Alapon

ওঁ-রা কেমন মুসলমান চায়...?



“... বাংলার হিন্দু-সম্প্রদায় ও মনীষীবৃন্দ হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনা করলেও তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং প্রচেষ্টা ছিল বাংলার মুসলমানের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, উভয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের মাধ্যমে মিলনকে বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা এবং উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। আর এ কারণেই ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যখনই মুসলিম জনগোষ্ঠীর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের প্রচেষ্টা হয়েছে তখনই এর বিরুদ্ধে ধ্বনিত হয়েছে হিন্দু বিদ্বজ্জনমণ্ডলীর প্রতিবাদ ও বিক্ষুব্ধ মনোভাব। এ-প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে ১৩৩৩ সালের ভাদ্র সংখ্যা ‘সওগাত'-এ বলা হয়েছিল :

“হিন্দুরা হিন্দু-মুসলমানের মিলন সম্বন্ধে যেরূপ ধারণা অন্তরে পোষণ করেন এবং আলাপে ও পত্রিকাদিতে প্রকাশ করেন, আলোচনার সৌকৰ্যার্থ তাহার সারমর্ম নিম্নে লিখিতেছি :

... পূর্বে হিন্দু-মুসলমানে পূর্ণ ঐক্য ছিল। হিন্দুরা মসজিদে ‘সিন্নি’ দিত; মুসলমানেরা নারায়ণকে সত্যপীর বলিয়া মানিত ও পূজা দিত। হিন্দুর মনসা-পূজা, শীতলা পূজা, কালী পূজা, দূর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা প্রভৃতিতে মুসলমানেরা ভোগ দিত ও যোগদান করিত। হিন্দুর পূজা-পার্বণে ও মেলাদিতে - কবি, তরজা, মচ্ছে, ভাসান, যাত্রা প্রভৃতি গানে আখড়ায় মুসলমানেরা সাগ্রহে, সানন্দে দলে দলে মিলিয়া অপূর্ব মিলন-সুখে নিমগ্ন হইত। হিন্দুরা যেরূপ গরুকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করে মুসলমানেরাও সেইরূপ গোহালের গরুর খাতির-যত্ন, তোয়াজ-তাগিদ করিত এবং যে-গরু তাহাদের অন্নের সংস্থান করিয়া দেয়, তাহাকে বধ করিতে ধর্মভীতির ন্যায় একরূপ ত্রাস বোধ করিত। পূজার দিনে মুসলমান বালক-বালিকারা এমন কি যুবক প্রৌঢ়েরাও প্রতিমা দর্শন করিতে সমেবত হইত। খই মুড়ি প্রভৃতি লইয়া মনের সুখে খাইতে খাইতে আসিত। সদব্রাহ্মণ দেখিলে হিন্দুর ন্যায় মুসলমান কৃষকও ভুমিষ্ঠ হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিত। হিন্দু-মুসলমান পরস্পর খুড়া, জেটা, বন্ধু প্রভৃতি কত প্রকার গ্রাম্য সম্পর্ক পাতাইয়া এক অপূর্ব মিলনানন্দে মাতিয়া থাকিত। কিন্তু এখন আর সেদিন নাই। মুসলমান এখন আর পূজা-পার্বণে যোগ দিতে চাহে না, গানের আড্ডায় যাইতে সঙ্কোচ বোধ করে, গরু মারিতে দ্বিধাবোধ করে না, বরং হিন্দুর মনে আঘাত দিবার ইচ্ছায় একটির স্থলে পাঁচটি গরু হত্যা করে এবং গোপন স্থানে না করিয়া প্রকাশ্য জায়গায় করে। হিন্দুকে দেখিলে পূর্বে মুসলমানের মন যেমন ভয় ভক্তিতে পূর্ণ হইত এখন আর সেরূপ হয়। তৎপরিবর্তে মুসলমান এখন হিন্দুকে কাফের বলিয়া ঘৃণা করিতে শিখিয়াছে। কেন এমন হইল? কে প্রেম ও শান্তির আসনে ঘৃণা ও বিদ্বেষের স্থান করিয়া দিল? ইহা গোঁড়া মোল্লা মৌলবীদেরই কাজ। তাঁহারা নিজ স্বার্থসিদ্ধির পথ প্রশস্ত করিবার জন্য হিন্দুকে কাফের বলিয়াছেন, মুসলমানকে পূজা-পার্বণে যোগ দিতে নিষেধ করিতেছেন, ঈদের সময় গরু কাটিতে বলিয়াছেন, দেবগৃহ ভাঙিতে উত্তেজিত করিতেছেন। শিক্ষিত মুসলমানেরাও এই কার্যে মৌলবীদের সহায় হইয়াছেন। পূর্ণ যোগ্যতা না থাকিলেও যাহাতে সরকার তাহাদিগকে চাকুরী দেন, তদুদ্দেশ্যে তাহারা মুসলমান জনসাধারণকে হিন্দুর সহিত পূর্বেকার সেই মধুর মিলন সম্পূর্ণ ছিন্ন করিয়া পৃথক হইতে উপদেশ দিতেছেন। শিক্ষিত মুসলমানেরা সরকারের অভীস্পিত ভেদনীতি প্রচার করিয়া অযোগ্যতা সত্ত্বেও চাকুরির সুবিধা পাইতেছেন। এইরূপে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদ জাগিয়াছে, বিরোধ জাগিয়াছে, শত্রুতার সৃষ্টি হইয়াছে। গোঁড়া মোল্লা মৌলবীরা ও শিক্ষিত মুসলমানেরাই এজন্য দায়ী ইত্যাদি...'

হিন্দু সম্পাদিত পত্রিকাদিতে হিন্দু-মুসলমান মিলন বিষয়ে যে সকল প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়া থাকে, তাহার সংক্ষিপ্তসার দিলাম। ঠিক হইল কিনা জানি না, বোধ হয় একেবারে বেঠিক হয় নাই; তাহা হইলে দেখুন ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে হিন্দু সাধারণের, এমন কি হিন্দু সম্পাদকের জ্ঞান কত সামান্য।”

অতীতে যখনই মুসলমান জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক ও জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনা ঘটেছে তখনই হিন্দু বিদ্বজ্জনমণ্ডলী তথাকথিত মিলন ও ঐক্যের নামে মিশ্রণের (Fusion) প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এর ফলে মিশ্রণ তো সম্ভবপর হয়নি-ই, অধিকন্তু বিরোধ এবং ভেদরেখাটিই উত্তুঙ্গ হয়ে উঠেছে। শুধু ধর্মীয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রেই নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও হিন্দু জনসাধারণ ও বিদ্বজ্জনমণ্ডলীর উল্লিখিত মনোভাব বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যধর্মী পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যের অভাব এবং ক্রমবিলুপ্তি লক্ষ্য করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মন ক্রমান্বয়ে বিষিয়ে উঠেছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবেই এক সময় মুসলিম সাহিত্যসাধক ও বিদ্বজ্জনমণ্ডলীর মনে বাংলা ভাষা তাদের মাতৃভাষা কিনা এ প্রশ্ন দেখা না দিয়ে পারেনি। কারণ হিন্দু সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের নিগড়ে বেঁধে এবং সাহিত্যকে হিন্দু ঐতিহ্যমূলক বিষয়সম্ভারে পরিপূর্ণ করে দিয়ে এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন যার ফলে স্বাতন্ত্র্যবাদী মুসলিম-মনের পক্ষে সে সাহিত্যের রস-আহরণ এবং তার সেবায় আত্মনিয়োগ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল॥"

— মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ / সাহিত্য সংস্কৃতি জাতীয়তা ॥ [ আহমদ পাবলিশিং হাউস - ভাদ্র, ১৩৭৪ । পৃ: ৩১-৩৩ ]

পঠিত : ৬৬৮ বার

মন্তব্য: ০