Alapon

পাক স্নায়ুবিজ্ঞানী আফিয়া সিদ্দিকী;পশ্চিমাদের কথিত ওয়ার অন টেররের নির্মমতার স্বাক্ষী




আজ ৩১ মার্চ ২০২০ দিনটি হলো ড. আফিয়ার নিরুদ্দেশের ১৭ তম বার্ষিকী। ১৭ বছর আগে ২০০৩ সালের ৩১ মার্চ রাতে এনবিসি নিউজের রাতের সংবাদে তার অন্তর্ধানের বিষয়টি প্রথম নিশ্চিত করা হয়। যে বন্দিনীর মর্মান্তিক ইতিহাস পশ্চিমাদের মানবিক মুখোশের আড়ালে এক অমানবিক চরিত্র উন্মোচিত করে দেয় পৃথিবীজুড়ে।


আফিয়া সিদ্দিকীর সাথে যা ঘটেছিল-
ড. আফিয়া সিদ্দিকী যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিখ্যাত একজন মুসলিম স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং একজন আলোচিত মহিলা। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে “নিউরোলজি” বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। এছাড়াও সম্মান সূচক ও অন্যান্য ডিগ্রীর ১৪০ টিরও বেশি সার্টিফিকেট তিনি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি “হাফিযে কোরআন” ও “আলিমা”। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে পারদর্শিনী এ নারী ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত দ্বীনদার। ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি রয়েছে তার দৃঢ় অঙ্গীকার। পিএইচডি ডিগ্রি ধারী পাক-আমেরিকান সম্ভ্রান্ত এই মুসলিম মহিলাকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ২০০৩ সালে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় পাকিস্তানের করাচির রাস্তা থেকে আল-কায়দার সাথে যোগাযোগ থাকার কথিত অভিযোগে অপহরণ করে তিন সন্তান আহমদ, সুলাইমান ও মারিয়মকে সহ। গুমকৃত অবস্থায় পাঁচ বছর ধরে আফগানিস্তানের কুখ্যাত বাগরাম কারাগারে বন্দি রাখা কালে তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তাকে মানসিক, যৌন ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হত এবং তাকে দিনের মধ্য কয়েকবার করে ধর্ষন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়। তার একটি কিডনিও বের করে ফেলা হয়েছিলো ফলে তিনি হাঁটতে পারতেন না। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে তাকে গুলি করা হয় এবং তার বুকে গুলির আঘাত ছিলো। কারাগার থেকে তার বহুল আলোচিত চিঠিটি লেখার পর যেই নৃশংসতার চিত্র প্রকাশ্যে আসে। বাগরাম কারাগার থেকে মুক্তি প্রাপ্ত বন্দিরা অভিযোগ করেছে “নির্যাতনের সময়ে আফিয়ার আত্মচিৎকার অন্য বন্দিদের পক্ষে সহ্য করাও কঠিন ছিলো।” ওই নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করার জন্য অন্য বন্দীরা অনশন পর্যন্ত করেছিলো।



অভিযোগের ইতিবৃত্ত-
তাকে অপহরণের পাঁচ বছর পর ২০০৮ সালে আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশে অজানা রাসায়নিক পদার্থ ও হামলার পরিকল্পনার নোট সহ কথিত অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। মার্কিনীদের বক্তব্য হলো, তাকে গ্রেফতারের সময় তার সাথে থাকা হাতব্যাগ তল্লাশি করে মার্কিন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা-সংবলিত কাগজপত্র, গজনির মানচিত্র, রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির নিয়মাবলি ও রেডিওলজিক্যাল এজেন্ট সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া গেছে।
যে অভিযোগ প্রসঙ্গে ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ১৯ মার্চ ২০১০ এ 'Robert Fisk: The mysterious case of the Grey Lady of Bagram' শিরোনামের একটি কলামে মন্তব্য করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডিধারী একজন পাকিস্তানি-আমেরিকান তার হাতব্যাগে মার্কিন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা নিয়ে ঘুরছেন- এটি কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য?’
[তথ্যসূত্র দেখতে ক্লিক করুন এখানে]



আফিয়ার কেইসটি ছিল মার্কিন বিচারব্যবস্থার দ্বিচারীতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ-
“বিশ্ব জুড়ে সব জায়গায়তেই অভিযুক্তরা “বেনেফিট অব ডাউট” বা সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচিত হয়। ফলে সকল সুবিধা পায়। কিন্তু ড. আফিয়া তা পাননি বরং ৩৮ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানীকে কথিত অভিযোগে ৮৬ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয় এবং কুখ্যাত বাগরাম কারাগারে ভয়ঙ্করতম নির্যাতনের শিকার হন। তার ক্ষেত্রে অথচ মার্কিন বিচার ব্যবস্থাকে অনেকেই ন্যয়বিচারের মানদণ্ড ভাবে! ”
তার বিরুদ্ধে সাতটি মামলা করা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ড. আফিয়া সিদ্দিকী মার্কিন উচ্চ আদালতে আপিল করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর আদালতে আপিল করেছি।’ রায় ঘোষণার পর আফিয়া আদালতে বলেন, আমেরিকা নয়, ইসরাইল থেকে এসেছে এ রায়। এই আদালত বয়কট করি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে আমি যে নির্দোষ, তা প্রমাণ করতে সক্ষম, কিন্তু বিচারকের প্রতি আমার আস্থা নেই।’ আর বিচারকও তাকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ দেননি। আফিয়া আগেই বলেছিলেন, কোনো ইহুদি বিচারক থাকলে তিনি (আফিয়া) ন্যায়বিচার পাবেন না এবং ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন বিচারক নিয়োগ করা হোক।

২০১৬ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে পাঠানো চিঠিতে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মা ইসমত সিদ্দিকী বলেন-
‘অপহরণের পর আমার মেয়েকে এই কয়েক বছর ধরে জোর করে তার সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা, তার ওপর নির্যাতন চালানো, গুলি চালানো, মারধর করা, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা এবং বিবস্ত্র করার ভাবনায় আমার হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এমনকি, এখনো তার ডিটেনশন ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণ সৌজন্যবোধও মানা হচ্ছে না। যারা নিজেদের সবচেয়ে বেশি সভ্য, ন্যায়ানুগ বলে দাবি করেন এটি তাদের করা গুরুতর এক অন্যায়-অবিচার।’

সর্বশেষ অবস্থা-
২০০৮ সালে তাকে স্থানান্তর করা হয় নিউইয়র্কের এক গোপন কারাগারে। এখন তিনি আছেন টেক্সাস স্টেটের এক কারাগারে। বর্তমানে তিনি পুরুষদের সাথে ওই কারাগারে বন্দি। কারাবন্দি নম্বর ৬৫০। চলমান নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি মানসিক ভারসাম্য হরিয়ে ফেলেন। এদিকে ২০১৮ সালের মে মাসে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যুর সংবাদ গুজব বলে প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের হস্টন শহরে নিযুক্ত পাকিস্তানি কূটনীতিক আয়েশা ফারুকী। তিনি তার বক্তব্যে জানান, গত ১৪ মাসে চতুর্থবারের মতো ড. আফিয়া সিদ্দিকীর সাথে টেক্সাসের কারাগারে আমার সরাসরি দেখা হয় এবং তার সাথে প্রায় ২ ঘন্টা যাবৎ কথা হয়।
পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এক সময় দাবি করে বলেছিলেন, ‘তার দুই সন্তান মার্কিননিয়ন্ত্রিত আফগান কারাগারে অত্যাচারে মারা গেছে। তিনি আরো বলেছেন, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের মধ্যে যারা ড. আফিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’ এছারাও বর্তমান ক্ষমতাসীন পাক সরকার তাকে ফিরিয়ে আনতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট।
এছাড়াও গত ১৭ বছরব্যাপী চলমান আফগান যুদ্ধ অবসানে আমেরিকা ও আফগান তালেবানদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যে বারকয়েক বৈঠক হয়েছে, প্রতিটি বৈঠকে অলোচনায় উঠেছে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মুক্তি প্রসঙ্গ। সমঝোতার অন্যতম শর্ত ছিল এটি।



কিন্তু মার্কিন কারাগার থেকে আদৌ তিনি মুক্তি পাবেন কি না, এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথিবীজুড়ে।

পঠিত : ১২৮৫ বার

মন্তব্য: ০