Alapon

গ্রানাডা পতনের কারণ এবং প্রকৃত ইতিহাস...


১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারী গ্রানাডার আমির দ্বাদশ মুহাম্মাদ (আবু আবদুল্লাহ) ফার্ডিন্যান্ড-ইসাবেলার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন,প্রধানত দুটো কারনে,এক নম্বর কারন,তাদের খাবার ও রসদ শেষ হয়ে গেছিল,দুই নম্বর কারন,তার আমীর ওমরাহ ও জনগনের মধ্যে প্রচুর পরিমান গাদ্দার ছিল।

সে সময় গ্রানাডার মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিল প্রায় পাচ লাখ বা তার কাছাকাছি।এছাড়া গ্রানাডার কাছাকাছি আলমেরিয়া,মালাগা,আলবেসিন অঞ্চলে প্রচুর মুসলিম বসতি ছিল।সিয়েরা নেভাদা,সিরাদরমিজা ও সিরারোন্দা পার্বত্য অঞ্চল,আল ফাজরা পার্বত্য অঞ্চলে আরো প্রায় পাচ লাখ মুসলিম বাস করতো।

এটা গেল স্রেফ গ্রানাডার কথা।বাকি স্পেনের ইতিহাস অন্যরকম।

১২১২-১২৫২ সাল,এই চল্লিশ বছরেই প্রকৃতপক্ষে ইসলামিক স্পেন বা আল আন্দালুসের কবর রচিত হয়ে যায়,১২৫২ সালের পর খ্রিস্টানদের করদ রাজ্য হিসেবে টিকে ছিল গ্রানাডার নাসরি আমিরাত।

১৪৮৭ সালে মালাগা ও আলমেরিয়া হারানোর পরেই মূলত নিশ্চিত হয়ে যায় যে আজ হোক কাল হোক,গ্রানাডা আর টিকবে না।

এখন কথা হল,এগুলোর কোনটাই প্রমান করে না যে আমার বক্তব্য সঠিক বা ভুল।তাহলে আমি যে বলেছি,১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল গণহত্যা হয় নি,তার প্রমাণ কি??

উত্তর,ইতিহাস এবং ১৪৯২-১৫০১ সালের আইবেরিয়ান পেনিনসুলার রাজনীতি।

গ্রানাডা হস্তান্তরের চুক্তি হয় ১৪৯১ সালের শীতের শুরুর দিকে,২৫শে নভেম্বরে।শীতের মাঝামাঝি জানুয়ারীর দুই তারিখ গ্রানাডার ও আলহামরার চাবি আবু আবদুল্লাহ হস্তান্তর করেন।

তারপর তিনি পার্বত্য উপত্যকা আলফাজরায় চলে যান।

গ্রানাডার চুক্তিতে মোট ৬৭টি ধারা ছিল।এই চুক্তিতে আত্মসমর্পণ করা গ্রানাডার মুসলিমদের ব্যাপক স্বাধীনতা দেয়া হয়,এবং চুক্তিটা ছিল যেকোন সময়ের হিসাবে বেশ উদার একটা চুক্তি

এত উদার চুক্তি খ্রিস্টানরা কেন করেছিল??

কারন একটাই,টানা দশ বছরের যুদ্ধের পর তাদের অর্থ ভান্ডারে টান পড়েছিল,তারা চাইছিল স্পেনের ধনী ইহুদিদের লুট করে সেই ঘাটতিটা পুষিয়ে নিতে।যেহেতু মুসলিমরা অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছিল,তাই তাদের ডিমিলিটারাইজ করে,নতুন শক্তিতে তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার জন্য ফার্দিনান্দের সময়ের দরকার ছিল।

ইতিহাসের কোথাও,এই মর্মে কোন প্রমাণিত বর্ননা নাই যে ঐ সময়ে ফার্দিনান্দ মসজিদে আগুন লাগিয়ে মুসলিমদের গণহত্যা করবে,সেটা করলে তাকে অন্তত আরো পাচ বছর গেরিলা যুদ্ধের মোকাবেলা করা লাগতো। তার বদলে ফার্দিনান্দ আলহামরা ডিক্রি জারি করে ইহুদীদের স্পেন ছাড়ার আদেশ দেয়,তাদের সম্পদ লুট করা শুরু করে। মুসলিমরা আবু আব্দুল্লাহ গ্রানাডা ছাড়ার পরেও কয়েক বছর পর্যন্ত ভালোই ছিল,কিন্তু ফার্দিনান্দের ক্ষমতা ধীরে ধীরে সুসংহত হবার পর তিনি নীতির পরিবর্তনন করতে থাকেন।

তাকে সবচাইতে বেশি চাপ দেয় স্পেনের ফ্রান্সিস্কান ও ডোমিনিকান মতবাদে দীক্ষিত যাজকরা।

১৪৯৬ সালে গ্রানাডার বিশপ পদে নিযুক্ত হন ফ্রান্সিস্কো জিমিনেজ নামের এক ডোমিনিকান মতবাদে দীক্ষিত পাদ্রী।

তার আগের বিশপ ট্যালাভেরা ছিলেন বেশ সহনশীল একজন যাজক,কিন্তু জিমিনেজের মত হিংস্র যাজক গোটা স্পেনেত ইতিহাসে কম ছিল।

জিমিনেজ আসার পর থেকেই গ্রানাডায় মুসলিমদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন,তাদের হিজরতে বাধা দেয়া হয়,জোর করে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়।যেহেতু স্পেনের মুসলিমদের মধ্যে ততদিনে লড়াইয়ের মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেছিল,তাদের দাসে পরিনত করা তখন অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল।

একসাথে লাখ লাখ মুসলিম হত্যার যে তথ্য দেয়া হয়,তা সঠিক না।স্পেন মুসলিমদের এথনিক ক্লিঞ্জিং করেছে খুব ধীরে ধীরে।হত্যার চাইতে দাসে পরিনত করেছে অনেক বেশি।

এটার একটা বড় কারন,গনহত্যা চালালে ফার্দিনান্দের ট্যাক্সপেয়ারের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যেত,কমে যেত স্পেনের শ্রমিক,শিল্পি ও কারিগর,ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা।কারন মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার হার ছিল অনেক বেশি।এই হিউম্যান রিসোর্স লস ফার্দিনান্দের জন্য পছন্দনীয় ছিল না,কারন ১৪৮০ এর দশক থেকে ফ্রান্সের সাথে স্পেনের যুদ্ধ চলেছিল পরবর্তী প্রায় আশি বছর।

এই সময়ে ফ্রান্সের জনসংখ্যা স্পেনের চাইতে অনেক বেশি ছিল,ফলে ফ্রেঞ্চ সম্রাটের ট্যাক্সপেয়ারের সংখ্যাও ছিল বেশি।

সব মিলিয়ে,১৪৯৯ সালের আগে কোন মাস এক্সিকিউশন,মাস কনভার্সন বা মাস পারসিকিউশন গ্রানাডাতে হয় নাই,অন্যত্র হয়েছে।

আমাকে একথা প্রমান করতে হচ্ছে একারনে,কারন রিকনকুইস্তা সম্পর্কে বেসিক নলেজ ছাড়াই,কিছু আবেগী বয়ানকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবনতা বাঙ্গালির মধ্যেই সবচাইতে বেশি।সর্বত্রই বাঙালি আবেগ কপচায়।সর্বত্রই,অমুকের কথা তো ভুল হতেই পারে না টাইপ মন মানসিকতা নিয়ে বসে থাকে,নিজে কিছু পড়তে বা বিশ্লেষন করতে যেটুকু সময় বা শ্রম বিনিয়োগ করা লাগে,তা করতে বাঙালির ব্যাপক অনীহা।

@Sajal

পঠিত : ৬১০ বার

মন্তব্য: ০