Alapon

নামকরণে পরামর্শ – পর্ব এক

‘নামের বড়াই করোনাকো নাম দিয়ে কি হয়
নামের মাঝে পাবেনাকো সবার পরিচয়’

এটি একটি গানের কথা। কথাগুলো ক্ষেত্র বিশেষে হয়তোবা আংশিক সত্য, তবে Immutable কিছু নয়। যদি হতো তাহলে নামের বদলে সবত্রই সকলে নাম্বার ব্যবহার করতেন।

নামের মাঝে সবার পরিচয় না পাওয়া গেলেও আবার এ নামের মাধ্যমেই মানুষের গুণ বা চারিত্রিক ভিন্নতার কথাগুলো মানুষ জানতে পারে। উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে ‘আল ফারুক’, আবু বাকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে ‘আস সিদ্দিক’, যাইনাব বিনতু খুযাইমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কে ‘উম্মুল মাসাকিন’ বিশেষণ এরই প্রমাণ।

সুতরাং মানতে হবে, নামে অনেক কিছু হয়। নাম মানুষের আকীদা, আদর্শগত অবস্থান, জাতীর নিশানী এবং দ্বীন-এর পরিচয় ব্যক্ত করে। নামের ভেতরে মিশে থাকে মানুষের অনেক অভিপ্রায়, অনেক স্বীকারোক্তি। আর একারনেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে কেউ এলে তিনি তার নাম জিজ্ঞেস করতেন। পছন্দ হলে সন্তোষ্ট হতেন। আর না হলে নাম পরিবর্তন করে দিতেন।

ইসলামে নামের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কিয়ামাতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতাদের নামে। অতএব তোমাদের নামগুলো সুন্দর রাখো” (আবু দাউদ ৪৯৪৮, মুসনাদ আহমাদ ৫/১৯৪, ইবন হিব্বান ১৯৪৪। বর্ণনাকারী: আবু আদদারদা রা)

নামের তারতীব যেভাবে হওয়া উচিত:
কুরআন, সুন্নাহ মোতাবেক সন্তানের নামের পর তার পিতার নাম যোগ হওয়া জরুরী। আল্লাহ বলেন:
“(হে ইমানদারগন) তাদের পিতার পরিচয়েই তাদেরকে ডাকো, এটাই আল্লাহর দৃষ্টিতে অধিক ন্যায়সংগত” (সুরা আল আহযাব ৫)

অর্থাৎ নিজের নাম + পিতার নাম। যেমন: উমার ইবন আল খাত্তাব, উসমান ইবন আফফান, আলী ইবন আবী তালিব, উসামা ইবন যায়িদ, খালিদ ইবন আল ওলীদ, মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর, উমার ইবন আবদিল আযিয, খাদিজা বিনতু খুয়াইলিদ, আয়িশা বিনতু আবী বাকর, আসমা বিনতু আবী বাকর ইত্যাদি।
অবশ্য আরব দেশে অধুনা ‘ইবন’ শব্দ বাদ দিয়েও সরাসরি পিতার নাম বসানো হয়। যেমন: বাশীর শাকিব আল জাবেরী। এখানে ‘শাকিব’ বাশীর এর পিতা, ‘আল জাবেরী’ তাদের বংশীয় সম্বন্ধসুচক উপাধী। এবং আরও এরকম বহু নাম, যেমন, আবদুল্লাহ আবদুর রহমান আদ দাওসারী, তারিক আবদুল আযিয আল কাহতানী ইত্যাদি।

আরব দেশে পিতার নামের পর দাদার নাম, অত:পর সম্বন্ধসুচক লাকব বা উপাধী ব্যবহৃত হয়। এভাবে নামকরণের উপকারীতা হলো: এতে সনাক্তকরণে কখনোই কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এ সিষ্টেমই সেসকল দেশে চালু আছে।

কতিপয় অশুদ্ধ নাম:

আরবী ভাষা ও ব্যাকরণে দৈন্যদশা হেতু বাংলাদেশীদের নামের বিড়ম্বনা বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যারা অশুদ্ধ নাম নিয়ে আরব দেশসমুহে চাকুরী করতে গিয়েছেন তারা আমার এ কথার মর্মার্থ বুঝবেন।

আমার এক বন্ধুর নাম (জেদ্দায় তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন) জিল্লুর রহমান। সৌদী আরবে পা রাখার পুবেই তার নাম খলিলুর রহমান হয়ে যায়। (প্রথমে ভিসায়, পরে ইকামায়)। কারন কোনো মানুষের নাম জিল্লুর রহমান হতে পারেনা। আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ অনুযায়ী এ নাম অশুদ্ধ। নিয়োগকর্তা ফ্যামিলী ভিসার অনুমোদন দিলেও শুধুমাত্র এ নামের জটিলতার কারনে তিনি তার স্ত্রীকে সৌদি আরব নিতে পারেননি। কারন তার পাসপোর্টে ইংলিশে লিখা ছিলো ‘জিল্লুর রহমান’ আর ভিসা ও ইকামায় ছিলো ‘খলিলুর রহমান’। বাংলাদেশ এবং সৌদী আরব এ উভয় জায়গায় সমুদয় কাগজপত্র, সার্টিফিকেট, ভিসা পাসপোর্ট, ইকামা ইত্যাদিতে নাম পরিবর্তন কোনো সহজ কাজ নয়।

আর এক বন্ধুর (ইনিও জেদ্দায় আমার প্রতিবেশী ছিলেন) নাম ছিলো ‘নাবিউল হক’। এ নামটি সুস্পষ্ট হারাম। কারন এ নামের অর্থ: ‘সত্য নাবী’। তারও নাম পরিবর্তিত হয়ে যায়। পাসপোর্টে ছিলো ‘নাবিউল হক’ আর ভিসা ও ইকামায় লিখে দেয়া হয় ‘নাবিল’।

আর এক বন্ধুর (তিনি উম্মুল কোরা ইউনিভার্সিটিতে আমার সহপাঠী ছিলেন) নাম ছিলো ‘আবুল বাশার’। এ নামটি কেবলমাত্র আমাদের আদি পিতা আদাম আলাইহিস সালাম এর বিশেষণরুপে প্রযোজ্য। অন্য কারোর এ নাম রাখা অনুচিত। কারন এ নামের অর্থ ‘মানব জাতীর পিতা’ বা ‘মানুষের পিতা’। ইউনিভার্সিটিতে তার নাম ধরে কেউ ডাকলে সৌদীগন অবাক হয়ে, কেউবা কৌতুক করে তার দিকে তাকিয়ে বলতো ‘আ-আনতা আবুল বাশার’?

আর এক বাংলাদেশী বন্ধু (মাক্কায়) তার মেয়ের নাম রেখেছেন ‘আশারা মুবাশ্বিরা’। আশারাহ মুবাশ্বিরাহ অর্থ ‘সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন’। এ শব্দ দু’টু দিয়ে কি কারোর নাম রাখা যায়?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দশজন সাহাবীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, তাদেরকে একত্রে ‘আশারাহ মুবাশ্বিরাহ বিল জান্নাহ’ বলা হয়। যাহোক একবার তিনি তার এ মেয়ের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যান এবং সিরিয়ালে নাম লিখিয়ে বসে রইলেন। ডাক্তারের এসিস্টেন্ট আশারাহ মুবাশ্বিরাহ বুঝতে না পেরে (অর্থাৎ তার ধারণায়ও আসেনি যে, এটি কারোর নাম হতে পারে) শুধু মুবাশ্বিরাহ লিখে ওয়েটিং – এ থাকতে বলেন। তিন ঘন্টা পার হয়েছে, তার মেয়েকে ডাকা হয়না। অনেক কষ্টে তিনি এসিস্টেন্ট এর কাছে গেলেন। এসিস্টেন্ট রাগত স্বরে বললেন: ইয়া গাবি, নাদাইতুল ইসম সিত্তাহ মাররাত। খালাছ। ইনতাহা আদদাওয়াম (ওহে মুর্খ বোকা, তোমার মেয়ের নাম ধরে আমি ডেকেছি ছয়বার, আজকের মতো ডিউটি শেষ)।
মুবাশ্বিরা মুবাশ্বিরা বলে ছয়বার ডাকা হয়েছিল কথাটি মিথ্যা নয়। কিন্তু আমার বন্ধুটি বুঝতে পারেননি, তিনি তিন ঘ্ন্টা ধরে কান উৎকর্ণ করে ছিলেন – কখন ডাকা হবে আশারা মুবাশ্বিরা।

সৌদি আরবে আমার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে এমনি আরও বহু ভোগান্তির আমি সাক্ষী, যা লিখতে গেলে হয়তো একটি বড়ো বই হবে।
মানুষের নাম নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে একটি বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে। তাহলো, আমি দেখেছি, দুনিয়াজোড়া মানুষের নামগুলো বেশিরভাগই আসমানী কিতাব থেকে ধার করা অর্থাৎ বিকৃতি যতই ঘটুক, নামের উসুল অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, নামটির উৎস হচ্ছে আসমানী কিতাব বা নাবী রাসুল। ইয়াহুদীদের বহু নাম বানু ইসরাইলদের নিকট আগত নাবীদের নামে। যদিও তা বহুলাংশে বিকৃত। এতে আল্লাহ তায়ালার কথাই সত্য প্রমাণীত হয়। ‘তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, অত:পর তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন’ (সুরা আর রাহমান ৩-৪) ‘তিনি মানুষকে কলম দ্বারা শিখিয়েছেন। তিনি ইনসানকে এমন কিছু শিখিয়েছেন যা (তিনি না শেখালে) সে জানতোনা’ (সুরা আল আলাক্ক ৪-৫) অর্থাৎ আল্লাহ যদি করুণা করে কিতাবাদি না পাঠাতেন, বিদ্যা শিখানোর এ কাজটি যদি তিনি নিজে না করতেন তাহলে এ পৃথিবীতে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির মধ্যে কোনো পার্থক্য হয়তো থাকতোনা।
আমি আরও দেখেছি - কুরআনের আদেশ নিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করেননা এমন লোকেরাও কুরআন থেকে অথবা নাবী রাসুলদের নামে নাম রাখেন।

আবার কেউ কেউ নামের শেষে ‘নবী’ শব্দ যোগ করেন। নবী শব্দের অর্থ জানেনা এমন লোক কি বাংলাদেশে এখনও আছে? কেউ রাখেন “নাবিউল্লাহ নাবী”। ‘নাবিউল্লাহ’ অর্থ ‘আল্লাহর নাবী’। এ নাম কিভাবে জায়েয হয়?

আর একটি হারাম নাম হচ্ছে ‘খাইরুল বাশার’। খাইরুল বাশার অর্থ ‘সবশ্রেষ্ট মানব’। এটা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি বিশেষণ। এ বিশেষণ অন্য কোন মানুষের জন্য ব্যবহার করা হারাম এজন্যে যে তার মতো এমন চারিত্রিক সুষমা এ পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো মানবের নেই। কখনো হবেনা।

কোনো মানুষের নাম ‘শাইখুল মাশায়েখ’, রাখাও সঠিক নয়। ‘শাইখ’ একটি বিশেষ পদবী বা বিশেষণ। এ বিশেষণ কুরআন-সুন্নাহ, হাদীস শাস্ত্র প্রভৃতিতে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ব্যক্তিগন পেয়ে থাকেন। ইমাম বুখারী এবং ইমাম মুসলিমকেও শাইখ বলা হয়। হাদীস শাস্ত্রে তারা দু’জন শাইখাইন হিসেবে পরিচিত। আরব দেশে বৃদ্ধ ব্যক্তিগনকেও শাইখ বলে সম্বোধন করা হয়। কয়েকটি হাদিসেও বৃদ্ধাবস্থা বোঝানোর জন্য ‘শাইখ’ বা ‘শাইখুখাহ’ শব্দের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।

‘মুরসালিন’ শব্দের অর্থ ‘প্রেরিত রাসুলগন’। এটি কুরআনের একটি শব্দ। কুরআনে থাকলেই নাম হিসেবে গ্রহণ করা যায়না।

‘আজমাঈন’ নাম রাখাও সঠিক নয়। আরবীতে বহুবচন বুঝাবার জন্য আজমাঈন ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘ইলা আসহাবিহি আজমাঈন’ (সকল সাহাবীগনের প্রতি)।

‘শাহেন শাহ’ ‘খাইরুল আনাম’ ‘আবদুল আলী’ ‘আবদুন নবী’ ‘গুলাম রসুল’ ‘গুলাম নবী’ ‘গুলাম কাদের’ ‘গুলাম মুহাম্মাদ’ ‘আবদুন নুর’ ইত্যাদি নামকরনও জায়েয নয়।

নামের শেষে ‘ইলাহী’ যোগ করাও মারাত্বক ভুল। কারন ‘ইলাহী’ (ইলাহ মুবতাদা + হী খবর)শব্দটির অর্থ ‘আমার ইলাহ’ বা ‘আমার প্রভু’। কারোর নাম যদি মাহবুব ইলাহী রাখা হয় তাহলে অর্থ দাড়ায়: মাহবুব আমার ইলাহ।

নামের আগে ‘মুহাম্মাদ’ লিখা ভালো বা লিখতে হবে – এ চেতনার স্বপক্ষে কোনো সহীহ হাদীস খুজে পাওয়া যায়না। সাহাবীদের জীবনেতিহাসেও এধরণের প্রথার কোনো নজীর নেই। খাইরুল করুনের লোকেরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আমাদের চেয়ে হাজার গুণ বেশী ভালবাসতেন কিন্তু তথাপিও তারা এভাবে নামকরণ করতেননা। তারা শুধু ‘মুহাম্মাদ’ রাখতেন। তারা জানতেন, মুহাম্মাদ, আহমাদ, আবদুল্লাহ ইত্যাদি আলাদা আলাদা নাম। আমাদের দেশ থেকে মুহাম্মাদ আবদুর রাযযাক – আরব দেশে গেলে আরবরা মনে করে ‘মুহাম্মাদ’ তার নাম, আর আবদুর রাযযাক হচ্ছে তার পিতা।
(চলবে)

পঠিত : ১০০৮ বার

মন্তব্য: ০