Alapon

ভারতে করোনা ইস্যুকে কি 'করোনা জিহাদে' রূপান্তরিত করা হচ্ছে...?


ভারতে করোনা ইস্যুকে 'করোনা জিহাদে' রূপান্তরিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এটা চিরাচরিত হিন্দুত্ববাদী প্রক্রিয়ার বাইরের কিছু না। ভারতীয় গণমাধ্যম গোঁড়া থেকেই এইরকম একটা কিছু দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে সেটা সুস্পষ্টভাবেই বুঝা গেছে আরও আগেই।

সর্বভারতীয় প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু, ২৬ মার্চ দীপক হরিচন্দনের আঁকা একটা কার্টুন প্রকাশ করেছে যেখানে করোনা ভাইরাসকে ভারতীয় মুসলমানদের 'সিগনেচার ড্রেস' কোর্তা, পাজামা আর কোটি পরিয়ে সেটাকে হাতে একটা Ak-47 দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাক করিয়ে রাখা হয়েছে।

ফলে ট্রাম্প যখন এটাকে ভূরাজনীতির শত্রু-মিত্র বিবেচনায় ঘৃণাবাদী চরিত্র নিয়ে এটাকে 'চাইনিজ ভাইরাস' বলছে- তখন ভারতীয় গণমাধ্যম আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে পৃথিবীর এই ভয়াবহতম সঙ্কটকালেও মুসলিম বিদ্বেষী চরিত্র থেকে নূন্যতম সরতে পারে নাই।

তারা ভাইরাসটাকে 'মুসলমানের' রূপে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। এই ভাইরাস যেমন মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য নির্মূল করা প্রয়োজন তেমনই মুসলমানদেরও জাতিগতভাবেই ধ্বংস করা প্রয়োজন। প্রকারান্তরে এটাই হচ্ছে দেশটির শীর্ষ এক গণমাধ্যমের রঙ্গ উপস্থাপনা।

ফলে নিজামুদ্দিন মারকাজ ফেরত সাতজনের(ভিন্নসুত্রে দশজনের) করোনায় যখন মৃত্যু হয়েছে তখন ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রচারভঙ্গি এমন যে, মনে হয় ভারতে মসজিদ থেকেই কেবল করোনার উদ্ভব হয়েছে! নইলে যেন ভারতবর্ষে করোনার কখনো দেখাই মিলত না!

যা হোক, আগে নিজামুদ্দিনের ঘটনাটা একটু খোলাসা হওয়া যাক। ঘটনাক্রমগুলো একটু লক্ষ্য করলেই পুরো পরিস্থিতিটা বুঝা যাবে।

• মালয়েশিয়ায় গত ফেব্রুআরির শেষে একটা জামায়েত অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নিজামুদ্দিন মার্কাজ থেকেও কিছু লোক অংশ নেন। মার্চের প্রথম সাপ্তাহে তারা সেখান থেকে দিল্লি ফেরেন। তাদের সঙ্গে মালয়েশিয়া থেকেও কিছু লোক দিল্লি আসে।

• মার্চের ১১, ১২, ১৩ তারিখ দিল্লিতে বড়ো জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। তখনও পর্যন্ত ভারত সরকার করোনাকে আমলে নেয় নি। এমনকি ১৩ তারিখ সরকারের স্বাস্থ্য দফতর বিবৃতি দিয়ে বলে, করোনা ইস্যু 'কোনও হেলথ ইমারজেন্সি' নয়।

ফলে এই জমায়েতকে দোষ দেওয়া যায় না। এমনকি ভারতীয় ইমিগ্রেশন দফতর সেখানে ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ৩০০ তাবলীগের কোনও কর্মীকেই কোয়ারেন্টাইনের কথা বলে নি।

• ১৯ তারিখ প্রথমবারের মত ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। মারকাজ তাদের বিবৃতিতে বলেছে রাতে সেই ভাষণ প্রচারের পরই মারকাজ তাদের সামনের কর্মসূচি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।

• ২০ তারিখ এত লোকের পক্ষে একদিনেই বাহন স্বল্পতায় চলে যাওয়া অসম্ভব ছিল। এসবের মধ্যেও মারকাজ পাঁচশো জন লোককে বাইরোডে গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে।

• ২১ তারিখ ভারত সরকার ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বেশিরভাগ লোকই দূর শহরের ট্রেনযাত্রী ছিল। ফলে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।

• ২২ তারিখ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জনতা কার্ফিউ ঘোষণা করায় মারকাজ থেকে বেরুনো সেদিন কারোর জন্যই সম্ভব ছিল না।

• ২৩ তারিখ থেকে দিল্লির মূখ্যমন্ত্রী পুরো রাজধানী লক ডাউন ঘোষণা করেন। ফলে আটকে যাওয়া লোক মসজিদের ভেতরেই বন্দী হয়ে পড়ে।

• ২৩ মার্চ অর্থাৎ সেদিনই মার্কাজ স্থানীয় সাংসদকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে। স্থানীয় সাংসদ আম আদমি পার্টির আমানুল্লাহ খান নিজামুদ্দিনে দিল্লি পুলিশের এসিট্যান্ট কমিশনারকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে।

• সে অনুরোধ আমলে না নিলে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশের উত্তর-পূর্ব রেঞ্জের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি কমিশনারকেও তিনি অনুরোধ করেন।পুলিশ দৃশ্যত নীরব থাকে। খোদ সেই সাংসদ টুইটারে এই তথ্য জানিয়েছেন।

• ২৪ তারিখ কর্তৃপক্ষ দিল্লি পুলিশের স্থানীয় স্টেশন হাউজ অফিসার (থানা ইনচার্জ) এর স্বাক্ষরিত নোটিশ পায় মার্কাজ প্রাঙ্গণ বন্ধ ঘোষণার। তারা পুলিশকে জানায় পনেরোশর মত লোক এখানে আটকা আছে যাদের মধ্যে কমপক্ষে এক হাজার বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যের।

• ২৫ তারিখ সেই অঞ্চলের তহশিলদারের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম মারকাজে যায় ও স্বাস্থ পরিক্ষা করে। (জ্ঞাতব্য, তহশিলদার বাংলাদেশে কেবলই সহকারী ভূমি কর্মকর্তা হলেও ভারতে প্রথম শ্রেণির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ভোগ করে তারা।)

• ২৬ তারিখ তহশিলদারের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট (সাব ডিবিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট) সরেজমিন মার্কাজ পরিদর্শন করেন। তাকেও অনুরোধ করা হয়, যেন লোকেদের ফেরার বন্দোবস্ত করা হয়।

তিনি বলেন, এ ব্যাপারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। অথচ ১৯৭৩ সালের ভারতের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অনুযায়ী জনস্বার্থে যে কোনও প্রিভেন্টিভ ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তার রয়েছে।

• মার্কাজ কর্তৃপক্ষ সেদিনই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে বৈঠকে গাড়ির বন্দোবস্ত করার অনুরোধ করে।

• ২৭ তারিখে আটকে পড়াদের মধ্যে অসুস্থ বোধ করা ছয়জনকে নিয়ে যাওয়া হয় স্বাস্থ্য পরিক্ষার জন্য।

• ২৮ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা প্রতিনিধি দল সেখানে আসে। সম্ভবত প্রটোকল বিবেচনায় সাব ডিবিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট তাদেরসঙ্গে আবারও মার্কাজ আসেন । সেদিন ৩৩ জনকে নতুন করে স্বাস্থ্য পরিক্ষার জন্য নেওয়া হয়।

• ২৯ তারিখ, দিল্লি পুলিশের লাজপাত নগর এসিট্যান্ট কমিশনার অফিস থেকে চিঠি দিয়ে 'জমায়েত বন্ধের নিষেধাজ্ঞার অমান্যের দায়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।'

• মার্কাজ পত্রের জবাব দেয় এবং পরিস্থিতি ব্যাখ্যা দেয়। তারা এও জানায়, নিষেধাজ্ঞার পর থেকে আটকে পড়া ব্যতীত নতুন কাউকে তারা মার্কাজে ঢুকতে দেয় নি।

এরপরের খবর তো সবারই জানা। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২৪ জন শণাক্ত হয়েছে করোনা পজিটিভ। মারা গেছেন বেশ কজন।

আর বাস্তবতা হচ্ছে, এই দুঃখজনক ঘটনায় সম্পূর্ণভাবেই প্রত্যক্ষ দায়ী হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের গাফিলত।

মোদী সরকারের পুলিশ বিভাগের উচ্চতর দফতর, কেজরিওয়াল সরকারের রাজ্য প্রশাসনের তহশিলদার থেকে শুরু করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং এমএলএ পর্যন্ত অবস্থা প্রথম দিন থেকেই সরেজমিন অভহিত ছিলেন।

এর পরও কেন কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কেন কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয় নি সে প্রশ্ন না তুলে উল্টো মারকাজের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

মাওলানা সা'দকে ব্যক্তিগতভাবে আমিও আদর্শিক জায়গায় অপছন্দ করি। কিন্তু স্টেট নেগলিজেন্সের মাধ্যমে এতগুলো মানুষের জীবন বিপন্ন করে তোলে পরিস্থিতি খারাপ দেখে উল্টো তার নামেই কেজরিওয়ালের মামলা করার নির্দেশ একটা অবিচারমূলক ব্যাপার।

এইরকম ঘটনায় হিন্দুত্ববাদী মিডিয়াও জনমত বায়াসড করে সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্ট উগ্র দিতে চাইছে। অথচ উচিত ছিল তরিঘড়ি মামলা করে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর বদলে একটা ইন্ডিপেনডেন্ট জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি করা।

রাষ্ট্র সমূহের এই যে নাগরিকের প্রতি উদাসীনতা এই নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সচেতন থাকতে হবে যে কোনও ইসলামোফোবিক এজেন্ডার ব্যাপারেও।

অনেকে দ্বিমত করবেন, তবুও আমার মনে হয় আদতে বাঙালি মুসলমান ইসলাম নিয়ে বড্ড সংকীর্ণতায় ভোগে। ফলে সব ব্যাপারেই তারা ভীষণ এপোলোজেটিক।

কিছু ঘটলেই এপোলোজি প্রকাশ করতে বাছবিচারহীন কখনো উলামাদের গালি দিয়ে, কখনো মসজিদ মাদ্রাসাকে গালি দিয়ে যেন নিজেকে রক্ষে করে।

ভারতে সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরও যেভাবে মন্দির কেন্দ্রিক আয়োজন এখনো কোথাও কোথাও হচ্ছে সেটাও খারাপ। মন্দির, মসজিদ, তাবলীগ, গীর্জা যেখানেই প্রয়োজন হোক জনস্বার্থে প্রয়োজনে কন্টাজিয়াস ডিজিজ কন্ট্রোলে ফোর্স প্রয়োগ করা, কার্ফিউ জারি করা সব রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

জনগণের উপর দায় চাপিয়ে কিম্বা ভিক্টিম ব্লেমিং করে রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব থেকে দায়মুক্তি দেওয়া যায়। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব কতখানি পালন করেছে ইতিহাস একদিন কেবল সে বিচারই করবে।
-Arju Ahmad

পঠিত : ৪১৫ বার

মন্তব্য: ০