Alapon

ইদলিব সিজফায়ারঃ জিতলো কে, হারলো কে??


এইটা কুরবানীর হাট থেকে গরু কেনা না, এইটা আন্তর্জাতিক রাজনীতি। জয়-পরাজয় এখানে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট হয়ে আসে না। ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাকে জিতেছিলো, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে। তারপর?? এখন সেটাকে আপনারা কি বলবেন??

ইরাক-আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয়ের হিসাব সিরিয়ায় তুর্কীর ক্ষেত্রে স্বভাবতই খাটে না। এই লেখার উদ্দেশ্য, ইদলিব সিজফায়ার থেকে কে কি পেল, তা বোঝার চেষ্টা করা।

প্রায় সমস্ত বিশ্লেষণে, এমনকি আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকাগুলির বিশ্লেষণেও সিরিয়া সংকটকে এখন দুই ফ্রন্টওয়ালা ওয়ার জোন হিসেবে দেখা হয়, যার দুই নম্বর ফ্রন্ট হল লিবিয়া। আই মিন, সিরিয়া ও লিবিয়া দুটো ফ্রন্ট হলেও একই যুদ্ধ এখানে চলছে, মূল দ্বৈরথ রাশিয়া ও তুর্কীর স্বার্থের দ্বৈরথ।

এই লড়াইয়ের আরেকটা সক্রিয় ফ্রন্ট আছে, যা কেউ উল্লেখ করছে না বা আলাদাভাবে উল্লেখ করছে, তা হল গ্রীস। আমি সমর বিশারদ নই, ভুরাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে একটু আধটু যা জানি তা থেকেই লিখতে চেষ্টা করি। আমার ভুরাজনীতির জ্ঞান যা আছে তা আমাকে ইশারা দেয়, লিবিয়া যেমন সিরিয়া ফ্রন্টের সাথে জড়িত, একইভাবে জড়িত গ্রীস, কেননা বিশ্বরাজনীতির পরবর্তী হটস্পট হল পূর্ব ভূমধ্যসাগর বা ইস্টমেড, ডিউ টু ইটস হিউজ রিজার্ভ অফ হাইড্রোকার্বন।

যাক, লেখা অতিরিক্ত লম্বা না করে মূল হিসাবে আসা যাক।

এটা পরিষ্কার, এই সিজফায়ারে এরদোয়ান সুবিধা করে উঠতে পারেন নি।
কেন তিনি এখানে সুবিধা করতে পারবেন??
রাশিয়ার সাথে যতগুলি কার্ড এরদোয়ানের হাতে ছিল, সব ব্যবহার করে ফেলেছিলেন তিনি এক এক করে। না করে তার উপায়ও ছিল না। এই মুহুর্তে বিশ্বরাজনীতির গ্র‍্যান্ডমাস্টার ভ্লাদিমির পুতিন ২০০৭ সাল থেকেই একটু একটু করে ন্যাটোকে দুর্বল করার নিয়তে আগাচ্ছিলেন, ২০১৫ সালের পর তিনি একের পর এক মাস্টারস্ট্রোক খেলে ন্যাটোকে অফিসিয়ালি ইনইফেক্টিভ একটা সাদা হাতীতে পরিনত করেছেন। রাশান ফেডারেশান অনলি কেয়ারস এবাউট ইউএসএ, ফর ইটস মিলিটারি, এন্ড ইকোনমিক সুপিরিওরিটি। ইউরোপকে রাশিয়া গোনে না।

২০১৭ থেকে, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়া সচেতনভাবেই ট্রাম্পের আইসোলেশনিস্ট ফরেন পলিসির সুযোগে ইউরোপে নর্দস্ট্রিম ও নর্দস্ট্রিম টু ডিল করেছে, এবং তুর্কীর সাথে করেছে তুর্কস্ট্রিম। ফ্রান্স-জার্মানী-ইতালি-তুর্কী এই সবকটা রাষ্ট্র এখন অর্থনৈতিকভাবে রাশান জ্বালানীর ওপর নির্ভরশীল এবং আমেরিকার এখানে কিসসু করার নাই। তুর্কী ইজরায়েলের সাথে জেরুসালেম ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে গিয়ে গ্লোবাল ইকোনমিক এলিটদের রোষানলে পড়েছে, রোষানলে পড়েছে ট্রাম্পের এবং ট্রাম্প রীতিমত ঘোষনা দিয়ে তুর্কীর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ইকোনমিক ওয়ারফেয়ার করেছিল, যা থেকে উঠে আসতে তুর্কীকে সহায়তা করেছে রাশিয়া। এখানেও ক্রেডিট পুতিনের। ট্রাম্প গভীরভাবে পুতিন প্রভাবিত, তার প্রজাতির অন্যান্য পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের মতই।

এভাবে, পুতিন ২০১৬-২০১৯ সালে কোর ন্যাটো মেম্বারদের নিজের পকেটে পুরে ন্যাটোকে ডিসফাংশনাল করেছে। এবার এটা প্রমাণ হল, ন্যাটো ইজ নো মোর আ ডেটারেন্ট ইন ফ্রন্ট অফ দ্যা রাশান জারডম। সামনে আমেরিকায় ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় আসবে এবং এবার ন্যাটোর ইউরোপিয়ান মেম্বাররা বাধ্য হবে তুর্কীর সাথে এলায়েন্স করতে, যদিও তারা তুর্কীকে সহ্য করতে পারে না।
কেন ইউরোপ তুর্কীর সাথে এলায়েন্স ফোর্জ করবে??
কারন, বাল্টিক। রাশিয়া-ইউরোপের মধ্যে নেক্সট জিওপলিটিক্যাল ব্যাটলগ্রাউন্ড হল বাল্টিক অঞ্চল, এবং এব্যাপারে সব বিশেষজ্ঞ একমত যে বাল্টিকে রাশিয়াকে ঠেকাবার মত প্রস্তুতি ইউরোপের নাই। ইউরোপের মিলিটারিগুলি সাদা হাতী প্রকৃতির, অপারেশনাল না। ন্যাটোতে অপারেশনাল ফোর্স দুইটা, ইউএসএ, আর তুর্কী। যেহেতু ইউএসএ কন্টিনেন্টাল ইউরোপের সাথে রাশান থ্রেট শেয়ার করে না, কিন্তু তুর্কী করে, এখানে ট্রাম্প থাকা অবস্থায় তুর্কীর সাথেই এলায়েন্স করতে হবে ইউরোপের। এই বাস্তবতার মুখে দাড়ায়ে আছে বলেই মের্কেল বা ম্যাক্রন এখনো এরদোয়ানকে তাদের দেশে ঢুকতে দেয়। নাহলে ইউরোপের ভোটের রাজনীতিতে এখন ফার রাইটদের যে জয়জয়কার, এরদোয়ানের সাথে সাক্ষাত করাও সেখানে পাপ বলে বিবেচিত হওয়ার কথা।

ট্রাম্প, এবং তারচেয়েও বেশি ওবামার মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারনে তুর্কীকে সিরিয়ায় জড়িয়ে পড়তে হয়। তুর্কী যদি সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সাথে কোলাবোরেট করতো, ২০১১ সালেই তাকে রাশান ব্লকে ঢুকে যেতে হত যা তাদের জন্য সেসময়ের পরিস্থিতিতে অসম্ভব ছিল।
কিন্তু, সিরিয়াতে এরদোয়ানের নীতি শুধু মার্কিন নীতির অনুসরন না। সিরিয়া-ইরাক-ইরান-মিসর সহ মিডল ইস্ট নিয়ে তুর্কীর নিজস্ব নীতি আছে।

ইদলিব সিজফায়ার হওয়ার আগের পাচ থেকে সাতদিনে তুর্কী আসাদের সেনাবাহিনীর ওপর যে আঘাতটা হেনেছে, তা বিবেচনায় নিলে আমাদের বলতে হবে এই সিজফায়ারের ক্লজগুলি বলছে তুর্কী পিছু হটেছে।

বাস্তবতা হল তাদের পিছু হটতেই হত। তুর্কী একা রাশিয়ার সাথে কোন কনভেনশাল যুদ্ধেই জিততে পারবে না, তার ওপর রাশিয়া নিউক্লিয়ার পাওয়ার। কিন্তু, একটা রাশান-তুর্কী ওয়ার একপেশে হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই যতক্ষণ না রাশিয়া তার নিউক ব্যবহার করে। লড়াইটা হবে বাঘে-মহিষে লড়াই এবং পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সমরপ্রবণ দুটো জাতির মধ্যে লড়াই। দুটো দেশের অর্থনীতিই পঙ্গু হয়ে যাবে, বিশেষভাবে রাশান মিসাইল ও এরিয়াল এবিলিটি বিবেচনায় নিলে তুর্কী চুরমার হয়ে যাবে। এইটা ১৯১৯-১৯২২ সালের হিসাবে হবে না, কারন সেকালে কারোই হান্ড্রেডস অফ ফাইটার জেট ছিল না, মিসাইল ওয়ারফেয়ার ছিল না।

রাশিয়ার সাথে তুর্কী তাই কেবলমাত্র ডিফেন্সিভ মিলিটারি স্ট্র‍্যাটেজিই নিতে পারে যতক্ষণ না তার নিউক্লিয়ার পাওয়ার হাতে আসে।

অতএব, তুর্কী অবশ্যই রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে যাবে না।

আসাদের ধৃষ্টতা তুর্কীকে তাকে শায়েস্তা করতে বাধ্য করেছে। আসাদ তার গোটা সামরিক সামর্থ্যের প্রায় ১৫% হারিয়েছে গত দশদিনে। হিযবুল্লাহ ও অন্যান্য ইরান ভিত্তিক মিলিশিয়ারাও হেভিলি ডিপ্লেটেড হয়েছে।

তুর্কী কিছু ড্রোন হারিয়েছে, সম্ভবত চারটা হেলিকপ্টার, কয়েকটা ট্যাংক-আর্মড ভেহিকেল ও সব মিলিয়ে একশোরও কম সৈন্য তুর্কীর জন্য বড় কোন ক্ষতি নয়। এর বিনিময়ে তুর্কী ইদলিবে অবস্থান নেয়া প্রায় এক লাখ যোদ্ধাকে অক্ষত রাখার ম্যান্ডেট নিয়েছে রাশিয়ার কাছ থেকে। এর মধ্যে একটা বড় অংশ আছে হায়াত তাহরীর আল শাম তথা সিরিয়ান আল কায়েদা। এটা অবশ্যই সবাইকে মেনে নিতে হবে যে এই মুহুর্তে লড়াইয়ের ময়দানে আসাদ বাহিনীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জিহাদী গ্রুপগুলিকে মোকাবিলা করা।
তুর্কী ইদলিবের ওপর রাশান প্লেনের ওড়াওড়ি বন্ধ করতে পারার সাথে সাথে এখন ইদলিবে নতুন করে ব্যাপক যুদ্ধপ্রস্তুতি নিচ্ছে, যা সামনের লড়াইগুলোতে কাজে আসবে।

এই সিজফায়ারের ফলে পরবর্তী যুদ্ধ আরো অনেক বেশি হাই ক্যাজুয়ালটি হওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া গেল। উভয়পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানকে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করছে।

এম ফোর সহ সারাকিব ছেড়ে দেয়ায় অনেকে এরদোয়ানের ওপর হতাশ, আমি নিজেও। যুদ্ধ যে জায়গায় ছিল, সেখানে এম ফোর না ছাড়লেও এরদোয়ান পারতেন বলে আমার মনে হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে হয়তো ডিলটাই হত না, রাশিয়ার সাথে মুখোমুখি যুদ্ধের আরো কাছাকাছি চলে আসতো তুর্কী।
আমার বহুবার মনে হয়েছে ইজরায়েল, আমেরিকা এবং ইরান ঠিক এটাই চায়।

এবারের মত বাশার আল আসাদ এরদোয়ানের হাত থেকে পিছলে গেছে, ভবিষ্যতে তুর্কীর সাথে বাড়াবাড়ি করতে হলে তাকে পরিনতি মাথায় নিয়েই আগাতে হবে।
ওদিকে এরদোয়ান পিছলে গেছেন একটা ইজরায়েলী প্লট থেকে। ২০১৫ সালে রাশান জেট ফেলে দেয়ার পর থেকে বহুবার রাশিয়া-তুর্কীকে মুখোমুখি লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে ইজরায়েল।
রাশিয়া নিজেও তুর্কীর সাথে সুসম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়, কারন তুর্কীর সস্তা সবজি আর কৃষিপণ্য পুতিনকে নিজ দেশের বাজারে খাবারের দাম কমিয়ে রাখতে সহায়তা করে।

এই ডিলের মাধ্যমে তুর্কী-রাশিয়া আরেকটি পক্ষকে সিরিয়া সংক্রান্ত হিসাব নিকাশ থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে, ইরান।

তুর্কী এবার ক্রমেই এসডিএফের দিকে আগাবে।
এই ডিলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সিরিয়ার টেরিটোয়াল ইন্টিগ্রিটি স্বীকার করা হলেও এখানে আসাদকে কোন অথরিটি হিসেবে উল্লেখ করা হয় নাই।
ভবিষ্যতে এই চুক্তিপত্র অনেক নতুন বাস্তবতার জন্ম দেবে বলে মনে হয়।

এই যুদ্ধবিরতি প্রকৃতপক্ষে আরো বড় যুদ্ধ শুরুরই প্রস্তুতিমাত্র।

@Muhammad Sajal

পঠিত : ১১২৫ বার

মন্তব্য: ০