Alapon

রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে তালেবানরা



আফগানিস্তানে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে একটা রাজনৈতিক সমঝোতা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে যে এখনও সংগ্রাম করতে হচ্ছে, এর অর্থ হলো তারা দেশটিতে শান্তির জন্য যে চেষ্টা চালাচ্ছে, সেটা খুব একটা চিন্তা-ভাবনা প্রসূত পরিকল্পনা ছিল না। অনেকটা ছেলে ভুলানো ব্যাপার ছিলো। যা নিয়ে তারা এখন যথেষ্ট চাপে আছে।

পরিহাসের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র যেখানে আফগানিস্তানে তাদের প্রধান শত্রু তালেবানকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে পেরেছে এবং তাদের সাথে একটা চুক্তিও স্বাক্ষর করতে পেরেছে, সেখানে তারা তাদের মিত্র কাবুলের আশরাফ ঘানি সরকারকে একটা রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে রাজি করাতে পারছে না। কাবুল প্রশাসন মূলত আফগানিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র আর কাবুল একটা ‘ঐক্য সরকার’ গঠনের প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় শর্তে এবং এর মাধ্যমে মার্কিন-তালেবান চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত হতে এখনো পারেনি। এই ব্যর্থতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে চলতি বছরে আফগানিস্তানের জন্য বরাদ্দ সহায়তা থেকে এক বিলিয়ন ডলার কাটছাট করেছে। ২০২১ সালে আরও এক বিলিয়ন কাটছাট করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য আশরাফ ঘানি ও আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বাধীন প্রধান আফগান পক্ষগুলোকে চাপ দেয়া অব্যাহত রেখেছে যাতে তারা আলোচনা শুরু করে এবং যাতে এর সূত্র ধরে তালেবানদের সাথে সংলাপ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এমন একটা রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো যেখানে তালেবানরা রাজনৈতিক অংশীদার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং যুক্তরাষ্ট্র এই দেশের সাথে এতটা সংশ্লিষ্ট থাকার সুযোগ পাবে যাতে মধ্য এশিয়ায় তাদের বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। সে কারণে আফগানিস্তানে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ।

ঘানি ও আব্দুল্লাহকে একটা ‘ঐক্য সরকার’ গঠনের ব্যাপারে রাজি করাতে ব্যর্থ হওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও দোহা যান এবং সেখানে তালেবানদের সাথে বৈঠক করেন। এর মাধ্যমে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের উপর তাদের গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে। এই বৈঠকটির মাধ্যমে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির ব্যাপারে কাবুলের প্রতি একটা বার্তা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এমন একটা সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেছে যে, কাবুলকে এখানে পুরোপুরি সরিয়ে রাখা হতে পারে।

এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আরও বেশ কিছু আফগান রাজনৈতিক নেতা – বিশেষ করে বিরোধী নেতা – তারা তালেবানদের সাথে সংলাপে আগ্রহী নয় এবং রাজনৈতিক মূলধারায় তাদের অন্তর্ভুক্তও করতে চায় না তারা। কাবুলের মধ্যে যেহেতু বিভেদ অব্যাহতভাবে বাড়ছে, সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানরা হয়তো আফগানিস্তানে নতুন একটা রাজনৈতিক জোট গঠন করাকে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ভাবতে পারে, যেখানে ‘সমমনা’ রাজনৈতিক গ্রুপগুলো যুক্ত হবে।

এই প্রক্রিয়াটা এক পর্যায়ে কিছু রাজনৈতিক অংশকে দৃশ্যপট থেকে ছুঁড়ে ফেলবে এবং একইসাথে আফগানিস্তানে তালেবানদের আধিপত্যের রাস্তাকে আরও পরিস্কার করবে। যুক্তরাষ্ট্রও হয়তো এক পর্যায়ে গিয়ে এই পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারে যদি তালেবান আধিপত্যের কাবুল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান স্বার্থগুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান হয়। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য নিজেকে শান্তির প্রতিশ্রুতিদাতা হিসেবে দাঁড় করাতে চাইবে এবং প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে টিকে থাকতে চাইবে।

এইসব ঘটনাপ্রবাহ থেকে জোরালোভাবে এই ধারণা পাওয়া যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের শুধু যে একটা পরিকল্পনা-বি রয়েছে, তাই নয়, বরং সেই পরিকল্পনায় তালেবানদের সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূমিকা থাকবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর সহায়তা কাটছাট ঘোষণা করে যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে পরিস্কারভাবে তাদের এই উদ্দেশ্য বোঝা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র আর তালেবানদের বিরুদ্ধে কোন সামরিক অভিযানে অংশ নিতে চায় না, বিশেষ করে যেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।

পম্পেও বলেছেন, “আমরা (কাবুলের) নেতৃত্বের কাছে এটা স্পষ্ট করেছি যে আমরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত কোন নিরাপত্তা অভিযানকে সমর্থন দেবো না। সেই সব রাজনৈতিক নেতাদেরকেও সমর্থন দেবো না, যারা এ ধরনের অভিযানের নির্দেশ দেবে এবং যারা একটা সমান্তরাল সরকারের প্রচারণা চালাচ্ছে ও একে সমর্থন করছে”।

তিনি আরও বলেন যে, সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা পরিবর্তনের কোন ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এক পর্যায়ে তালেবানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরোধিতাও করবে না বা সামরিকভাবে সেটার প্রতিরোধ করবে না।

কাবুল থেকে পম্পেওর সোজা দোহাতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে যে, এটা শুধু চুক্তির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার বিষয় নয়, বরং যারা এই চুক্তিকে ভেস্তে দেয়ার চেষ্টা করছে, তাদের নাম এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকায় চলে গেছে এবং তালেবানদের সাথে কষ্টার্জিত চুক্তিকে নষ্ট করার খেলা তাদেরকে খেলতে দেয়া হবে না।

কাবুল যদি প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া তারা পঙ্গু হয়ে পড়বে। কাবুল যদি তাদের ইচ্ছাকে ‘চাপিয়ে দেয়ার’ জন্য সিআইএ-প্রশিক্ষিত মিলিশিয়াদের উপর নির্ভর করে, তাহলে রাজনৈতিক লড়াইটা জাতিগত লড়াইয়ে রূপ নেবে মাত্র এবং শুধু রাজনৈতিক ফ্রন্টে নয়, বরং সামরিক বাহিনীতেও জাতিগত বিভেদটা আরও রাজনৈতিক রূপ নেবে।

আফগানিস্তানে যে অন্তর্কোন্দল, যেখানে সঙ্ঘাতের কোন পক্ষ হিসেবে তালেবানদের উপস্থিতি না থাকার অর্থ হলো- সেটা তালেবানদের প্রকল্পকেই আরও সাহায্য করবে যে, তারা শান্তির পক্ষের শক্তি আর কাবুল সঙ্ঘাতের পক্ষের শক্তি। এ রকম একটা দৃশ্যপটে তালেবানদের ঘটনাবহুল ক্ষমতা গ্রহণের ঘটনা ঘটলে সেটা শুধু দেশের মধ্যেই বৈধতা পাবে না বরং আন্তর্জাতিকভাবেও বৈধতা পাবে। আফগানিস্তানের অধিকাংশ প্রতিবেশী – পাকিস্তান, ইরান, চীন ও রাশিয়া – সবাই তালেবানদের সাথে ভালোভাবে যুক্ত এবং তারা ক্ষমতায় আসলে এই দেশগুলো কোন আপত্তি জানাবে না। যদিও তারা চাইবে যাতে তালেবানরা একই সাথে নির্বাচনী বৈধতাটাও অর্জন করে। ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখে তালেবানরা নিজেদেরকে এখন ‘রাজনৈতিক শক্তি’তে রূপান্তরিত করছে।

পঠিত : ৬৫৫ বার

মন্তব্য: ০