কোথায় ছিলেন তা কেউ ভাল করে জানেনও না। এমনকি আমিও জানি না। তার দপ্তরের কোন সামরিক কর্মকর্তা এ সম্পর্কে মুখ খুলছেন না।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের দু’দিন পর জেনারেল ওসমানী মুজিবনগর সদর দপ্তরে ফিরে আসেন। তাঁকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন- ‘দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোন চেতনা এখনো জন্ম হয়নি।

ঢাকায় আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। কারণ, এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টির পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনা প্রধান লেঃ জেনারেল শ্যাম মানেকশ্। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশ্’কে রিপ্রেজেন্ট করবেন লেঃ জেনারেল অরোরা। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মানেকশ্‌ গেলে আমার যাবার প্রশ্ন উঠত। সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশ্‌র সমান। সেখানে মানেকশ্‌র অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা কোন দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃক্ষিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদার বড় অভাব।

ঢাকার ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়, জেনারেল মানেকশ্‌র পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীনে ঢাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাব কি জেনারেল অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাউ ক্যান।

আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশ্‌র পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া হচ্ছে।”

পাকিস্তানী বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী অনুপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানী উপস্থিত না থাকার কারণ ছিল আর্মি প্রটোকল।আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সৈন্যবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী। এরা দুজনেই ছিলেন আঞ্চলিক প্রধান।অন্যদিকে ওসমানী ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান।তাই সেনাবাহিনীর প্রটোকল রক্ষার্থে কোন সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক প্রধানের সাথে তিনি কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেন না।ওসমানি নিজেই এ বিতর্কের জবাব দিয়ে গেছেন।

(তিন)

৭১ এর ২৫শে মার্চে ঢাকাতেই ছিলেন ওসমানী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বছর চারেক আগে অবসর নেয়া ওসমানীর সামরিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে পারিস্তান সরকার অবগত ছিল। তাই ঐ রাতেই ওসমানীকে হত্যার চেষ্টায় হন্যে হয়ে খোঁজে পাকবাহিনীর এক কমান্ডো। কিন্তু একেবারেই ভাগ্যগুণে অনেকটা অলৌকিকভাবে প্রাণ বেঁচে যায় ওসমানীর। এত পরিচিত চেহারা নিয়ে তিনি নিরাপদে পালিয়ে ছিলেন, সেটাও আমাদের আশ্চর্য করে।

পরবর্তীতে মনজুর আহমদ নামক এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকারে এই ব্যাপারে তিনিই খোলাসা করেন, বলেন যে, হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বিখ্যাত গোঁফ জোড়াটি কামিয়ে ফেলেছিলেন। ঢাকা থেকে তিনি পালিয়েছিলেন ২৯শে মার্চ। এর আগের চারদিন ঢাকার ইস্কাটনের একটি ফাঁকা বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। খানসেনারা তাঁকে খ্যাপা কুকুরের মতো খুঁজছিল। তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে চালিয়েছিল হামলা।

প্রতিটি ফাঁকা ঘরেই মেশিনগান চালিয়েছে। নিউ ইস্কাটনের বেশ কয়েকটি বাড়িতেও তারা হামলা চালিয়েছিল, কিন্তু ওসমানী যে বাড়িতে ছিলেন, সেটায় হানা দেয়নি। এ ব্যাপারে ওসমানী উল্লেখ করেন, “পরম করুণাময়ের অশেষ অনুগ্রহ ছিল তাঁর ওপর। তা না হলে এমনভাবে কজন রক্ষা পায়!” ২৯শে মার্চ, নদীপথে পালিয়ে গিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধরত ব্যাটালিয়নের সাথে যোগ দেন তিনি।

৯ই এপ্রিল ওসমানী সিলেটে যান মুক্তিবাহিনীর অবস্থান জানতে। সেখানে তিনি এম. আজিজুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এম. আজিজুর রহমান, তিনি ওসমানীর সাথে কাজ করার সময়ের কিছু অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন। তারই বিবৃতিটি সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে উল্লেখ করা হলো।

একটা ব্যাপার আমাকে সবসময়ই পীড়া দিয়ে এসেছে যে, বঙ্গবীর জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীর ব্যাপারে মানুষ খুবই কম বিবৃতি প্রদান করেছে। এমনকি তারাও তাঁকে স্মরণ করেনি যারা স্বাধীন বাংলায় জেনারেল ওসমানীর কঠোর পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে। জেনারেল ওসমানী; তাঁর নামটাই শত্রুবাহিনী সহ সকল বাঙালী অফিসারকেও শঙ্কিত করে তুলতো, এমন কোনো ঘটনাস্থল ছিল না কিংবা এমন কেউ ছিল না যার সমূহ বিপদ ছিল আর ওসমানী সেখানে হাজির হননি। কিন্তু বর্তমানে তাঁর নামে শ্রদ্ধায় মানুষ মাথা নোয়াচ্ছে, এমনটা দেখাই যায় না। একজন সফল নেতার যে সকল গুণাবলি থাকা প্রয়োজন তাঁর মাঝে সবই ছিল।

মাস্টার্স সমাপ্তির আগেই তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের জন্য একজন ক্যাডার মনোনীত হন। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে তিনি যোগ দেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে। জেনারেল ওসমানীর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল। আমি আমার দলকে নিয়ে সুরমা নদীর তীরে কীন ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থান করছিলাম। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে চলছিলো ভারী গোলাবর্ষণ। সেই সাথে আকাশপথেও পাক বিমানবাহিনী গোলাবর্ষণ চালায়। সুরমা নদীতে সেদিন শুধু মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছিল। তরুণ ক্যাপ্টেন হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল ফ্রন্ট লাইনে সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করে। সেটা করারই চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পথিমধ্যে শত্রুদের গুলিতে আমার জীপ অচল হয়ে পড়লে জল্লারপাড় মসজিদের কাছাকাছি আমি লাফ দিয়ে পড়ি।

এক অর্ধনির্মিত দালানের ছাদে গিয়ে উঠি। ছাদ থেকে বেশ ভালোমতোই আমি দেখতে পাই চারপাশের অবস্থা। হঠাৎ এক দৃঢ় কণ্ঠ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে যে, ওহে যুবক, কী চলছে এখানে? তখনও আমি জানিনা যে, তিনিই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী (যুদ্ধ পরবর্তীতে তিনি জেনারেল পদে উন্নীত হন), আগে কখনো দেখা হয়নি তাঁর সাথে। আমি কল্পনাও করতে পারিনি কখনো, ওরকম ছোট দৈহিক গঠনের একজন আগন্তুক, যার পরিচয়, তিনি এই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, তাঁর অত সাহস আর কৌতূহল যে, যুদ্ধের খোলা ময়দানে এভাবে একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে অনেক লম্বা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে আমার কাছে আসার জন্য। তিনি পরিস্থিতির বর্ণনা শুনে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নেন আর খুব দক্ষতার সাথেই পুরো পরিস্থিতি নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।

ওসমানী সাহেবের সাথে পরবর্তীতে আমার দেখা হয় ভারতীয় বর্ডারে অবস্থিত খোয়াই হাসপাতালে। আমি তখন শেরপুরের যুদ্ধে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ওসমানী ফ্রন্ট লাইনে আমার খবর শুনে তৎক্ষণাৎ সেখানে আসেন। আমার অবস্থা আর চিকিৎসা ব্যবস্থার অবহেলা লক্ষ্য করে সাথে সাথে নিজ হেলিকপ্টারে করে আগরতলায় এক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। কেমন অসাধারণ বীরত্বপূর্ণ একজন নেতা ছিলেন ওসমানী, সেই ব্যাপারে উল্লেখ করতে হলে এই দুটো ঘটনাই আমি মনে করি যথেষ্ট। একজন অফিসার গুটি গুটি পায়ে একদিন জেনারেল পদে ঠিকই উন্নীত হতে পারেন, কিন্তু সকল জেনারেল ভাল নেতা হতে পারে না। জেনারেল ওসমানী ছিলেন তেমনি একজন নেতা। আর আমাদের ভাগ্য ভাল ছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম জেনারেল ওসমানীকে।

১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন। এই সময় তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামো গঠনের কথা, সেই সাথে বলেন যে সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হবেন এম. এ. জি. ওসমানী। এর পরপরই ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার, ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। তাজউদ্দিন আহমদের এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মেজর জেনারেল কে. এম. সফিউল্লাহ্ বলেন, “আমরা যে বিষয়টি আগেই অনুমান করেছিলাম তাই সঠিক হলো। কর্ণেল এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ঘোষণা। এর ফলে প্রত্যাশিত ও শুভ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।” (আমাদের মুক্তিযুদ্ধ- মেজর কে. এম. সফিউল্লাহ্)

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওসমানী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন৷ ঐ ভাষণে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরঅবকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করে এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন৷ উল্লেখ্য যে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারী ও সরকার গঠন করা হয় এবং পরবর্তীকালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার, ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি।

ওসমানী'র নির্দেশনা অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে এক একজন সেনাবাহিনীর অফিসারকে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে সমন্বয়সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা - প্রভৃতি কাজ সাফল্যের সাথে পালন করেন ওসমানী। ১২ এপ্রিল থেকে এম. এ. জি. ওসমানী মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷

রণনীতির কৌশল হিসেবে প্রথমেই তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন এবং বিচক্ষণতার সাথে সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন৷ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল দক্ষ এবং সংখ্যায় অনেক বেশি৷ এই বিবেচনায় ওসমানীর রণকৌশল ছিল প্রথমে শত্রুকে নিজেদের ছাউনিতে আটকে রাখা এবং তাদেরকে যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যম হতে বিছিন্ন করে রাখা৷ এজন্য এম. এ. জি. ওসমানী মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন৷ মে মাসের পর তাঁর মনে হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুকে ছাউনিতে আটকে রাখা গেলেও ধ্বংস করা সম্ভব নয়৷

এ বিষয়টি তিনি সরকারকে জানিয়ে যুদ্ধে কৌশলগত পরিবর্তন আনেন৷ প্রাক্তন ইপিআর এর বাঙালি সদস্য, আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে একটি গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী গঠন করেন।

মুক্তির সংগ্রামে এম, এ. জি. ওসমানীর হাতে কোনো নৌবাহিনী ছিল না। তবে নিয়মিত নৌবাহিনীর কিছু অফিসার এম. এ. জি. ওসমানীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন৷ তাছাড়া ফ্রান্সের জলাভূমিতে থাকা পাকিস্তানের ডুবোজাহাজের কিছু সংখ্যক কর্মীও মুক্তিবাহিনীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন৷

কিছুদিন পর এম. এ. জি. ওসমানী তাদের এবং কিছু সংখ্যক গেরিলা যুবক নিয়ে একটি নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে তাঁরা নদীপথে শত্রুর চলাচল প্রায় রুদ্ধ করে দেন। নৌবাহিনী গঠনের ফলে একটা বড় ধরনের সংকটের অবসান হলেও দেশ স্বাধীন হবার আগে আগে আরও একটা সঙ্কট এম. এ. জি. ওসমানী অনুভব করেন। সেটা হচ্ছে তাঁর হাতে কোনো বিমানবাহিনী ছিল না। শেষের দিকে দুটি হেলিকপ্টার, ও একটি অটার আর তাঁর নিজের চলাচলের জন্য একটি ডাকোটা নিয়ে ছোট্ট একটি বিমানবাহিনী গঠন করেছিলেন তিনি৷

সামরিক বাহিনীর কতিপয় অফিসার প্রশ্ন তুলেছিলেন, মুজিবনগরে বসে ওসমানীর পক্ষে এককভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করা কতটুকু সম্ভব? সেক্টর কমান্ডাররা নিজ নিজ সেক্টরে নির্দেশ প্রদানের অবাধ ক্ষমতা দাবী করেন। এ ঘটনায় ওসমানী মানসিকভাবে আহত হয়ে ১০ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের উপস্থিতিতে মুক্তিবাহিনীর প্রধানের পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। পরে তাঁকে বলা হয়, পুরো ঘটনাটিই একটি ভুল বোঝাবুঝি ছিল। সেক্টর কমান্ডার এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি স্বপদে পুনর্বহাল থেকে যান।

ব্রিটিশ গণতন্ত্রকে মডেল হিসেবে মনে করতেন ওসমানী। রাজনৈতিক শঠতা, কপটতার ধারেকাছেও তাঁর অবস্থান ছিল না। সততায় আর সচ্চরিত্রে এক দেবতুল্য মানুষ ছিলেন।

আজীবন চিরকুমার ও অধূমপায়ী ছিলেন। শেষ জীবনে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমাতেন।

নিজের সব সম্পত্তি, পৈত্রিক সম্পত্তি মৃত্যুর আগেই বিলিয়ে দিয়েছেন ট্রাস্টে যেন মানুষের কাজে লাগে।

আজ মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর প্রয়াণ দিবস । বিনম্র শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি।

পঠিত : ১৬৩৯ বার

মন্তব্য: ০