Alapon

মহামারি মোকাবেলায় সিরিয়া বিজয়ী আবু উবায়দা (রা) ও আজকের করোনা ভাইরাস প্রেক্ষিত...


আবু উবাইদা বিন জাররাহ (রা) দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত মহান দশজন ব্যক্তিদের অন্যতম। আবু উবায়দার সাথে কাছাকাছি তুলনা করা যেতে পারে এমন আরেকজন শ্রেষ্ঠ সন্তান দুনিয়ার বুকে আর কোন মা জন্ম দিতে পারেনি। জীবন চরিত্রের যে বিষয়েই লিখা হউক না কেন, তার ইতিহাস সকল ঘটনাকে উৎরে যাবে। মক্কার অন্ধকার যুগে জন্ম নেওয়া এই যুবক, হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, তদানীন্তন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম পরাশক্তি রোমান বাহিনীকে ভূ-মধ্যসাগরের ওপারে হটিয়ে দিয়েছিলেন। শতাধিক যুদ্ধের অন্যতম বিজয়ী মহানায়ক খালিদ বিন ওলীদ কে সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে যাকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল, তিনি আবু উবায়দা বিন জাররাহ। তদানীন্তন দুনিয়ার দ্বিতীয় পরাশক্তি পারস্য বাহিনীর দম্ভকে চুরমার করেছিলেন তিনি। ওমর (রা) তাঁকে হিমস, দামেস্ক, জর্ডান ও ফিলিস্তিনের যুদ্ধের ময়দানের সর্বাধিনায়ক মনোনীত করেছিলেন। তাঁর হাতে পুরো সিরিয়ায় মুক্তির পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। তিনি ইতিহাসের সেই ব্যক্তি, যার মধ্যস্থতায় জেরুজালেম নগরীতে রক্তপাতহীন লড়াই বন্ধে ওমর (রা) একটি মাত্র ভৃত্য নিয়ে একাকী মদিনা থেকে জেরুজালেম নগরীতে উপনীত হয়েছিলেন। আবু উবায়দার কাহিনী লিখতে গেলে বইয়ের প্রতিটি লাইনেই থাকবে শিহরণ, উত্তেজনা আর সাসপেন্স!

সেই তিনি নিজের মাতৃভূমি মক্কা থেকে হাজারো মাইল দূরে জর্ডানের উপত্যকায় ইন্তেকাল করেছিলেন মহামারি প্লেগ রোগে! এই রোগ থেকে বেচে থাকার জন্য তিনি যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন! তাঁর কাছে আধা দুনিয়ার শাসক খলিফা ওমর (রা) মদিনা থেকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এই মর্মে, ‘‘আপনাকে আমার খুবই প্রয়োজন। অত্যন্ত জরুরী-ভাবে আপনাকে আমি তলব করছি। আমার এ পত্রখানি যদি রাতের বেলা আপনার কাছে পৌঁছে তাহলে সকাল হওয়ার পূর্বেই রওয়ানা দেবেন। আর যদি দিনের বেলা পৌঁছে তাহলে সন্ধ্যার পূর্বেই রওয়ানা দেবেন।’’

সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ব্যক্তিজীবন পরিচালনা এমন কি জীবন-মৃত্যুর বিনিময়েও খলিফার সকল আদেশ ও সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন বলে, আবু উবায়দা বাইয়াত তথা শফত নিয়েছিলেন। সেই আবু উবায়দা বিনয়ের সহিত খলিফার চিঠির উত্তর দেন এভাবে, "আমার কাছে আমীরুল মুমিনীনের প্রয়োজনটা কি তা আমি বুঝেছি; যে বেঁচে নেই তাকে তিনি বাঁচাতে চান।"

তিনি আরো লিখলেন ‘‘আমীরুল মু’মিনীন, আমি আপনার প্রয়োজনটা বুঝেছি। আমি তো মুসলিম মুজাহিদদের মাঝে অবস্থান করছি। তাদের ওপর যে মুসিবত আপতিত হয়েছে তা থেকে আমি নিজেকে বাঁচানোর প্রত্যাশী নই। আমি তাদেরকে ছেড়ে যেতে চাইনা, যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেন। আমার এ পত্রখানি আপনার হাতে পৌঁছার পর আপনি আপনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন এবং আমাকে এখানে অবস্থানের অনুমতি দান করুন।’’

ওমর (রা) এভাবে চিঠির উত্তর পেয়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন। অল্প কয়েকদিন পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

মৃত্যুর পূর্বে আবু উবায়দা (রা) তাঁর সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাটি দেন।

‘‘তোমাদেরকে যে উপদেশটি আমি দিচ্ছি তোমরা যদি তা মেনে চলো তাহলে সবসময় কল্যাণের পথেই থাকবে। তোমরা নামায কায়েম করবে। রমাদান মাসে রোযা রাখবে। যাকাত দান করবে। হজ্জ ও উমরা আদায় করবে। একে অপরকে উপদেশ দেবে। তোমাদের শাসক ও নেতৃবৃন্দকে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলবে। তাদের কাছে কিছু গোপন রাখবে না এবং দুনিয়ার সুখ সম্পদে গা ভাসিয়ে দেবে না। কোন ব্যক্তি যদি হাজার বছরও জীবন লাভ করে, আজ আমার যে পরিণতি তোমরা দেখতে পাচ্ছ তারও এই একই পরিণতি হবে।’’

সবাইকে সালাম জানালেন এবং সাথী মুয়াজ (রা) বললেন, তুমি নামাজের ইমামতি কর। আবু উবায়দা (রা) বরাবার ইমামতি করতেন কিন্তু এটাই তার শেষ নামাজ। নামাজের পর পরই তিনি ইন্তেকাল করেন। জর্ডানের সেই উপত্যকায় তাঁকে চিরদিনের জন্য কবরস্ত করা হয়েছে। প্রতি বছর লাখো মানুষের পদভারে এটি মুখরিত থাকে।

ঘটনা চক্রে মৃত্যুর সময় তাঁর অধীনস্থ সকল সমরনায়কেরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মিশর বিজয়ী আমর ইবনুল আস ও মুয়াজ (রা) তাঁকে কবরে শুইয়ে দেন। মুয়াজ (রা) শিশুকালেই নবী মুহাম্মদ (সা) সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তিনিও জর্ডানে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন কিন্তু আমর ইবনুল আস (রা) প্লেগ বিস্তারের মধ্যে থেকেও অনেক সাথীদের সাথে তিনিও বেঁচে যান। তাঁরা তকদিরের উপরে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই, তারা প্লেগ রোগে আক্রান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে আসেন নি বরং রোগীদের নিজ হাতে সহযোগিতা দিয়েছিলেন। জীবনের শেষ বয়সে মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে আমর ইবনুল আস আফসোস করে বলতেন, "ইশ! যদি সেই প্লেগে আমি মরেই যেতাম, তাহলে কতই না ভাল হত"

তাই মহামারি কোন গজবের নাম নয়। দুনিয়ায় থেকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ব্যক্তিরাও মহামারিতে মারা যেতে পারে। এটা হল আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের পরীক্ষা। যে পরীক্ষা থেকে কেউ পালাতে পারেনা। সবাইকে এই পরীক্ষার মোকাবেলা করতে হয়। কেউ পাশ করে, কেউ ফেল করে, কেউ নিজের ভুল শুধরাতে পারে। করোনার ভাইরাসের এই্ সময়টিও এক ধরনের পরীক্ষা। এক দিনে এটাকেও নিয়ন্ত্রন করা মানুষের সাধ্যের মধ্যে আসবে। তবে যথাযথ পদ্ধতিতে সেটার সাথে মোকাবেলা করতে হবে।

আজকে করোনা ভাইরাসের ভয়ে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালাচ্ছে। রাসুল (সা) এটা করতে নিষেধ করেছেন। এই অবস্থায় কেউ তার এলাকা ত্যাগ করবে না। সবাই স্ব-স্ব এলাকায় অবস্থান করবে। মুসলমান তকদিরে বিশ্বাসী, তারা এই কথায় জোড় বিশ্বাস করে যে, তকদিরে যা আছে তাই হবে কপালে কিন্তু নিজ দায়িত্বে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে এই প্রত্যয়ে যে, অন্তত আমার অবহেলার কারণে যাতে অন্য একজনও আক্রান্ত না হয়। যে ব্যক্তির চিন্তা ও মন এই ধারনায় বদ্ধমূল তাকে আল্লাহ শাহাদাতের মর্যদা দিবেন। ইসলামে কাজের আগে এভাবে মানুষের নিয়তের পরিশুদ্ধি ঘটায়।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলাতেও আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমাদের বলা হয়েছে মুখে মাস্ক পড়তে, যেখানে সেখানে কফ-থুথু না ফেলতে, হ্যান্ডস্যাক না করতে ইত্যাদি। এসব আমাদের যথাযথ মানতে হবে। এটা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এসব না মেনে মারা গেলে তিনি অন্য দশজনের মত হয়ত মরে যাবে কিন্তু শহীদি মৃত্যুর হকদার হবেন না। কেননা তার নিয়ত পরিবর্তন করতে হবে এই মর্মে যে, তিনি যে মুখে মাস্ক পড়েছেন সেটা রোগ না হবার জন্য নয়। তিনি যে হ্যান্ডস্যাক বন্ধ রেখেছেন সেটাও তার কাছে রোগ না আসার জন্য নয়। বরং তার লক্ষ্য হতে হবে, তার কাছে যদি এই রোগ নিজের অজান্তে বাসা বেঁধে বসে যায়, তাহলে তার অসর্তকতার কারণে যেন অন্যজন আক্রান্ত না হয়। এভাবে যখন সবাই চিন্তা করবে, তাহলে ভয়ানক মহামারিতেও মানুষ হিম্মত হারা হবে না। সবাই মৃত্যুকালেও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই মরতে পারবে। পাবেন শহীদি মর্যাদা। সেই মৃত্যুই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তাই আসুন নিজ দায়িত্বে সচেতন হই। আগামী কালের জুমার নামাজে ঠিক এই কথাটিই যেন মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিতে পারি, সে লক্ষ্যে একথা গুলো প্রচার করি। তাহলে আমরা সফল হব বেঁচে থেকে কিংবা মরে গেলেও।

@Tipu

পঠিত : ৫১৭ বার

মন্তব্য: ০