Alapon

একুশে ফেব্রুয়ারী, ভাষা আন্দোলন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও ভবিষ্যতের উপমহাদেশ...


এক.
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রায় সত্তর বছর হয়ে গেছে, প্রায় আশি বছর হয়ে গেছে তামিল ভাষা আন্দোলনেরও। আমাদের ইতিহাসের নির্মাতারা প্রায়ই যেটাকে এড়িয়ে যান তা হল বাঙ্গাল মুসলমানদের মত তামিলরাও ভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে। একইভাবে ভাষার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে জীবন দিয়েছে তুরস্কের মুসলমানরাও। তিনটি ঘটনাই বিগত শতাব্দীর।

ভাষা আন্দোলন যতটা না ছিল বাংলা বনাম উর্দুর অথবা পাঞ্জাবী বনাম বাঙ্গালের লড়াই, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির লড়াই। কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তানের জন্মের আগেই বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানের সৃষ্টি ঠেকানো যাবে না, তাই তারা পাকিস্তান সৃষ্টি সমর্থন করেছে। তখন থেকেই তারা চেষ্টা করেছে পূর্ব বাংলা যেন পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যায় তার ভিত স্থাপন করার।
কেউ যদি বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, জাতীয় রাজনীতি, একশো বছরের রাজনীতি, বাংলাদেশের কালচার, আত্মপরিচয়ের সন্ধানে শীর্ষক বইগুলো পড়েন, অথবা ফাহমিদ উর রহমানের বাংলাদেশ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সংস্কৃতি বিষয়ক বই বা প্রবন্ধগুলো পড়েন, এই ধোয়াশা কেটে যাবে যে ভাষা আন্দোলন উর্দুর বিরুদ্ধে হয় নি, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মিছিলে গুলিও পাঞ্জাবীদের নির্দেশে চলে নি এবং ভাষা আন্দোলনকে ক্রমেই ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দিকে ধাবিত করার পেছনে সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি দায়ী, যা পাঞ্জাবী চক্রের হঠকারিতা, বাঙ্গাল নেতৃত্বের অযোগ্যতা ও ভারতের উসকানিতে শেষমেশ মাত্র দশ বছরের মাথায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়, যেই জাতীয়তাবাদের নাড়ি পোতা বাঙ্গাল মুসলমানের রাজনীতিতে নয়, কোলকাতার উপনিবেশবাদী উচ্চবর্ণীয় ব্রাক্ষ্মণ জমিদারদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে।

বস্তুত, উর্দু বা বাংলার মধ্যে ব্যবহারিক তফাত তাই ছিল যা আজকে ইংরেজী ও বাংলার মধ্যে উপস্থিত। আজকের বাংলাদেশে ভাল ইংরেজী না জানলে যত ভাল বাংলাই জানেন, কেউ চাকরি পাবেন না। এবার আপনি ভেবে দেখতে পারেন, ভাষা আন্দোলনটা আমরা কি বুঝে করলাম??

দুই.

আরএসএস(বিজেপি) ও ইজরায়েলের যৌথ প্রজেক্ট হিন্দুত্ববাদ আজ সারা উপমহাদেশকে এক অনিবার্য বাস্তবতার মুখে দাড় করিয়ে দিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন আবার এই অঞ্চলের রাজনীতির মূল প্রশ্নে পরিনত হয়েছে।

আরএসএস যে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাকে প্রস্তাব করে, বাংলা ও বাঙালি সেখানে আরেক অচ্ছুৎ হিসেবেই বিবেচিত হয়। আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের জন্য শুদ্ধ ভাষা হচ্ছে হিন্দী, এই হিন্দী ভাষা, হিন্দু ধর্ম, গরু, ক্রিকেট, বলিউড আর হিন্দী-পাঞ্জাবীভাষী ভারতীয় পুজিপতিদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য, উত্তর ভারতীয় আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য এবং গ্লোবাল আইট সেক্টরে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের দুর্দান্ত সাফল্যের সাথে ইজরায়েলী ছত্রছায়া মিলে তৈরি করেছে এই হিন্দুত্ববাদী সাম্রাজ্য, যা নিজের সীমানা হিসেবে ঠিক করেছে সারা উপমহাদেশকে।
আরএসএসের এই হিন্দুত্ববাদী সাম্রাজ্যের মানচিত্রে কোন বাংলাদেশ, নেপাল বা পাকিস্তানের জায়গা নেই, পুরোটাই মহাভারত।

বাংলাদেশকে এই হিন্দুত্ববাদী মানস চিন্তা করে দুসরা পাকিস্তান হিসেবে, আর বাঙ্গাল মুসলিমকে এরা মনে করে অশুদ্ধ ধর্মত্যাগী হিন্দু, যাদের মূলের দিকে ফিরিয়ে নেয়া তারা নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করে। বস্তুত, বিপুল সংখ্যক হিন্দু সুলতানী আমলে ইসলাম গ্রহন করলেও তারা আসলে ছিল জোরপূর্বকভাবে বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগে বাধ্য হওয়া হিন্দু। সুযোগ পাওয়ামাত্রই তারা সেই অপমানজনক শূদ্র পরিচয় ত্যাগ করেছে।

আবার ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ যে মূলত বাঙ্গালিত্বকেই হজম করতে পারে না তার উদাহরন হচ্ছে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের প্রতি তাদের নাকউচু আচরন। পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী হিন্দু এককালে বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যের হিসেবে ভারতের সেরা ছিল, কালক্রমে পশ্চিম-উত্তর পশ্চিম ভারতীয়দের দাপটে ভারতে যোগ দেয়ার কিছু সময় পরেই তারা ক্ষমতাহীন দুর্বল, নিজভুমিতে পরাধীন এক জনগোষ্ঠীতে পরিনত হয়। পাঞ্জাব, দিল্লী, মুম্বাই আর মাড়োয়ারের ব্যবসায়ীরা আজ পশ্চিম বাংলার মালিক-মুখতারে পরিনত হয়েছে, আর বিজেপির হিন্দুত্ববাদ স্থায়ীভাবে পশ্চিম বাংলা-আসামের হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙ্গালীদের হিন্দিভাষীদের সামনে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হওয়ার হুমকি হিসেবে হাজির হয়েছে। বিশেষ ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সচেতন পশ্চিম বাংলার মানুষ এনআরসির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

তিন.

ভাষা আন্দোলনের প্রায় সত্তর বছর পর অগ্নিগর্ভ উপমহাদেশ আজ যে বাস্তবতার সামনে দাড়িয়ে আছে, তাতে এখন উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলাভাষীদের মধ্যে এক নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এই মেরুকরণে বাঙ্গাল মুসলিম, বাঙালি হিন্দু ও আসামের হিন্দুত্ববাদবিরোধী মানুষের মধ্যে একটি জোট গড়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরী।
অসমিয়া ভাষা মূলত বাংলাভাষারই একটা প্রকরণ। ঐতিসিকভাবেই আসাম ছিল বাংলার সাথে সংযুক্ত, এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ইতিহাস ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার প্রাকৃতিক ভুগোল তাদের আলাদা করে নি, আলাদা করেছে কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভা নেতৃত্বের গোড়ামি। নয়তো বোস-সোহরাওয়ার্দী চুক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলে যুক্তবাংলার সৃষ্টি হত ১৯৪৭ সালেই, এবং ১৯৭১ সালের রক্তগঙ্গার কোন প্রয়োজন হত না।

প্রশ্ন যেখানে হিন্দুত্ববাদ মোকাবিলার, সেখানে ভাষা উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষের সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রধানতম হাতিয়ার হিসেবে ফিরে আসার সম্ভাবনা আবারও নতুন করে দেখা দিয়েছে।

পশ্চিমবাংলা-বাংলাদেশ ও আসামকে নিয়ে যদি অদুর ভবিষ্যতে বাংলাভাষার ভিত্তিতে একটি ইনক্লুসিভ কনফেডারেশন তৈরি করা যায় যা সমস্ত অন্য ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত অধিকারের সুরক্ষা দেবে এবং প্রত্যেক নাগরিককে তার ধর্মীয় আইন/প্রাদেশিক আইন/ ফেডারেল আইনের অধীনে ন্যায়বিচার গ্রহনের সুযোগ দিতে সক্ষম হবে, তবে উপমহাদেশের এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ১৯৪৭ সালের অন্যায্য দেশভাগ থেকে সৃষ্ট অস্বস্তি এবং হিন্দুত্ববাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে সৃষ্ট সাম্রাজ্যবাদী দাবানল থেকে মুক্তি পাবার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

এ অঞ্চলে তাই বাংলা ভাষাকে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা একবিংশ শতাব্দীর প্রতিটি বাংলাভাষীর রাজনৈতিক ওয়াজিবে পরিনত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন রুখতে বাংলা ভাষা হতে চলেছে প্রধানতম হাতিয়ার আর ভাষা আন্দোলন হতে পারে এই সংগ্রামের অনুপ্রেরনা।

Muhammad Sajal

পঠিত : ৬৬৫ বার

মন্তব্য: ০