Alapon

ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বাংলায় শাহদাতের নজির



গতকাল ছিলো ১১ মার্চ, শহীদ দিবস। ১৯৮২ সালের এদিনের ঘটনায় শহীদ শাব্বির ভাইসহ ৪জন শাহদাতবরণ করে। বলা হয় ওনাদের মাধ্যমের এদেশে শাহদাতের অভিষেক হয়। কিন্তু ওনারা ১ম শহীদ নন। তারও আগে আরো অনেকে শাহদাতের নজরানা পেশ করেছিলেন।
তবে ওনাদের এই শাহদাত এদেশে চরম প্রভাব বিস্তার করেছিলো। ১৯৭৭ সালে ছাত্রশিবির যখন স্টার্ট হয়েছিলো তখন থেকে বাধার মুখোমুখি হচ্ছিলো। ছোট্ট একটি সংগঠন তারপরও একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলো।

১৯৮২ সালে রাবিতে চারজন খুন করে এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও কমিউনিস্ট শক্তি চেয়েছিলো ইসলামী শক্তিতে স্তব্দ করে দিবে। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন। শহীদের রক্ত এদেশের মাটিকে স্পর্শ করা মাত্রই বাংলাদেশে ইসলামী শক্তি ছড়িয়ে পড়ে। শহীদ শাব্বিরের নামে এদেশের বহু সন্তানের নাম রাখা হয়।

১৯৪৭ সালে আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন নানান প্রচেষ্টায় এদেশ থেকে ইংরেজদের ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন তখন এদেশের মুসলিমরা ভেবেছিলো আমরা এখন ইসলামের ব্যাপারে স্বাধীন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিলো ইসলামের ভিত্তিতে নয়, বরং মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান সৃষ্টি অবশ্যই জরুরী ছিলো কিন্তু সাথে এও জরুরী ছিলো পাকিস্তান ইসলামের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া।

এটা হতে পারে নাই বিধায় এদেশে ঢাকা ভার্সিটিতে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা পক্ষে কথা বলার অপরাধে ১৯৬৯ সালে খুন করা হয় শহীদ আব্দুল মালেককে। এরপর যখন মুশরিকদের সহায়তায় এদেশের কমিউনিস্টরা বাংলাদেশকে আলাদা করে ফেলে তখনও এদেশের তৌহিদবাদী মানুষ শাহদাতের নজরানা পেশ করেছে।

১১ মার্চ, ১৯৮২। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। আগের দিন ১০ মার্চ, বুধবার। সেদিন থেকেই মূলত শিবিরের এই কর্মসূচিকে বানচালের একটি হীন ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে উদীয়মান শক্তি হিসেবে শিবিরকে সহ্য করতে পারল না বাতিলপন্থীরা। ১১ তারিখের অনুষ্ঠানের প্রচারের কাজে ব্যস্ত শিবিরকর্মীদের ওপর হঠাৎ করে চড়াও হলো ছাত্র ইউনিয়নের একদল দুষ্কৃতকারী। শিবিরকর্মীদের হাত থেকে প্রচারপত্র কেড়ে নিলো। প্রচারকার্য বন্ধ করার জন্য বল প্রয়োগ করতে লাগলো। কিন্তু ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে পরিস্থিতির মোকাবেলা করলেন শিবিরকর্মীরা। এতে আহতও হলেন কয়েকজন।

১১ মার্চ সকাল থেকেই নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের জন্য জোর প্রস্তুতি চলছিল। সকাল ৮টা থেকেই প্রশাসনিক ভবনের পশ্চিম চত্বরে শিবিরের নবীনবরণের ডাকে সাড়া দেয় হাজার তরুণ-যুবকের দল। ছাত্রজনতার ঢল নামে নীল প্যান্ডেলের সম্মুখপানে। ৯টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের প্রাণকাড়া সুমধুর বাণী দিয়ে নবীনবরণ শুরু হতে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানস্থলের অদূরে শহীদ মিনারে শিবিরের কর্মসূচির সাথে একই সময়ে একটি সাংঘর্ষিক কর্মসূচির আয়োজন করেছিল দুষ্কৃতকারীরা। তারা লাঠি, রামদা, বল্লম, হকিস্টিক ও রড নিয়ে জমায়েত হয়েছিলো। কেবল শিবিরের প্রোগ্রাম বানচালের জন্যই এ কর্মসূচি। পূর্বপরিকল্পিতভাবে তথাকথিত ছাত্র পরিষদের ব্যানারে এ সমাবেশের আয়োজন করেছিল ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যরা। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে তারা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বারবার গোলযোগ বাধাতে চেষ্টা করে। প্রতিবারই শিবিরকর্মীরা তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। এরমধ্যে বাইরে থেকে তারা কয়েকটি বাস বোঝাই করে পাঁচ-ছয়শত সশস্ত্র সন্ত্রাসী এনে শিবিরকর্মীদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের হাতে ছিল রামদা, ভোজালি, ছোরা, বল্লম, হকিস্টিক ও লোহার রড। হিংস্র হায়েনার মত তারা শিবিরকর্মীদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র ইউনিয়নের হেলাল, ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শিশির, ছাত্রলীগের রানা, আজাদ, সাকুর, ফজলে হোসেন বাদশা, করীম শিকদার, কাদের সরকার জাসদের ফিরোজ প্রমুখ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ক্যাডারদের নেতৃত্বে অসহায় নিরস্ত্র শিবিরের নেতা কর্মীদের ওপর জঘন্যতম হামলা চালায়! নবীন বরণ হয়ে যায় পন্ড। অস্ত্রবাজ, খুনী, নেশাখোরদের হকিস্টিক, রামদা, কিরিচ চাইনিজ কুড়ালের জঘন্য আক্রমণের শিকারে পরিণত হয় মজলুম শিবির নেতা কর্মীরা। ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় হয়ে যায় দিশেহারা।

বীভৎস দৃশ্য, করুণ-বেদানবিধূর প্রতিচ্ছবি সারা ক্যাম্পাস জুড়ে। তবু ভিসি ও প্রক্টর মনিরুজ্জামান রক্তমাখা আহত নিরস্ত্র অসহায় শিবিরের বুকফাঁটা আর্তনাদ মর্মস্পর্শী করুণ দৃশ্যাবলী ফ্যাল ফ্যাল করে অবলোকন করছে। শত জনতার বিবেক ফেটে চৌচির হলেও তাদের বিবেকে পড়েনি কোন বেদনার রেখাপাত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। সেদিন পুলিশ ভিসির অনুমতির অপেক্ষায় ছিল। শিক্ষক, ছাত্র কারও অনুরোধেও পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে দেয়নি। ফলে রক্তের লাল বর্ণে মতিহারের সবুজ চত্বর হয় রঞ্জিত! সে যেন রক্তের হোলিখেলা!

নিরূপায়, অসহায়, নিরস্ত্র শিবির নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে মেইনগেট দিয়ে বের হয়ে চলে আসছে। আঘাতে আক্রমণে ৭০/৮০ জন মারাত্মক আহত, ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় দৌড়াতে আর পারছে না! মুখে শুধু আল্লাহ বাঁচাও শব্দ ছাড়া কোন আওয়াজ নেই। শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার শহরের দায়িত্বশীল হলেও নবীনবরণ অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে তারা ছিলেন সদা তৎপর। বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা তাই শহর থেকেই শিবির নির্মূল করার জঘন্য নীলনকশা তৈরি করেছিল বাম নেতারা। পূর্বপরিকল্পিতভাবেই হামলা পরিচালনা করেছিল তারা। আবারো তাদের চতুর্মুখী হামলায় আর আক্রমণে কান্না আর কান্নার রোল! আর্তনাদ আর আকাশ ফাটা চিৎকারে বাতাসও ভারী হয়ে যাচ্ছে।

আল্লাহর রাহে শিবিরের প্রথম নজরানা
এমনি মুহূর্তে বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে শহীদ জোহার মাজারের সামনে শিবির নেতা, উপশহরের কৃতি সন্তান সাব্বিরের ওপর নারকীয় হামলা চালায়। রড-কিরিচ-রামদার শত শত আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিক্যালে ভর্তি করা হলো। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের পাশাপাশি করুণ সুরে ভেসে এলো সাব্বির আর নেই! জোহরের নামাজ পড়তেও পারলেন না শিবিরের সর্বপ্রথম শহীদ হিসেবে জান্নাতুল ফিরদাউসের জামায়াতে প্রভুর কাছে হাজির হয়ে গেলেন।

শত শত নেতাকর্মী আহত আর রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। শত জনতার সম্মুখে বিএনসিসির সামনে শিবিরে নেতা আব্দুল হামিদের মাথার নিচে ইট রেখে অনেক ইট আর রড দ্বারা আঘাত করলে মগজ ছিটকে বের হয়ে যায়। রাজশাহী কলেজ থেকে আরবি অনার্স পরীক্ষা দেয়া আর হলো না। শহীদ আবদুল হামিদের রক্তমাখা বেদনার প্রতিচ্ছবি প্রতিক্ষণ প্রাণে দোলা দেয়। মনে পড়লেই হৃদয়ে জাগে শিহরণ! কিন্তু পাষাণ নিষ্ঠুরদের হাতও কাঁপেনি। যদিও কেঁপেছিল খোদায়ী আরশ। শহীদ সাব্বিরের শোকে মূহ্যমান আবাল বৃদ্ধবনিতা এক শহীদের বেদনায় শোকাহত জনতার প্রাণে মাত্র ৮/১০ ঘণ্টার মধ্যেই শহীদ আবদুল হামিদের শাহাদাত চতুর্দিকে বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়লো।

১১ মার্চের বেদনার আধার ভেদ করে ১২ মার্চের সোনালি সূর্য উদিত হলো। মাত্র ৩৫ ঘণ্টার ব্যবধানে আহত চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ মার্চ প্রভুর ধ্যানে পাড়ি দিলেন শহীদ আইয়ূব। উদ্ভিদ পরীক্ষায় অনার্স না হলেও শাহাদাতের মর্যাদায় হলেন উদ্ভাসিত। শহীদ সাব্বির, হামিদ যেমন শহর শাখার জোন সভাপতি ছিলেন তেমনি শহীদ আউয়ুবও ছিলেন শহর শাখার অফিস সম্পাদক। তাঁর হাসিমাখা চাহনি, অপূর্ব ওয়াল রাইটিং আর মায়াবী চেহারা বেদনার প্রতিচ্ছবি আজও ডাকে বারে বার। তিনিও চলে গেলেন ওপারে সুন্দর ভুবনে। প্রতিদিন সূর্য ফেরে শুধু ওরা ফেরে না...?

দীর্ঘদিন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকলেন রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবদুল জাববার। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি যান। প্রায় গান গেয়ে সান্ত্বনা খুঁজতেন এভাবে আমাকে শহীদ করে সেই মিছিলে শামিল করে নিও. ‘আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়।' তার প্রাণের আকুতি ৯ মাস পর ২৮শে ডিসেম্বর প্রভুর দরবারে কবুল হলো। তিনিও শাহাদাতের পিয়ালা পান করলেন। শহীদ সাবিবর, হামিদ, আইয়ুবের মত শহীদ জাববারের শাহাদাতেও পারলো না কেউ অশ্রু নিবারণ করতে। শহীদ আর অগণিত আহত, ক্ষত-বিক্ষত রক্তমাখা প্রতিচ্ছবি সত্যিই বেদনাবিধুর!

আল্লাহ তায়ালা এই শহীদদের কবুল করুন। এই বাংলার মাটিকে ইসলামের জন্য কবুল করুন।

পঠিত : ৬০১ বার

মন্তব্য: ০