Alapon

তালেবানরা কী চায়...?


২০১৮ সালে আমাদের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা শুরু করলে তার ফলাফল যে শূন্য হবে তা আমরা আগেই জানতাম। ১৮ বছরের যুদ্ধ ও শান্তি আলোচনার কয়েকটি নিষ্ফল উদ্যোগের পর আমেরিকার সদিচ্ছার প্রতি আমাদের বিশ্বাস ছিল না।

তবুও আমরা আরো একবার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে সবাইকেই ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছে। সাফল্যের সম্ভাবনা যত কমই হোক না কেন, আমরা মনে করি শান্তির জন্য কোনো সম্ভাব্য সুযোগকে উপেক্ষা করা বোকামি। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিন আফগান জনগণ তাদের মূল্যবান জীবন হারিয়েছে। প্রত্যেকে যার যার প্রিয়জনকে হারিয়েছে। সবাই যুদ্ধে ক্লান্ত। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মেছে যে এই খুনোখুনি বন্ধ করা জরুরি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিদেশী জোটের সাথে আমরা আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ শুরু করিনি। আমরা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমাদের সর্বপ্রথম দাবি বিদেশী সেনা প্রত্যাহার। আমরা আজ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি শান্তিচুক্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছি, এটি কোনো ছোট মাইলফলক নয়।

আমার সহকর্মী মোল্লা আবদুল গণি বারাদার এবং শের মোহাম্মদ আবাস স্টানিকজাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের প্রতিনিধি দলটি গত ১৮ মাস ধরে মার্কিন আলোচকদের সাথে একটি সফল চুক্তি করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। আমাদের গ্রামগুলোর উপর তীব্র বোমা হামলা এবং আমেরিকান পক্ষের টালবাহানায় বারবার বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা এই আলোচনায় যুক্ত ছিলাম। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন আলোচনা বন্ধ করেছিলেন, তখনো আমরা শান্তির দ্বার উন্মুক্ত রেখেছিলাম। কারণ যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় আফগান জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পারস্পরিক সমঝোতা ছাড়া শুধু এ জাতীয় রুদ্ধদ্বার আলোচনার দ্বারা কোনো শান্তি চুক্তি হয় না। আকাশ থেকে মৃত্যুর বৃষ্টিধারা নেমে এলেও আমরা এমন শত্রুর সাথে আলোচনা চালিয়ে গেছি দু দশক ধরে যাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে।এটিই শত্রুতার অবসানে আমাদের সদিচ্ছা এবং দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আমাদের প্রতিশ্রুতির সাক্ষ্য দেয়।

বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পরে আমাদের কী ধরনের সরকার হবে তা নিয়ে আফগানিস্তানের ভেতরের ও বাইরের উদ্বেগ এবং প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। এ জাতীয় উদ্বেগের বিষয়ে আমার বক্তব্য হল, এটি আফগান জনগণের ঐকমত্যের উপর নির্ভর করে ঠিক হবে। তবে আমাদের এই উদ্বেগ প্রথমবারের মতো বিদেশী আধিপত্য ও হস্তক্ষেপ থেকে সত্যিকারের আলোচনার মাধ্যমে মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে সরে যাওয়া উচিত নয়।
এটি গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো পূর্বনির্ধারিত ফলাফল এবং পূর্বশর্ত দিয়ে এই প্রক্রিয়াটিকে কেউ চাপিয়ে দেবে না। আমরা একটি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করব যেখানে প্রতিটি আফগানের কণ্ঠ প্রতিফলিত হবে এবং যেখানে কোনো আফগান বঞ্চিত বোধ করবে না। প্রকৃত সম্মানের সাথে পরামর্শমূলক পদ্ধতিতে অন্যান্য পক্ষের সাথে কাজ করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আমি নিশ্চিত যে, বিদেশী আধিপত্য ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তির পর আমরা একসাথে এমন একটি ইসলামী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব যেখানে সমস্ত আফগানের সমান অধিকার থাকবে, যেখানে ইসলাম অনুমোদিত নারী অধিকার, শিক্ষার অধিকার থেকে চাকরি করার অধিকার, সুরক্ষিত থাকবে। যেখানে যোগ্যতা হবে সমান সুযোগের মাপকাঠি।

আঞ্চলিক ও বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো দ্বারা আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহারের সম্ভাবনার ব্যাপারে উদ্বেগ সম্পর্কে আমরা সচেতন রয়েছি। তবে এই উদ্বেগ বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু নয়। আফগানিস্তানের বিদেশী গোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে সংবাদ কেবল চারপাশের যুদ্ধবাজ খেলোয়াড়দের রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অতিরঞ্জিত প্রোপাগান্ডা।

এই ধরনের কোনো দলকে আমাদের দেশ ছিনতাই করে তা যুদ্ধের ময়দানে পরিণত করার অনুমতি দেওয়াতে কোনো আফগানের স্বার্থ নেই। আমরা ইতোমধ্যে বিদেশী হস্তক্ষেপের কারণে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। নতুন আফগানিস্তান হবে স্থিতিশীলতার প্রতীক এবং আমাদের মাটিতে যেন কেউ নিরাপত্তাহীনতা বোধ না করে তা নিশ্চিত করতে আমরা অন্যান্য আফগানদের সাথে নিয়ে সকল পদক্ষেপ নেব।

আমরা সামনের আরো অনেক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন। সম্ভবত আমাদের বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ হল এটা নিশ্চিত করা, যেন বিভিন্ন আফগান গোষ্ঠী আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য কঠোর এবং আন্তরিকভাবে কাজ করে। আমি নিশ্চিত যে এটি সম্ভব। আমরা যদি কোনো বিদেশি শত্রুর সাথে চুক্তিতে পৌঁছতে পারি, তবে আমাদের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা অসম্ভব কিছু নয়।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হল শান্তিতে উত্তরণের সময় এবং বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আগ্রহী এবং ইতিবাচকভাবে সংযুক্ত রাখা। আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হবে।

আমরা দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পুনর্গঠনে আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে কাজ করতে প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্র তার সেনা প্রত্যাহারের পরে আফগানিস্তানের উত্তরোত্তর উন্নয়ন এবং পুনর্গঠনে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমরা সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব স্বীকার করি এবং তাদের উদ্বেগকে গুরুত্বের সাথে নিই। আফগানিস্তান দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকার সামর্থ্য রাখে না। নতুন আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে আমরা সমস্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব। এবং আমরা আশা করি যে অন্যান্য দেশগুলো আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্থিতিশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা রাখবে এবং একে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বের পরিবর্তে সহযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করবে।

অবিলম্বে আমাদের যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তাহলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের চুক্তি কার্যকর করার চ্যালেঞ্জ। কাতারের দোহায় আমেরিকান আলোচকদের সাথে আমাদের আলোচনার মাধ্যমে একটি আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন আমাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করে না, তেমনি আমরাও তাদেরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না।

আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তি সই করতে চলেছি এবং এর প্রতিটি বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চুক্তির সম্ভাব্যতা, এর সাফল্য এবং স্থায়ী শান্তি অর্জন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিশ্রুতি সঠিকভাবে পালন করার উপর নির্ভর করে। তারপরেই আমরা সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারি এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতার, এমনকি একটি পার্টনারশিপের ভিত্তিও স্থাপন করতে পারি।

আমার সহকর্মী আফগানরা শীঘ্রই এই ঐতিহাসিক চুক্তিটি উদযাপন করবে। এটি সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হয়ে গেলে আফগানরা সমস্ত বিদেশী সেনার প্রস্থান দেখতে পাবে। আমরা যখন এই মাইলফলকে পৌঁছেছি, আমি বিশ্বাস করি এটি খুব দূরের স্বপ্ন নয় যে আমরা শীঘ্রই সেই দিনটি দেখতে পাব যখন আমরা আমাদের সমস্ত আফগান ভাই-বোনদের সাথে একসাথে ঘরে ফিরব, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করব এবং একটি নতুন আফগানিস্তানের ভিত্তি স্থাপন করব।

তারপরে আমরা একটি নতুন দিনের সূচনা করব যখন আমাদের সকল দেশবাসীকে তাদের প্রবাস থেকে দেশে, আমাদের অভিন্ন বাড়িতে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানানো হবে। যেখানে প্রত্যেকেরই সম্মানের সাথে, শান্তিতে থাকার অধিকার থাকবে।

(নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তালেবানের ডেপুটি লিডার সিরাজুদ্দিন হক্কানির কলাম। অনুবাদঃ হাসান তানভীর)

পঠিত : ৫৬৮ বার

মন্তব্য: ০