Alapon

শাইখ আহমাদ ইয়াসীন: একটি নাম, একটি ইতিহাস...


সে রাতে আর দুচোখের পাতা এক হয়নি শাইখ আহমাদ ইয়াসীনের। রাতের প্রায় অর্ধভাগ কেটে গেছে। শেষ প্রহর নেমে এসেছে। এটা এমন এক সময়, যখন স্বয়ং প্রতিপালক বান্দাকে ডাকতে থাকেন, কার কি প্রয়োজন তা চেয়ে নেয়ার জন্য। গায়ে আছড়ে পড়া শেষ রাত্রির নির্মল বাতাস এই ডাককে আরো জানান দিয়ে যায়। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন আর বিছানায় গেলেননা, প্রস্তুতি নিয়ে তাহাজ্জুদের নামাজে হাত বাধলেন।

পুরো রাতজুড়ে সাথে ছিলো দুই ছেলে। বাবার সাথে উভয়ই সে রাত কাটিয়েছে অনিদ্রায়। শাইখ নামাজে থাকাবস্থায় গোপনসূত্রে চাঞ্চল্যকর একটা খবর কানে আসলো দুজনের, আজ ফজরের নামাজের সময়ই ইসরায়েলি বাহিনী শাইখের উপর হামলা করতে পারে। শাইখের নামাজ শেষ হতেই ছেলে দুজন ছুটে আসলো বাবার কাছে, “বাবা, আজকে ফজরের নামাজে মসজিদে না যাওয়াটাই উচিৎ হবে। একটু আগে খবর পেয়েছি, আপনার উপর আজ হামলার পরিকল্পনা আছে ইসরায়েলের।”

ছেলেদের কথা শুনে মুখে এক চিমটি মুচকি হাসি জড়িয়ে অন্তরে পুষে রাখা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন, “বাছারা, আমাদের উদ্দেশ্য কী? আমরাতো শাহাদাতের অন্বেষণকারী। আমাদের এতো সংগ্রাম তো সেই ক্ষণের জন্য, সেই দিনের জন্য, যেদিন আমরা আপন রবের সাথে সর্বোত্তমভাবে মিলিত হব।” কথা বলতে বলতে মসজিদের মিনার হতে ভেসে আসলো মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ফজরের আযান। মসজিদে যেতে সহকর্মীদের আদেশ দিলেন। হুইলচেয়ারে করে মসজিদের পথ ধরলেন শাইখ আহমাদ ইয়াসিন। পিছন থেকে হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে দুই ছেলে।

মসজিদের পথ শেষের দিকে। হঠাৎ আকাশ থেকে হেলিকপ্টারের বিকট আওয়াজ কানে বাড়ি খেল। বাতাসে ধুলি কণা চারিদিক উড়ে রাস্তা কুয়াশাচ্ছন্ন করে দিল। চোখের পলকে হেলিকপ্টার থেকে ছুড়ে মারা হলো মিসাইল। মিসাইলের আওয়াজে কেঁপে উঠলো রাস্তার চারপাশ। শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন ফিলিস্তিনের জিহাদী আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। শহীদ হলেন সাথে থাকা দুই ছেলে আর ১২ জন সহকর্মী।

ফিলিস্তিনের আকাশ থেকে খসে পড়লো আরেকটি দীপ্তিময় তারকা। যার হাত ধরে শুরু হয়েছিল ফিলিস্তিনের জিহাদী আন্দোলনের নব-অধ্যায়। শুধু হুইলচেয়ার আর খাটে বসে তিনি কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছেন যাইয়নবাদী ইসরায়েলের বুকে। কোনভাবেই তিনি আরজে মুকাদ্দাসায় ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে মেনে নেননি। তাদের সাথে যে কোনধরনের চুক্তিকে পায়ের নিচে ছুড়ে মেরেছেন। কেননা তাদের সাথে চুক্তি করার অর্থ হলো, ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়ার নামান্তর।

বাল্যকাল থেকে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের মন-মগজে জায়গা করে নেয় ইহুদিদের প্রতি চরম ক্ষোভ আর বিদ্বেষ। স্বপ্ন দেখতে থাকেন পবিত্র ভূমি থেকে ইয়াহুদিদের বিতাড়িত করেই তবে ক্ষান্ত হবেন। কিন্তু একটা দুর্ঘটনায় শৈশবে পঙ্গু হয়ে পড়েন। তবুও তার স্বপ্ন-সাগরের জলরাশি বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। হুইলচেয়ারে বসেই সব করবেন। আল-আজহারে পড়তে মিশরে যান। অসুস্থতার কারণে পড়ালেখা শেষ করতে আর সক্ষম হননি, ফিরে আসেন দেশে।

১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তেফাদার পর প্রতিষ্ঠা করেন হামাস। সূচনা হয় হামাসের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন এক সশস্ত্র প্রতিরোধ লড়াই। তার আশেপাশে জড়ো হয় ফিলিস্তিনের সংগ্রামী মানুষ। তার হাতে জ্বালানো জিহাদের মশাল দ্রুতই ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে উত্তপ্ত করে তুললো। তিনি আরজে মুকাদ্দাসকে মুক্ত করার পন্থা পরিপূর্ণরূপে ঠাহর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাইতো দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা দেন-
“ফিলিস্তিনের সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে নামতে হবে। আমাদের আরবের কোন নেতা বা বাদশা সাহায্য করতে আসবেনা।”

ইসরায়েলের এই পথের কাটা সরানোর প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। তার আওয়াজকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য কয়েকবার বন্দি করে ইসরায়েল। জেলে চালায় অমানুষিক নির্যাতন। হামাস বিভিন্নভাবে আহমাদ ইয়াসিনকে মুক্ত করে নেয়। ইসরায়েলের কাছে এবার হত্যাই উপযুক্ত ঠেকল। অবশেষে শাইখ আহমাদ ইয়াসিন ২০০৪ সালের ২২ মার্চ হেলিকপ্টার থেকে ইসরায়েল কাপুরুষোচিত হামলায় শাহাদাৎ বরণ করেন।

CT

পঠিত : ৬৪১ বার

মন্তব্য: ০