Alapon

যখন ফেরেশতারা আপনাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবেন...


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সূরা ফুসসিলাত এর ৩০ নাম্বার আয়াতে বলেন - إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنتُمْ تُوعَدُونَ - "নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোন।" (41:30)

"তাতানাজ্জালু আলাইহিমুল মালা-ইকা" তাদের উপর ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয় - এই আয়াত নিয়ে আমাদের ক্ল্যাসিক্যাল স্কলারদের মাঝে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। কারণ পূর্বের আয়াতগুলোতে কিয়ামত, বিচার দিবস, জাহান্নামের আগুন, আখিরাত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন - সম্ভবত, এই ফেরেশতারা আখিরাতে অবতীর্ণ হবেন। অন্যরা বলেন - এই আয়াতে এই ধরনের কোন সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। সম্ভবত, মৃত্যুর সময় এই ফেরেশতাদের আগমন ঘটবে।

আপনি একটি ভালো জীবন অতিবাহিত করেছেন, এখন মৃত্যু শয্যায়...। আজ হউক কাল হউক আমরা একদিন এই মৃত্যু শয্যায় শায়িত হব। এটা গাড়িতে ঘটুক, প্লেনে ঘটুক বা আমাদের বিছানায় ঘটুক, যেখানেই ঘটুক না কেন এটা অবশ্যই ঘটবে। যখন আমরা বৃদ্ধ হয়ে পড়বো, অথবা হাসপাতালের বিছানায়...আপনি শুয়ে আছেন আর চারপাশে পরিবারের সদস্যরা কান্নাকাটি করছে, আপনি কথা বলতে পারছেন না, কারণ ''বালাগাতিত তারাকি'' (প্রাণ কণ্ঠাগত ৭৫ঃ ২৬) রুহ ইতিমধ্যে গলায় পৌঁছে গেছে, আপনি আমি এই ক্ষণস্থায়ী বাসস্থান ছেড়ে চিরবিদায়ের পথে... এই শরীরটাও আমাদের রুহের জন্য ক্ষণকালের বাসস্থান, আমরা এই শরীর ছেড়ে দেয়ার পথে।

আপনার মা পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ভাই, বোনেরা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছে, তারা সবাই কাঁদছে; ঠিক সে সময় আপনার চোখ খুলে গেল আপনি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছেন যা অন্য কেউ দেখছে না, আপনি দেখতে পেলেন ফেরেশতারা নেমে আসছে। আশে পাশের কেউ এই দৃশ্য দেখতে পারছে না, কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন। (কারণ, অদৃশ্যের পর্দা আপনার সামনে থেকে সরে গেছে।) আর যখন মানুষ ফেরেশতাদের দেখতে পায়, তখন তারা শুধু দুই দলের ফেরেশতাদের মাঝে যে কোন এক দলের দেখা পায়। এক ধরনের ফেরেশতা হল, এমন ফেরেশতা যাদের দেখে এমন ভয় পাবেন যা জীবনে কখনো পান নি। আর অন্যদল হল, যাদের দেখে এতো আনন্দিত হবেন যে জীবনে কখনো এতোটা আনন্দিত হননি।

এই আয়াতে যে ফেরেশতাদের কথা বলা হয়েছে তারা হলেন দ্বিতীয় দলের ফেরেশতা। তাঁরা আপনার জন্য আনন্দ বার্তা নিয়ে আসবে এবং বলবে - "ভয় পেয়ো না, দুঃখ করো না।" আলেমরা এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা নিয়েও অনেক আলোচনা করেছেন। ভয়ের ব্যাপারটা বুঝলাম, আপনি মারা যাচ্ছেন, তাই ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। এখানে ''লা তাহজানু (দুঃখ পেয়ো না) '' কেন বলা হল? দুঃখ এবং মনোবেদনা আসে পূর্বে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা থেকে। যা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। তাহলে এখানে কেন ''লা তাহজানু'' উল্লেখ করা হল।

কারণ একজন বিশ্বাসীর ভাবনাটা তখন এমন থাকে - "হায় হায়, ফেরেশতারা চলে এসেছে! আমার তো আরো তাওবাহ করার দরকার ছিল। আমার আরো কিছু দোয়া করার দরকার ছিল। আমি তো এই বছর ইতিকাফ করার প্ল্যান করেছিলাম। আমি আরো কুরআন তিলাওয়াত করতে চেয়েছিলাম। আমার মায়ের সাথে আরো কিছু সময় ব্যয় করতে চেয়েছিলাম। আমার ভাইকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। আমি অমুক অমুক ব্যক্তিকে টাকা দিতে চেয়েছিলাম। আমি আরো কিছু সাদকা করতে চেয়েছিলাম। আমি বেহুশ হওয়ার পূর্বে চেকটা সই করতে চেয়েছিলাম, এখন আমি হাসপাতালে আর আপনারা চলে এসেছেন। আপনারা আমাকে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে একটু চেকটা লেখার সুযোগ দিবেন?"

তখন ফেরেশতারা বলবেন, চিন্তা করো না। তোমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি যথেষ্ট ক্রেডিট অর্জন করেছো এবং সফলতার সাথে উত্তীর্ন হয়েছো। '' লা তাহজানু, ও আবশিরু বিল জান্নাহ" জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো। "আল্লাতি কুন্তুম তুওআদুন" যার প্রতিশ্রুতি তোমাকে সবসময় দেয়া হতো। চিন্তা করে দেখুন, মানুষটি মৃত্যু শয্যায়, তাঁর আশে পাশে সবাই কাঁদছে, তাঁর সে সময় এক ফোটা চোখের পানি ফেলার শক্তি পর্যন্ত থাকে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি এমন চরম আনন্দিত যে জীবনে কখনো এমন আনন্দিত হননি। কারণ তিনি মাত্র জান্নাতের গ্যারান্টি পেলেন। কোনো কোনো আলেমের মতে, এই ঘটনা ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বেই ঘটে। কিন্তু তিনি আসলে ফেরেশতাদের দেখতে পান মৃত্যুর সময়ে যে তাঁরা তাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন।

আরেকদল আলেমের অভিমতে - আপনি যদি উত্তম মানুষে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন, আপনি যদি ''ছুম্মাস তাকামু'' এর উপর জীবন ধারণ করেন, তাহলে ফেরেশতারা এখনই আসবেন এবং অভিবাদন জানাতে থাকবেন। আপনি হয়তো তাঁদের দেখতে পাচ্ছেন না, তাদের অভিবাদন শুনতে পারছেন না; কিন্তু আল্লাহ আকাশ থেকে শুধু আপনার জন্য ফেরেশতা প্রেরণ করেন যেন আপনি ভয় এবং দুঃখ থেকে বেঁচে থাকতে পারেন এবং যে জান্নাত পেতে যাচ্ছেন তাঁর জন্য ভালো লাগা অনুভব করেন। শুধু এই জন্য আল্লাহ আকাশ থেকে ফেরেশতা প্রেরণ করেন। সুবহানআল্লাহ। ''আন লা তাখাফু'' এখানে যে ''আন'' দেখতে পাচ্ছেন তার মানে হলো - ফেরেশতাদের আগমন এই উদ্দেশ্যেই ঘটে যেন আপনি ভয় এবং দুঃখ না পেয়ে থাকেন। এই উদ্দ্যেশ্যে যে আপনি যেন ভয় না পান, এই উদ্দেশ্যে যে আপনি যেন দুঃখ ভারাক্রান্ত না হয়ে পড়েন।

আমি আগেই বলেছি, আমাদের দ্বীন আমাদের জীবন থেকে দুঃখ দূর করে দেয়, মানসিক চাপ এবং মনোবেদনা দূর করে দেয়। মানুষ সাধারণত কোন দু'টি মানসিক চাপে ভোগে? ভয় এবং দুঃখ। আর ফেরেশতারা এসে বলেন, তুমি আবেগের দিক থেকে সুস্থ্য থাকবে। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তোমার যা যা করার কথা ছিল তুমি তা করেছো, আর তাই আল্লাহ তোমাকে আবেগের দিক থেকে সুস্থ্য করে দিবেন, তোমার মানসিক কষ্ট দূর করে দিবেন, আধ্যাত্মিক দিক থেকে তোমাকে সুস্থ্য করে দিবেন। '' ও আবশিরু বিল জান্নাহ'' আর জান্নাতের সুসংবাদ শুনে অভিনন্দিত হও। জান্নাতের সুসংবাদ শুনে আনন্দিত হও।

''আল্লাতি কুন্তুম তুওআদুন " আয়াতের এই অংশটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমি এই অংশটি একটু সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করতে চাই। এই অংশটি নিজেই এক জগৎ। '' আল্লাতি কুন্তুম তুওআদুন - যার ওয়াদা তোমাদের সব সময় দেয়া হতো।" আল্লাহ কোথায় জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন? তাঁর কিতাবে। এখন যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হচ্ছে তাদেরকে বলা হলো - তোমরা সব সময় জান্নাতের ওয়াদা পেতে। ''কুন্তুম তুওআদুন'' আরবি ব্যাকরণের নিয়মানুযায়ী যদি কোথাও ''কানা এবং মুদারে'' একত্রে আসে তাহলে সেটা লম্বা সময় ধরে ক্রমাগত কোনো কিছু ঘটার ধারণা প্রকাশ করে। অর্থ্যাৎ - তোমরা অনবরত জান্নাতের প্রতিশ্রুতি পেতে। আমি আপনাদের বলেছিলাম কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মূর্খ কাফের সবাইকে বলতো - কুরআন তিলাওয়াত শুনিও না, যখন এটা তিলাওয়াত করা হয় বিভিন্ন রকম আওয়াজ তোলে বাধার সৃষ্টি করো।

আর বিপরীতপক্ষে, একজন বিশ্বাসী সকাল বিকাল নিয়মিত আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করতো, কুরআন তিলাওয়াতে তাঁরা অপরিসীম আনন্দ খুঁজে পেতেন। আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে প্রশান্তি খুঁজে পেতেন। আর আপনি যখন প্রচুর পরিমানে কুরআন অধ্যয়ন করেন, তখন কোন কথাটি অনেক বেশি বার শুনতে পান? আপনি জান্নাতের কথা অনেক বেশি সংখ্যক বার শুনতে পান। আর ব্যাপারটা শুধু মাঝে মাঝে শুনতে পান এমন নয়, আপনি প্রতিনিয়ত জান্নাতের কথা শুনতে পান। আল্লাহ আমাদের জন্য যে বাসস্থান তৈরী করে রেখেছেন তার কথা তিনি শুধু মাঝে মধ্যে বলেননি, তিনি কুরআনে বার বার, বার বার জান্নাতের কথা বলেছেন।

জানেন? যখন মানুষ বাড়ি বা এপার্টমেন্ট কেনার প্ল্যান করে তখন তারা কী করে? তারা সারাক্ষণ এই এপার্টমেন্টের কথা বলতে থাকে। তারা তাদের আলোচনায় বার বার বাড়ির কথা নিয়ে আসে। আপনার হাতে যখন বাড়ি কেনার জন্য যথেষ্ট টাকা আসে বা বাড়ি ক্রয় করে ফেলেন তখন একটু সময় পেলেই ঐ বাড়ির আশ পাশে ঘুরে আসেন। রিয়েল স্টেটের ওয়েবসাইটে বার বার ভিজিট করতে থাকেন। কারণ নতুন বাড়িতে উঠার জন্য আপনি আর দেরি সহ্য করতে পারছেন না। মানুষের ভেতরের কিছু একটা আর দেরি সহ্য করতে চায় না। "এই বাড়িটা কিনবো? নাকি ঐটা কিনবো? ঐ বাড়িটার পেছনের দিকটা দেখো, কি সুন্দর !" কিছু একটা আছে আমাদের ভেতর, এটা আমাদের প্রকৃতিতে, আমরা নতুন বাড়ি খুবই পছন্দ করি। আপনি হয়তো পাঁচ বছর আগে এখনকার বাড়িটি কিনেছেন, কিন্তু এটাকে এখন পুরাতন মনে হয়। অন্য কারো নতুন বাড়িতে গেলে মনে মনে ভাবেন - "আরে! বাড়িটা তো খুব সুন্দর! আমি কি এরকম একটা কিনতে পারবো? ব্যাংক অ্যাকাউন্টটা চেক করে দেখি। যদি এখনকার বাড়িটা বিক্রি করি তাহলে হয়তো কিনতে পারবো।" আল্লাহ আমাদের ভেতর এই চাহিদা দিয়েছেন। আমরা বাড়ির মালিক হতে ভালবাসি।

আল্লাহ জান্নাতের রিয়েল এস্টেটের কথা কুরআনের সর্বত্র বলেছেন। '' আমি তোমাদের এর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি তোমাদের জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি...।" আর আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, একবার যখন আমরা জান্নাতের বাড়িতে উঠবো আর কখনোই অন্য কোথাও সরে যেতে চাইবো না।

এই আয়াত থেকে যে ধারণাটি আমি আপনাদের সবাইকে দিতে চাই - এমনকি আমার নিজের জন্যেও - ফেরেশতারা এসে বলবেন, তোমাকে অনবরত জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হত। এখন আপনি যদি নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন না করেন তাহলে তো আপনি অনবরত জান্নাতের প্রতিশ্রুতি পাচ্ছেন না। আপনি যদি নিয়মিত আল্লাহর কালাম না শুনেন তাহলে তো আপনি তাদের অন্তর্ভুক্ত নন যাদের নিয়মিত জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। এই কথা তাদেরকেই বলা হচ্ছে যাদের আল্লাহর কালামের সাথে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

উস্তাদ নোমান আলী খান

পঠিত : ২৬২৩ বার

মন্তব্য: ০