Alapon

আপনার শরীরের জন্য কোন তেল উপকারী; সয়াবিন নাকি সরিষা...?


যারা ত্বকের প্রতি খুবই যত্নবান, সব সময় চেহারার লাবণ্য ধরে রাখতে সচেষ্ট তারা অবশ্যই সয়াবিন তেল খাবেন! আর যদি সামর্থ থাকে তাহলে জায়তুন তেল (Olive oil), এছাড়া বাংলাদেশে সহজলভ্য অন্য কোন তেলই আপনার রান্নায় ব্যবহার করবেন না।
অন্যান্য তেলের সব গুলোই যে পুষ্টিহীন তা নয়, তবে ত্বকের লাবণ্য ধরে রাখতে আপনাকে এতোটা সাহায্য করবেনা।

আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন যে চিকিৎসকরা সব সময়ই কিছু সাধারণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যেমন- বাজারের ভাজা পোড়া খাবার খাবেন না, ডুবো তেলে ভাজা খাবার পরিহার করুন, পোড়া তেলে ভাজা জিনিস খাবেন না, কম আঁচে খাবার রান্না করবেন ইত্যাদি। এগুলো কি তারা এমনি এমনিই বলেন? অবশ্যই না, তাদের এই সাধারণ পরামর্শ গুলোর পিছনে রয়েছে অসাধারণ কিছু কারণ।

আমি (মাসুদ আলম) আজকে আপনাদের খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত দুটি ভোজ্য তেল যথা-সয়াবিন তেল ও সরিষার তেল নিয়ে কিছু কথা বলবো। আর এর মাঝেই খুঁজে পাবেন চিকিৎসকের দেয়া পরামর্শের যুক্তি।

রান্নায় তেল ব্যবহার করা হয় দুটি কারণে- ভিটামিনকে দ্রবীভূত করার জন্য হয় তাই এবং খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য।
আচ্ছা, আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করি যে, আপনার রান্নায় সব সময় কোন তেল ব্যবহার করতে চান? নিশ্চয়ই বলবেন ভালো তেল! কিন্তু ভালো তেল চিনবেন কিভাবে?

আমি বলে দেই, যে তেলের স্মোকিং পয়েন্ট বেশি, পুষ্টিগুণ বেশি এবং তুলনামূলক কম ক্ষতিকর সেটাই আপনার জন্য ভালো তেল।
তবে সহজ প্রাপ্যতা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে দুটি তেল খুব সহজলভ্য এবং জনপ্রিয়ও বটে। সে দুটি থেকে একটি বাছাই করতে হলে জেনে নিতে পারেন এখান থেকে। আমি (মাসুদ আলম) সয়াবিন তেল ও সরিষার তেলের তুলনামূলক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরছি যা আপনার কাজে লাগতেও পারে।

প্রথমেই জানা যাক স্মোকিং পয়েন্ট কি?

তেল গরম করতে থাকলে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এসে তেলের ভিতরে থাকা অক্সিজেন কণা গুলোতে চেইন রিয়্যাকশনের কারণে বিভিন্ন ফ্যাটি এসিড গুলো ভাঙ্গতে থাকে এবং এই এসিড গুলো তখন বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদানে রুপান্তরিত হয়ে যায়। এই তাপমাত্রাই হলো স্মোকিং পয়েন্ট। বিভিন্ন তেলের স্মোকিং পয়েন্টে ভিন্নতা আছে। তেল ভাঙ্গানোর পর অপরিশোধিত অবস্থায় এতে বিভিন্ন রকমের দ্রবীভূত ও অদ্রবীভূত ক্ষতিকর উপদান (phospholipids) থাকে যেগুলো পরিশোধন (Refining) করে দূর করা হয়। অর্থাৎ তেল কে "ধোঁয়া" হয়, এতে তেলের স্মোকিং পয়েন্ট বাড়ে, রং পরিবর্তন হয় এবং দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

নিম্নে কয়েকটি তেলের স্মোকিং পয়েন্ট সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় তুলে ধরছি। এছাড়া ছবিতেও দেখুন।
১) সয়াবিন তেল (অপরিশোধিত)- ২৩৪, পরিশোধিত -২৫৬
২) সরিষার তেল (পরি)-২৫০
৩) তিলের তেল (অপ)-১৭৭, পরি-২৩২
৪) সূর্যমূখী তেল- (অপ)-১০৭, পরি-২৬৬
৫) জায়তুন বা অলিভ অয়েল - এক্সট্রা ভার্জিন -১৬০, ভার্জিন (পরি)- ২১০ ডিগ্রি সেঃ

এবার সয়াবিন তেলের পুষ্টিগুণ, উপকারিতা অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়ে বলা যাক...

* এই তেলে পলি- আনস্যেচুরেটেড ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেশি থাকায় অধিক স্বাস্থ সন্মত, এই এসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

(ছবিতে বিভিন্ন তেলের মনো-আনস্যেচুরেটেড ও পলি- আনস্যেচুরেটেড ফ্যাটি এসিডের মাত্রা এবং কয়েকটি এসিডের রাসায়নিক বন্ধন দেখুন)

* এতে আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যা হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ ভালো রাখে। ও-৩ এসিড মস্তিষ্কের কার্যক্রম ঠিক রাখে, শিশুদের বুদ্ধি বাড়ায়। এটা ইলিশ মাছে বেশি পাওয়া যায়।

* ভিটামিন-K সমৃদ্ধ। ভিটামিন-K রক্তের ক্লোটিং ঠিক রাখে, হাড়ের ঘনত্ব ঠিক রাখে এবং অস্টিওপরোসিস বা হাড় ভঙ্গুরতা রোগ কমাতে সাহায্য করে।
* ভিটামিন-E সমৃদ্ধ, যা সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে ত্বককে সুরক্ষা দেয়, ত্বকের লাবণ্য ধরে রাখে, ত্বক জ্বালাপোড়া কমায়।

* সয়াবিন তেলের বিশেষ কোন তীব্র গন্ধ নাই, ফলে যে কোন ধরনের খাবার রান্নায় ব্যবহার করা যায়।
* চীনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় যে প্রায় ৯ হাজার বছর পূর্ব থেকে সেখানে সয়াবিনের চাষ হতো!
* সয়াবিন বীজ থেকে পুষ্টিকর দুধ (Soya milk) তৈরি করা হয়। (এখান সুপার মার্কেটে পাওয়া যায়, আমি অনেক পান করেছি)
* সয়াবিন ভাঙানোর পর অবশিষ্ট খৈল থেকে পুষ্টিকর সয়ামিট (কুমড়ার বড়ির মতো) তৈরি হয়। রান্না করে খাওয়া হয়। (সুপার মার্কেটে সহজলভ্য)
* খৈলের পাউডার ব্যবহৃত হয় বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদিত দৈ, কেক, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ইত্যাদি তৈরিতে।
সরিষার খৈল পশুখাদ্য হিসেবে এবং জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
* জাপানিদের জনপ্রিয় খাবার তফু (Tofu) তৈরি হয় সয়াবিন বীজ থেকে।

১৫৫ গ্রাম সয়াবিনে যা আছে-

১৮৯ ক্যালরি ( প্রাপ্ত বয়ষ্ক একজন মানুষের প্রতিদিন দরকার ২২২৪ ক্যালরি)
কার্বোহাইড্রেট-১১.৫ গ্রা, প্রোটিন -১৬.৯ গ্রা, চর্বি-৮.১ গ্রা, আঁশ- ৮.১ গ্রাম। এছাড়াও থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ফোলেট, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, জিংক,ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে সরিষার তেলে আছে ৯০১ ক্যালরি, তবে এসব খনিজ উপাদান গুলো নেই।

আমেরিকান পুষ্টিবিদ ম্যালিসা গ্রোভস (Melissa Groves) এর মতে- যারা গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন তাদের জন্য প্রতিদিন সামান্য কিছু সয়াবিন পাউডার খাওয়া কার্যকর সুফল বয়ে আনতে পারে। (চিকিৎসকের পরামর্শ নিন) এছাড়াও এতে প্রাকৃতিক estrogen থাকায় menopause সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে।

এবার সরিষার তেলের পালা!

* এতে রয়েছে কিছু শক্তিশালী এন্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট যা ই-কোলি, সালমোনেলা, স্টাফ (staph), লিস্টেরিয়া ব্যাকরেরিয়া সহ কিছু ইয়েস্ট মেরে ফেলতে পারে।

* এন্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান থাকায় বাহ্যিক ব্যবহারে বড়দের শরীর জ্বালাপোড়া এবং পেশির ব্যথা কমায়।
* ব্রোঙ্কাইটিস ও নিউমোনিয়া রোগির বুকের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

সরিষার তেল ব্যবহারের মারাত্মক কিছু অসুবিধা রয়েছে।
* এতে রয়েছে ইরুসিক (Erucic) এসিড যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সরিষার তেলে কমপক্ষে 40% ইরুসিক এসিড থাকে। তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত এই এসিড রং বা পেইন্ট তৈরিতে এবং প্লাস্টিক উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

* গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এই ইরুসিক এসিড খুবই বিপজ্জনক, কেননা এতে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে।
* সরিষার তেলে আছে Isothiocyanat যা একটি বিষাক্ত রাসায়নিক, তাই চিকিৎসকদের মতে নবজাতকের শরীরে সরিষার তেল মাখানো উচিত নয়, এক্ষেত্রে জায়তুন তেল ব্যবহার করা উচিত।

২০১৯ সালে সরিষা বা সরিষার তেলের উপর সর্বশেষ একটি PhD থিসিস প্রকাশিত হয়। ইরাকের University of Thi-Qar এর প্রফেসর ড. খালিদ আল ফারতোসি ও তার দল হৃৎপিণ্ডের (Heart) উপর সরিষার তেলের প্রভাব নিয়ে দুই বছর গবেষণা করেন। এর পূর্বে হওয়া ৩০ টির বেশি গবেষণার মতো তারাও দেখতে পান যে সরিষার তেল খাওয়ার ফলে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ বা হৃৎপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন সংক্রান্ত রোগ তরান্বিত হয় যেটাকে আমরা হার্ট অ্যাটাক হিসেবে জানি। তাদের গবেষণাটি হয়েছিল ইঁদুরের উপর। (থিসিসের প্রথম পাতাটি ছবিতে দেখুন।)

ক্ষতিকর ইরুসিক এসিডের উপস্থিতি এবং হৃদরোগের স্বাস্থ ঝুঁকির কারণে ১৯৭০ সাল থেকে আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেটস ফুড এন্ড ড্রাগ অথরিটি (USFDA) ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেল আমেরিকাতে নিষিদ্ধ করেছে। তবে বাজারে ম্যাসাজ অয়েল হিসেবে বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে বোতলের গায়ে বড় করে লিখতে হয় " External use only" অর্থাৎ শুধুমাত্র বাহ্যিক ব্যবহারের জন্য (শরীরে মাখার জন্য), খাওয়ার জন্য নয়!
কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি সহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭ টি দেশে ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেল নিষিদ্ধ!
১৯৯৮ সালে ভারতের দিল্লি রাজ্য সরকার সরিষার তেল ভোজ্য তেল হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে আমার জানা মতে এধরণের কোন গবেষণা এখনো হয়নি।

উপরোক্ত সবগুলো দেশই কিন্তু আমাদের চেয়ে শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ বিজ্ঞান গবেষণা, ফুড সেফটি ইত্যাদি সব দিক থেকে অনেক অনেক এগিয়ে।
যাহোক সিদ্ধান্ত এখন আপনার, আপনি কোন তেল খাবেন!!
ধন্যবাদ

মাসুদ আলম

পঠিত : ১৬৯৫ বার

মন্তব্য: ০