Alapon

ঘৃণার ব্যানার...


আমরা থাকি খিলগাঁও। আব্বুর নিজের কেনা বাড়ি। আমার আব্বু শিক্ষিত, সচেতন মানুষ। নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে হেব্বি স্ট্রিক্ট। সেইম এজ এডল্‌ফ হিটলার। ইহুদি হত্যায় হিটলার যেমন নিশ্ছিদ্র গ্যাস চেম্বার বানিয়েছ, আমাদের বাসা এখন তেমন! কোনো আসা যাওয়া নাই। পাদের গন্ধও না!

গৃহবন্দী হবার আগে সিগারেট কিনেছিলাম পাঁচ কার্টন। বাসা পরিস্কার করতে এসে সেগুলো আব্বুর হাতে পড়ে। আর যায় কই!! কোন বেদরদ ডাক্তার বলেছে, স্মোকারের ঝুঁকি বেশি। ব্যস! রুমে সিসি ক্যামেরা ফিট করেছে। সিগারেট টানতে দেখলে পাকড়াও করবে।

দশ বছর ধরে চেষ্টা -তদবির করে গর্ভবতী হওয়া নারীর মিসকারেজ হয়ে গেলে যে কষ্ট হয় -চেইন স্মোকারের হঠাৎ স্মোকিং বন্ধ করানো তার চেয়ে বেশি কষ্টের! রফিক আজাদ হইলে বলতো "সিগারেট দে হারামজাদা, নাইলে করোনা খাব। "

তারউপর বড় দুঃখ সিসি লাগিয়ে প্রাইভেসি নষ্ট!

আশ্চর্য! প্রাইভেসি বলে একটা জিনিস থাকবে না -এইটা কেমন কথা! আমি যুবক পোলা। মাঝেমধ্যে হাত চলে যেতে পারে এদিক -সেদিক!! তা পিতার দৃষ্টিগোচর হবে ভেবেই গা ঘিনঘিন করে উঠলো! গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকেজ বলে গেছেন :- অল হিউম্যান বিয়ীং হ্যাভ থ্রী লাইভস ; পাবলিক, প্রাইভেট এন্ড সিক্রেট।"

করোনা কেড়ে নিয়েছে পাবলিক লাইফ!। আব্বু কেড়ে নিলো প্রাইভেট এবং সিক্রেট দুটোই। আব্বু তো করোনার চেয়ে ভয়াবহ!

কি আর করা! ভোটার হয়েছি, ভোট দিতে পারি না - তা যেমন মেনে নিচ্ছি ; স্বৈরাচারী পিতার জুলুমও মেনে নিতে হচ্ছে। সাহাব ভাই বলেছেন - "নারী এবং বাঙালির জন্মই হয়েছে মেনে নিতে। এর ব্যত্যয় ঘটলেই জীবনে অশান্তি। "

ঔষধ, বাজার, কেনাকাটার সব করে কাজের লোক। আব্বু বাইরে যান না। আমার যাবার প্রশ্নই উঠে না! ১৪৪ জারি আমার উপর।

আজ বের হলাম। আব্বুর পেছনে। লুকিয়ে। উনি যাবেন মিটিংয়ে। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ।
মিটিং স্পটের পাশের দোকানে, আব্বুকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা স্টার্ট করলাম। মিটিং শেষ হতে দেখলেই আব্বুর আগে বাসায় পৌঁছাবো, সেই প্ল্যান।
আজ কোনো কথা হবে না। শুধু টান হবে! প্রচুর টান। টাগ অব ওয়ার গেমসে হাত দিয়ে দড়ি টানার মতো, ঠোঁট দিয়ে সিগারেট টানবো।

টানছি। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলছি -আহ! শান্তি!

মিটিংএর সবাই হেব্বী সচেতন। এলাকার কেউ যাতে করোনাক্রান্ত না হতে পারে, নানান সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। এই যেমন, মিটিং -এর শুরুতে হাত পা ধুয়ে বসেছে! মিটিং শেষে আবার ধোবে। যদিও চেয়ারে চেয়ার লাগিয়ে, কানে মুখে ফিশফিশ করে, একে অন্যকে থামিয়ে, চেপে ধরে বসিয়ে, মিটিং শেষ করেছে।

সিদ্ধান্ত এসেছে -
আমাদের খিলগাঁও কবরস্থানে করোনাক্রান্ত লাশ দাফন হবেনা। লাশের শরীরে থাকা করোনা ছড়াতে পারে, সেই ভয়ে!

ব্যানার লাগানো হয়ে গেছে।

অনুরোধ ক্রমে খিলগাঁও ও রামপুরার জনগণ।

একদম! জব্বর হয়েছে।

বাবা বললেন " নিজে বাঁচলেই তো বাপের নাম।"

দ্যাটস হোয়ায় আই সাপোর্ট মাই ফাদার। হি ইজ রিয়েলি আ সেন্সিবল পার্সন।

২।

আজ প্রায় আট দিন ধরে কোয়ারান্টিনে। আব্বুর শরীর খারাপ। জ্বর। কাশি। গলা ব্যথা নাই। তাই হেডেক নিচ্ছি না। করোনা হইলে তো গলা ব্যথা থাকবে।

তবে মা দূরে দূরে থাকা শুরু করেছেন। আলাদা রুমে থাকেন। কাল থেকে। আমার খারাপ লাগছে। আমার সচেতন পিতা, সমাজের মানুষ শ্রদ্ধা করে। কিন্তু মার ভেতর অশ্রদ্ধা জেগে উঠেছে! মার সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক নিয়ে তো কিছু বলা শোভন লাগে না। চুপ থাকলাম।

আমিও যেহেতু সচেতন। নিজ রুম ছেড়ে বের হওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছি। আব্বুর রুমের দরজার সামনেও যাই না। এমন না যে, অশ্রদ্ধা করি! ব্যস! আমার কিছু হয়ে গেলে, উনাদের কে দেখবে -তা নিয়ে চিন্তিত।

নিন্দুকেরা বলবে আমি নন্দলাল!

অথচ, আমি বেঁচে থাকলেই আমার বাপের নাম!

আব্বুই তা বলেছেন।

আব্বুর অবস্থার অবনতি হয়েছে। শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। কিছু খেতে পারে না। পানি গিলতে গেলে চিৎকার দিয়ে উঠছে। আমার অন্তরাত্মা শুনে হুহু করে উঠলো!

চিকিৎসা নামে এদেশে সেবা হয় না। হয় উপহাস!

হাসপাতালে গেলে রোগে না মরলেও, অবহেলায় মরে যায়।

তাই ইচ্ছে ছিলো না, হাসপাতালে নিয়ে যাবার। কিন্তু ক্রমশ অবনতি দেখে বাবাকে কল করে, হাসপাতাল যাবে কিনা বলতেই কেঁদে দিলেন!
বললেন "আমাকে ওরা চিকিৎসা করবে না, চেক করবে না, মেরেও ফেলতে পারে! আমার লাশ তোদেরকে দেখতে দিবে না মরে গেলে! গোসল দিবে না, দাফন করবে না, পুতে ফেলবে, যাওয়ার দরকার নাই", ইত্যাদি।

শিক্ষিত, সচেতন, কঠোর পিতার অসহায় আত্মসমর্পণ বড্ড কষ্ট দিলো আমাকে। যে শক্ত, তার উপর জোর খাটানোর ইচ্ছে হয়। যে নরম, তাকে জোর দেয়া যায় না। আমিও দিলাম না। আব্বু বাসায় পড়ে রইলেন। দরজা ফাঁক করে খাবার দিয়ে আসা হয়।

আজ সকাল থেকে আব্বু নির্জীব। শব্দ নাই কোনো। ডাকাডাকি করেছি অনেক। কেউ রুমে ঢুকছে না। শেষে আমি প্লাস্টিকে আগাগোড়া নিজেকে মুড়িয়ে দুপুরের দিকে ঢুকলাম।

মোবাইল হাতের মুঠোয়। সম্ভবত কল করতে চেয়েছিলো কাউকে। সকালের নাস্তা এখনো প্লেটে। ঘাবড়ে গেলাম এবার। চেঁচামেচি করেও লাভ হলো না। গ্লাভস পরা হাতে ধাক্কাধাক্কি করে বুঝতে পারলাম আব্বু আর নেই! আঁৎকে উঠলাম!

বাসায় বলতেই সবাই হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। পাড়া প্রতিবেশী কান্নাকাটি শুনে বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। বাসায় ঢুকছে না কেউ।

আহারে, বলে শোক প্রকাশ করে। দূর হতে! কয়েকদিনের ব্যবধানে সমাজশ্রেষ্ঠ পিতা সমাজের কাছে অচ্ছুত হয়ে গেলো!

কাজের লোকটাও চলে গেছে।

দূর সম্পর্কের আত্মীয় তো দূরের কথা, নিকটাত্মীয়ও আসেনি।

কিভাবে কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

কেউ একজন কল দিয়েছে পুলিশকে। পুলিশ এসেছে। আঞ্জুমানে মুফিদুল টিম এসেছে। তারা লাশ নিয়ে যেতে চাচ্ছে।

বললাম -
আব্বুর জানাযা হবে। লাশ আমরা দাফন করবো। আমাদের খিলগাঁও করবস্থানে।

এলাকার মানুষ চমকে উঠেছে এ কথা শুনে! না না করে উঠলো সবাই। যারা বাবার সঙ্গে এতোদিন এলাকায় সচেতনতামূলক কাজ করে আসছিলো, বাবা যেভাবে বলেছে, বাধ্যের মতো করে গেছে -তারাই দূর দূর করে উঠলো!

আব্বুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রফিক সাহেব তো বলেই ফেললেন- "আমাদের কবরস্থানে করোনাক্রান্ত লাশ দাফন করতে দেয়া হবেনা -এই সিদ্ধান্ত তোমার আব্বুর। আমরা উনার কথাই পালন করছি!"

আমার আর কিছু বলার ছিলো না! আসলেই তো!

তবে-
যে ভয়ে আব্বু হাসপাতালে যেতে চান নাই, সেটাই সত্য হবে?

কষ্টে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগলো।

কন্ট্রোল হারিয়ে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম! বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ -বাতাস ভারী করে আকুতি জানাতে লাগলাম -বাবার শেষ ইচ্ছে ছিলো, দাদার কবরের পাশে যেনো উনাকে দাফন করা হয়!

কেউ পাত্তা দিলো না!

এ রোগ আল্লাহর দান। আব্বু নিজে তা জন্ম দেয় নাই। যেচে গিয়ে করোনাকে নিজের ভেতর ঢুকায় নাই।

তাহলে কেন তার লাশ সমাজের কাছে ঘৃণার বস্তু হয়ে গেছে?

মুসলমান হিশেবেও একটু সহানুভূতি পেতে পারতেন না?

মুসলমান কি মৃত্যু ভয়ে অমানুষ হইতে পারে?

তবে মুসলমান কীভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হইতে পারে?

বাবাকে তারা নিয়ে গেলো। কোথায়, আমি জানি না। আমাকে সঙ্গে যেতে দেয়নি! দাফন করেছে না পুঁতে ফেলেছে তাও জানি না।

সমাজকে দোষ দিতে গিয়ে নিজের অপরাধ চোখে পড়লো।

সেদিন যদি প্রতিবাদ করে বলতাম,
-এমন ঘৃণ্য ও অসভ্য সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না!

তাহলে আজ আব্বুকে হারালেও, লাশটি হারাতাম না।

কবরের পাশে দাঁড়িয়ে উনার জন্য দোয়া করতে পারবো না ভেবেই আরো কষ্ট হয়।

কবরস্থানের পাশ দিয়ে গেলে এখনো দেখি বোর্ডে লেখা "করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ খিলগাঁও -এর পরিবর্তে অন্য কোথাও দাফন করতে হবে "

একবার ভেবেছি ছিঁড়ে ফেলবো। ছিঁড়ি নাই। আমার বাবাকে দাফন করতে দেয়নি শালারা! কারো বাপকে দাফন করতে দেব না। করোনা তো দূরে থাক। এই সময়ে স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও না। থাকুক ব্যানার!

@আহমেদ সাহাব

পঠিত : ৪৬৮ বার

মন্তব্য: ০