Alapon

উসমানি খিলাফতের সমাপ্তিঃ একটি সভ্যতার পতন...


সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কতৃক ইস্তাম্বুল বিজয়ের পরবর্তীকালে সুলতান সেলিম (১ম সেলিম) এবং সুলতান সুলেমান (সুলেমান দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট) বিশ্ব বিজয়ের যে জোয়ার শুরু করেছিলেন, তা উসমানি খেলাফতকে বিশ্বের সেরা পরাশক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল। ইস্তাম্বুল দুনিয়ার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। শিক্ষা - সাহিত্য, বিজ্ঞান-গবেষণা, অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তিতে বলিয়ান উসমানী খিলাফত ছিল ওই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতা। একের পর এক জয় উসমানি খিলাফতের মানচিত্র যেমন বৃদ্ধি করেছিল, তেমনি বৃদ্ধি করেছিল এর নৈতিক ও সামরিক শক্তি। এমতাবস্থায় এই সুপার পাওয়ারের সামনে দুনিয়ার কোনো শক্তি এসে দাঁড়াতে সাহস করেনি।

আঠারো শতকের শেষ দিকে এসেও উসমানী খেলাফতের সীমানা ছিল প্রায় পুরো বলকান অঞ্চল (আজকের সার্বিয়া, বসনিয়া, কসোভো, মেসেডোনিয়া, আলবেনিয়া, গ্রিস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়ার অধিকাংশ এলাকা), আনাদুলু (আজকে তুরস্ক) এবং আরব বিশ্ব তথা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (আজকের লিবিয়া, জর্দান, ইসরাইল, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরবের বিশাল অংশ, মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া) জুড়ে।

কিন্তু সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপে রেনেসাঁ, এনলাইটেনমেন্ট এবং পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স বিপ্লবের ধাক্কা উসমানী খিলাফতেরও এসে লাগে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমরাস্ত্রে পশ্চিমাদের উন্নতির এই সময়ে উসমানিয়রা পিছিয়ে পড়ে। আর পশ্চিমাদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন মতবাদ যেমনঃ লিবারেলিজম, সেকুলারিজম সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক তত্বগুলোর প্রভাব উসমানী খিলাফতেও হানা দেয়। এসময় উসমানী খিলাফতের সুলতানরা বেশ কিছু সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।বলাবাহুল্য, এই সংস্কার কার্যক্রমগুলোর তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁ কিংবা পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৯ সালে সুলতান মাহমুদ-২ এর গৃহীত কার্যক্রম ছিল মূলত উসমানী খিলাফতে পশ্চিমা তত্ত্বের প্রথম বাস্তবায়ন। 'তানজিমাত' তথা সংস্কার নামের এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী, কেন্দ্রীয় সরকার পদ্ধতি,কর পদ্ধতি ও প্রাদেশিক শাসন পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। তানজিমাত বা সংস্কারের এই প্রোগ্রামে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কর্মসূচী ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রণয়ন। ইউরোপীয় শিক্ষা পদ্ধতির আলোকে উসমানী খিলাফতের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়।


উনিশ শতকের শেষ দিকে এসে জাতীয়তাবাদের উত্থান ও জাতি রাষ্ট্রের ধারণা প্রকট হলে উসমানী খেলাফতেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্র তথা জনগণের নিকট শাসনের ভার অর্পণে উসমানী শাসকদের উপর চাপ বাড়তে থাকে। এরই পরিপেক্ষিতে সুলতান আব্দুল হামিদ খান সানী ১৮৭৬ সালে "কানুনে এসাসি" নামে উসমানী খিলাফতে প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করেন। যাতে দুটো সংসদ তথা আইনসভার রুপরেখা পাস করা হয়। প্রথমত 'মজলিস-ই-আয়ান' যার সদস্যরা সুলতান কর্তৃক নির্বাচিত হবেন এবং আমৃত্যু সদস্য থাকবেন। দ্বিতীয়ত 'মজলিস-ই-মেবুসান' যার সদস্যরা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। মজলিস-ই-আয়ানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাহী বিভাগে সুলতানের পাশাপাশি দায়িত্বে থাকবেন। তবে এই সংবিধানেও সুলতানকে নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভার কেন্দ্রবিন্দু করা হয়। নির্বাহী বিভাগ তার কাজের জন্য সুলতানের নিকট জবাবদিহি করতে যেকোনো সময় আইনসভা ভেঙে দিতে পারতেন।

প্রথম সংবিধানের এই সময়কে তাত্ত্বিকরা মেসরুতিয়েত তথা লেজিটিমেসি-০১ বলে সম্বোধন করেন। যদিও সংবিধান কার্যকরের এক বছরের মাথায় উসমানী খেলাফত-রাশিয়া যুদ্ধের (নাইনটি থ্রি'র যুদ্ধও বলা হয়) সুলতান আব্দুল হামিদ খান সেই সংবিধান বাতিল করেন।

তথ্যসূত্রঃ ১। এরদোয়ানঃ দ্য চেঞ্জ মেকার, হাফিজুর রহমান, গার্ডিয়ান পাবলিকেশনস।

২।মুসলিম প্রশাসন ব্যবস্থার ইতিহাস, মাহবুবুর রহমান, মেরিট প্রকাশনী।

৩। উসমানী সাম্রাজ্যের ইতিহাস, ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবী, মুহাম্মদ পাবলিকেশন।

৪। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, অধ্যাপক এ.বি.এম হোসেন, উপমা প্রকাশন।

৫। আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য ১ম খন্ড, সফিউদ্দিন জোর্য়াদার, বাংলা একাডেমি।

nazmul Sarkar Ashiq

পঠিত : ৮৬০ বার

মন্তব্য: ০