Alapon

গরমকালে তাপমাত্রা বাড়লে কি করোনাইভারাসের প্রকোপ কমবে?


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে বাংলাদেশের বেস্টসেলিং লেখক পর্যন্ত অনেকেই বলছেন, গরমের দিন আসলে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমার একটা সম্ভাবনা দেখা যাবে। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য কথাটার পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তি তুলে ধরা।

প্রথমে আসুন বজ্জাত ভাইরাসটার দিকে একটু তাকাই। এর শরীরের চারদিকে থিকথিকে একটা ঝিল্লীর মত জিনিস আছে। এই ঝিল্লীটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

যেসব ভাইরাসের চারদিকে এরকম ঝিল্লী থাকে, তারা একটু রোগাপটকা গোছের হয়। তাপমাত্রা বা আর্দ্রতার ওঠানামা খুব একটা সহ্য করতে পারে না। অন্যদিকে ঝিল্লীবিহীন ভাইরাস মোটামুটি সারাবছরই কমবেশি উপদ্রব করে- যেমন সর্দিকাশির কিছু ভাইরাস।

আজ থেকে বছরখানেক আগে স্কটল্যান্ডের কিছু বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখিয়েছেন, যেসমস্ত শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস এরকম ঝিল্লী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা বাড়লে (মানে গরমকালে আরকি) অত ভাল ছড়াতে পারে না।

করোনাভাইরাসও সেরকম শ্বাসযন্ত্রেরই ভাইরাস, এরও ঝিল্লী আছে। ইন্টারেস্টিং।

একই ব্যাপার গবেষণাগারেও প্রমাণিত হয়েছে- বিজ্ঞানীরা একগাদা গিনিপিগের ওপর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন, আবহাওয়া যত শুষ্ক হয়, ভাইরাস তত দ্রুত ছড়ায়। বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে সে অত সুবিধা করতে পারে না।

একইভাবে পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই ইনফ্লুয়েঞ্জার উপদ্রব নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে, এরা শীতকালে ভাল ছড়ায়। তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা কম থাকলে ঝিল্লীটার ভেতরে ভাইরাসের কলকব্জা ঠিক থাকে। গরমকালে অতটা না। ইনফ্লুয়েঞ্জাও শ্বাসযন্ত্রের ঝিল্লীঅলা ভাইরাস, করোনাও তাই।

একটু আশাপ্রদ মনে হচ্ছে বোধহয় ব্যাপারটা।

এই পুরো আলোচনার মধ্যে একটা বিশাল বড় সমস্যা আছে।

পৃথিবীময় ভাইরাসের সাথে গরমকালের এই যে শত্রুতা, এর সমস্ত উপাত্ত মোটামুটি এসেছে ঠাণ্ডার দেশ থেকে। গরম বা ট্রপিকের দেশে এর অবস্থা অন্য।

দু'হাজার তের সালে একদল বিজ্ঞানী পৃথিবীর আটাত্তরটা জায়গায় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে তাপমাত্রা/আর্দ্রতার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা যেটা বের করেছেন সেটা হল- শীতকাল আর শুষ্কতার সাথে ভাইরাস ছড়ানোর যোগ আছে বটে, কিন্তু সেটা শুধুমাত্র ঠাণ্ডার দেশে। যতই আপনি পৃথিবীর পেটের কাছটার দেশগুলোর কাছে আসেন, ততই এই সম্পর্ক উলটে যায়।

গরম দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভাইরাস ছড়ানোর যোগ শীতের সাথে নেই, আছে বৃষ্টি আর আর্দ্রতার সাথে। অর্থাৎ বৃষ্টি আর বাতাসের আর্দ্রতা যত বাড়ে, ভাইরাস তত দ্রুত ছড়ায়। কাজেই আপনি চোখ বন্ধ করে গরম মানেই ভাইরাস কম- বাংলাদেশের মত দেশে তা বলতে পারছেন না মোটেই।

ভিয়েতনামে করা আরেকটা গবেষণায় আঠেরো বছরের ইনফ্লুয়েঞ্জার ইতিহাস ঘেঁটে একই জিনিস দেখা গেছে- আর্দ্রতা যত বাড়ে, শালারা তত বেশি ছড়ায়।

মানে শীতের দেশের উলটো হিসেব।

এই গেল একটা দিক।

শীতকালে ভাইরাস বেশি কেন ছড়ায় (বা গরমকালে কম কেন ছড়ায়)- এর আরো দু'য়েকটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। যেমন-

শীতকালে মানুষ ঘরের মধ্যে বেশি থাকে। সূর্যের আলো অত পায় না, ফলে দেহে ভিটামিন ডি তৈরি হয় না। ব্যাপারটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য অতটা ভাল না। কিন্তু গরমকাল আসলে আমরা ভিটামিন ডিতে গোসল করে একদম সতেজ হয়ে উঠি। এই ব্যাখ্যা অনুসারে- শীতকালে আমরা একটু দুর্বল থাকি বলে ভাইরাস কোপ দেওয়ার সুযোগ পায়।

এটা ব্যাখ্যা হিসেবে অতটা খারাপ নয়। ভিটামিন ডি খাওয়ার সাথে শ্বাসযন্ত্রের রোগের ঝুঁকি কমার প্রমাণ আসলেই পাওয়া গেছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমিয়ে দেওয়ার মত সেটা যথেষ্ট কিনা, তা আমরা এখনো নিশ্চিত নই।

আরো কিছু ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া যায়, কিন্তু এই আলোচনার একটা বড় ব্যাপার হল- ভাইরাসটা আনকোরা নতুন। একদম নতুন ভাইরাস সবসময় ঐসব ঋতুটিতু মানে না। কারণটা বলছি।

ধরুন কোন পুরোনো ভাইরাস- যেমন পোলিওটোলিও- বাংলাদেশে একটা মহামারী বাঁধানোর চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা কিন্তু বেশ কঠিন, কারণ আমাদের অধিকাংশেরই টিকা দেওয়া। কাজেই দেশের মধ্যে তাকে ছড়াতে হলে খুঁজে খুঁজে ঐ হতভাগাদের বের করতে হবে, যাদের টিকা দেওয়া নেই বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। এই প্রেক্ষিতে যদি সে ছড়ানোর জন্য পছন্দমত আবহাওয়া পায়, তাহলে কঠিন কাজটা আরেকটু সহজ হয়।

কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে এরকম কোন চিন্তা নেই। দেশময় একটা লোকের শরীরও একে চেনে না- সবার কাছেই সে নতুন। কাজেই কারো শরীরেই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। এটা করোনার জন্য একটা বিশাল ব্যাপার, কারণ সে কোনরকম বাছবিচার না করে অসুখ ছড়াতে পারবে। তাতে যদি সে একটু কষ্টের আবহাওয়াতেও পড়ে, তাতেও তার সেরকম সমস্যা নেই।

সহজ কাজে বাঁধা কম। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের মহামারী হওয়া অতি সহজ। এজন্য আবহাওয়া ভাইরাসটাকে যতই বিরক্ত করুক, তাতে তার ছড়ানো অতটা নাও কমতে পারে।

এক কথায়- আসলে বাংলাদেশে গরমকালে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যে কমে আসবে, এর সেরকম কোন শক্ত প্রমাণ নেই বলেই মনে হচ্ছে। কিছু আশার আলো মনে হয় আছে, তার ভিত্তিতে ভরসা রাখতেও পারেন, কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা প্রতিধ্বনিত হবে বলা শক্ত।

আর গরমকালে ভাইরাস যদি কমেও, তারপরেও দু'টো বড় বড় কিন্তু থেকে যায়।

প্রথম কিন্তু- কমলেও সে যে মিইয়ে যাবে তা নয়, রোগ ছড়াতে থাকবে ঠিকই। হয়ত ছড়ানোর বেগটা খানিক কমবে। বিশ্বাস না হলে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স আর ইরানের অবস্থা দেখুন।

দ্বিতীয় কিন্তু- গরমকালে কমলেও ঋতু পরিবর্তন হলে আবার সে বাউন্স ব্যাক করতে পারে। এটা খুবই সম্ভব, এবং অনেক ভাইরাসের ক্ষেত্রেই দেখা যায়।

কাজেই প্রতিরোধ চালিয়ে যান। গরমকাল বলে ছাড় দেবেন না। যতদূর সম্ভব বাসায় থাকুন, হাত পরিষ্কার রাখুন, ভিড়ের মধ্যে যাবেন না, সম্ভব হলে মাস্ক পড়ুন।

অফিস আদালত স্কুল কলেজ বন্ধ দেওয়া পর্যন্ত এগুলো বোধহয় যথেষ্ট হবে না, কিন্তু সম্ভবের মধ্যেই যদ্দূর পারেন চালিয়ে যান।

=================================

তথ্যসূত্র

গিনিপিগের ওপর করা ইনফ্লুয়েঞ্জার গবেষণা- Lowen, A.C. and Steel, J., 2014. Roles of humidity and temperature in shaping influenza seasonality. Journal of virology, 88(14), pp.7692-7695.

ঝিল্লীঅলা/ঝিল্লীবিহীন ভাইরাসের তুলনা- Price, R.H.M., Graham, C. and Ramalingam, S., 2019. Association between viral seasonality and meteorological factors. Scientific reports, 9(1), pp.1-11.

পৃথিবীর আটাত্তর জায়গায় করা ইনফ্লুয়েঞ্জার সেই গবেষণা- Tamerius, J.D., Shaman, J., Alonso, W.J., Bloom-Feshbach, K., Uejio, C.K., Comrie, A. and Viboud, C., 2013. Environmental predictors of seasonal influenza epidemics across temperate and tropical climates. PLoS pathogens, 9(3). (বিশেষ করে পাঁচ নম্বর ছবির ম্যাপগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান দেখুন)

ভিয়েতনামে ইনফ্লুয়েঞ্জার আঠেরো বছরের ইতিহাস নিয়ে করা গবেষণা- Thai, P.Q., Choisy, M., Duong, T.N., Thiem, V.D., Yen, N.T., Hien, N.T., Weiss, D.J., Boni, M.F. and Horby, P., 2015. Seasonality of absolute humidity explains seasonality of influenza-like illness in Vietnam. Epidemics, 13, pp.65-73. (এটা শুধু ইনফ্লুয়েঞ্জা নয়, ইনফ্লুয়েঞ্জা-ধরণের যেকোন অসুখের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এর মধ্যে করোনার রোগটাও পড়ে)

শ্বাসযন্ত্রের রোগের সাথে ভিটামিন ডি এর সম্পর্ক- Martineau, A.R., Jolliffe, D.A., Hooper, R.L., Greenberg, L., Aloia, J.F., Bergman, P., Dubnov-Raz, G., Esposito, S., Ganmaa, D., Ginde, A.A. and Goodall, E.C., 2017. Vitamin D supplementation to prevent acute respiratory tract infections: systematic review and meta-analysis of individual participant data. bmj, 356, p.i6583.

Courtesy-
Hassan Uz Zaman Shamol

পঠিত : ৮৫১ বার

মন্তব্য: ০