Alapon

আমাদের দেশের একেকটা ইউনিভার্সিটি হল ভবিষ্যতের ভোক্তা তৈরির কারখানা!


এক.

সিড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠছিলাম, সামনে পড়ে গেল কতগুলি মেয়ে। কিচির মিচির করতে করতে তারা এগিয়ে আসছিল করিডোর ধরে, গন্তব্য ঠিক কোথায়, বুঝতে পারলাম না। তাদের গন্তব্য কোথায় হবে তা আমার বোঝা দরকার কিনা তাও আমি বুঝতে পারলাম না, কারন ক্যাম্পাসে এটাই আমার প্রথম দিন।

আমার সাথে ভর্তি হওয়া ছেলেপেলেদের শুনেছি আমাদের ডিপার্টমেন্টে নাকি সিনিয়ররা নতুন ফার্স্ট ইয়ারে ওঠা ছেলেপেলেকে কড়া র‍্যাগ লাগায়। এজন্য আগেই তৈরি হয়ে এসেছি একটা কালচে সবুজ চাদর গায়ে দিয়ে, চুল একটু উসকো খুসকো আমার এমনিতেই থাকে, আজকের দিনের প্রস্তুতির অংশ হিসাবেই আগের এক সপ্তাহ দাড়ি কাটি নি। আমার বিখ্যাত চাপদাড়ি। এই দাড়ি দেখিয়েই কলেজ সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে ফার্স্ট ইয়ারের সাথে ভাব নিতাম, আর মহল্লায় যেসব বড় ভাইদের দাড়ি ওঠে না, তাদের সামনে অকারনে দাড়ি চুলকে বোঝাবার চেষ্টা করতাম, আমি আপনাদের চাইতেও বেশি পুরুষ হয়ে গেছি।

চাদর আর দাড়ির কম্বিনেশনটা ম্যাজিকের মত কাজে দিল। কিচির মিচির করতে থাকা মেয়েগুলি ভাবলো আমি কোন সিনিয়র ভাই, মুহুর্তের মধ্যে এক লাইনে এসে তারা আমাকে সালাম দিয়ে বসলো। প্রথম ধাক্কায় আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও সাথে সাথে গলা যথাসম্ভব ভারী করে জবাব দিলাম, ওয়ালাইকুম আসসালাম। সবাই ভালো??

বলেই প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাটলাম করিডোর ধরে, চোয়ালজোড়া বন্ধ, চোখেমুখে গাম্ভীর্য থই থই করছে। আমার ক্লাস ৩০১ নম্বর রুমে।

ক্লাসে ঢুকে বুঝলাম একটা ভুল হয়ে গেছে।
ছয় সাতটা মেয়ের মধ্যে অন্তত দুজন সুন্দরী ছিল বলেই আমার ধারনা। বেশি ভাব নিতে গিয়ে কারো দিকেই সেভাবে তাকাতে পারি নি। এই দেশে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে যেসব ছেলে প্রেম করতে না পারে তাদের আতেল ভাবা হয়। কলেজ লাইফে বার কয়েক বেলাইনে ট্রেন চালালেও আমি আদৌ কোন প্রেম করতে পারি নি, এর মূল কারন কি তা আমার পক্ষে কোনমতেই বের করা সম্ভব হয় নি। কারন যাই হোক, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এসে প্রেম না করতে পারলে এবার আর কোথাও মুখ দেখানো যাবে না।

সুযোগ পেলে ঐ মেয়েগুলোকে আবার দেখা যাবে ভেবে ক্লাসের ওপর একটু নজর বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। আমাদের ইউনিভার্সিটি দেশসেরা ইউনিভার্সিটিগুলোর একটা। এখানে দেশের ভেতর থেকে তো বটে, বাইরে থেকেও পড়তে আসে অনেক ছাত্রছাত্রী। এরমধ্যে আবার আমাদের ডিপার্টমেন্ট আরো নামকরা। প্রতিবছর বাছাই করা পঞ্চাশজন ছাত্রছাত্রী এখানে পড়ার সুযোগ পায়।

দেখে মনে হল,বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে এই শহরের না। রাজধানীর বাইরে থেকে এসেছে এরা। তবে এই শহর থেকে আসা ছেলেমেয়ের সংখ্যাও একেবারে কম না। পঞ্চাশ জনের প্রায় অর্ধেকই রাজধানীর বাসিন্দা। বড় শহরের ছেলেমেয়েরা সাধারনত অন্যান্য শহরের চেয়ে ভাল স্কুল আর কলেজে পড়ার সুযোগ পায়। ফলে তাদের পড়াশোনার গোড়াটা মজবুত হয়, সেরা ভার্সিটিতেও তাই তারাই বেশি টেকে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে সেই মেয়েগুলিই কিচির মিচির করতে করতে ক্লাসে এসে ঢুকে পড়লো!!
খাইসে!! এরা দেখি আমার ক্লাসমেট!!

দুই.

আড়চোখে অনেকেই আমাকে খেয়াল করেছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসে এই পরিমান ভারিক্কি নিয়ে কেউ ঢুকলে তাকে সিনিয়র ভাই ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছু না। আমাকেও প্রথম দেখায় যে কেউ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র বলেই মনে করবে। পেটানো শরীর আর চওড়া কাধের সাথে মানিয়ে গেছে ঘাড় ছুয়ে নিচে নামতে থাকা লেয়ার কাট চুল, মোটা জুলফি হাইওয়ের মত নেমে গেছে কানের পাশ দিয়ে, এরসাথে চাপদাড়ি আর ঝুলওয়ালা চাদর মিলে একটা পারফেক্ট প্যাকেজ হয়েছে। আমার মনে হয় না কোন সিনিয়র ভাই আমাকে ফার্স্ট ইয়ার হিসেবে চিনতে পারবে।

প্রথম দিন ক্লাস হওয়ার কথা ছিল তিনটা। দুইটা ক্লাসের পর জানা গেল আর ক্লাস হবে না। ক্লাস হবে না শুনেই একটা খাটোমত লেদার জ্যাকেট পরা ছেলে ডায়াসে উঠে বললো, আজকে যেহেতু ক্যাম্পাসে আমাদের প্রথম দিন, তাই আজকে আমরা একসাথে সবাই মিলে লাইফ সায়েন্স বিল্ডিংয়ের বিপরীতে থাকা পার্কে আড্ডা দেবো।

আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

পার্কের ভেতর সুন্দর রোদ পড়েছে, জানুয়ারী মাসের দুপুরে পনেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মিঠে রোদ। উত্তুরে হাওয়া এসে মাঝে মাঝে কামড় বসাচ্ছিল আমাদের গায়ে।

দুই সারি দেবদারু গাছের মাঝখানে থাকা প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা আর পচিশ ফুট চওড়া একটা জায়গায় ঘাসের ওপর কিছুটা রোদ পড়েছে। ওখানেই বসে গেলাম আমরা পচিশটা ছেলেমেয়ে।
আমাদের ভেতর দুজন গীটার নিয়ে এসেছে। ওরা গীটার বাজাতে পারে। গীটার যারা ভালো বাজায় তাদের জন্য মেয়েরা দিওয়ানা থাকে এমন কিছু ধারনা কলেজে থাকতে আমাদের ভেতর ছিল। ধারনাটা মনে হয় মিথ্যা না।
শহরের ছেলেগুলি সবাই কমবেশি ফিটফাট হয়ে এসেছে, মেয়েগুলিও। বেশিরভাগের পরনে জিন্স, টি শার্টের ওপর লেদার জ্যাকেট বা উলেন হুডি, পায়ে কেডস। মেয়েদের কারো কারো গায়ে সালোয়ার কামিজের সাথে মাথায় ওড়না, কেউ আবার বোরকাও পরেছে। ছেলেদের ভেতর কয়েকজন একটু হুজুর টাইপ, জোব্বা পরেছে। এই রকম জোব্বা পরা ছেলেরা সাধারনত তাবলীগ করে অথবা মাদ্রাসা থেকে আসে। জিন্সওয়ালারা বেশিরভাগ মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলে, লেদার জ্যাকেট আর কেডসের ব্র‍্যান্ড দেখে বোঝা যায় কেউ কেউ ধনীর দুলালও। মেয়েদের ভেতর বোরকাওয়ালীদের সোশ্যাল ক্লাস বোঝা যাচ্ছিল গায়ের শাল দেখে, আর বাকিদের ক্ষেত্রে ভ্যানিটি ব্যাগে। ইউনিভার্সিটির প্রথম ক্লাসের দিন কেউই চায় না তাকে খারাপ দেখাক।

আমাদের আড্ডা শুরু হল পরিচয়ের মাধ্যমে।
ক্লাসটা যে বারো রকম মানুষের আখড়া হতে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছিল। এখানে আছে দিনমজুরের সন্তান থেকে শুরু করে টপক্লাস সরকারী চাকুরের ছেলেমেয়ে সবাই।

কিন্তু কোন বিজনেস টাইকুন বা মন্ত্রী-এমপির ছেলেমেয়ে নেই।
ব্যাপারটা প্রথম যে খেয়াল করলো সে একটা নীল বোরখা পরা মেয়ে। লম্বায় পাচ ফুট চার ইঞ্চির মত, চোখে হালকা কাজল দেয়া। মাথার নীল হিজাবে রোদ পড়ে জরির মত চমকে উঠছে কপালের পাশের দিকে, তার নিচ দিয়ে চুরি করে উকি দিচ্ছে অল্প কিছু চুল।
মেয়েটার সারা শরীরের ভেতর কেবল নাকের আধেকটা, আর চোখজোড়া দেখা যায়, বেশ গভীর দু'চোখের ওপর থাকা কালো ভ্রুতে যেন ডানা মেলেছে কোন এক অদৃশ্য ঈগল।
ডান চোখের ওপরের ভ্রু তুলে মেয়েটা বেশ চড়া গলায় বললো, 'তোমরা একটা জিনিস খেয়াল করে দেখসো??'

'কি জিনিস??' আমরা বললাম।

'এখানে অনেক পেশার মানুষের ছেলেমেয়েই আছে কিন্তু কোন শিল্পপতি বা মন্ত্রী-এমপির ছেলেমেয়ে নাই।'

আমরা একে অন্যের দিকে তাকাতে থাকলাম। 'বাহ!! ভাল ফাইন্ডিংস তো!!'

'ওনারা জানেন ওনারা যে সিস্টেম তৈরি করে রেখেছেন সেখানে পড়াশোনাটা বাদে বাকি সব কিছু হয়। তাই এই দেশের ইউনিভার্সিটিতে তাদের ছেলেমেয়ে পড়ে না আর এই দেশের হসপিটালেও তারা চিকিৎসা নেন না।'

আমাদের দেশের একেকটা ইউনিভার্সিটি হল ভবিষ্যতের ভোক্তা তৈরির কারখানা। এখানে ছাত্রদের যতটা না পড়ালেখা শেখানো হয় তার চেয়ে বেশি শেখানো হয় ভোগবাদ। ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ভোগে ডুবিয়ে দিয়ে এই সিস্টেম যারা তৈরি করেছে তারা নিজেদের ছেলেদের পাঠাচ্ছে ক্যাম্ব্রিজ-অক্সফোর্ড-হাভার্ডে ডিগ্রী নিতে, যাতে ভোগে মত্ত আমজনতার বংশধরদের নিজেদের ক্যাম্ব্রিজ ফেরত বংশধরদের দিয়ে পুরুষানুক্রমে দাসত্ব করিয়ে নেয়া যায়।

@Muhammad sajal

পঠিত : ৪৪০ বার

মন্তব্য: ০