Alapon

হাল আমলের আলেমরা দিনদিন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে কেন...?


আমাদের আলেম বানানোর সিলেবাসে বিজ্ঞান অনুপস্থিত। বরং মিরপুর শাহ আলী মাদরাসার দেয়ালে একটা হাদীস লেখা দেখেছিলাম, “দ্বীনি এলেম অর্জন করা প্রতিটি নারী-পুরুষের জন্য ফরজ”। অথচ হাদীসের মূল ভাষ্যে কোথাও “দ্বীনি” শব্দটা নেই, শুধু ‘এলেম’ আছে। এই যে আল্লাহ ও তার রসূল (স)-এর চেয়ে একধাপ বেশি বোঝার চেষ্টা- এখানেই সমস্যা।

কুরআনের পাতায় পাতায় সৃষ্টি নিয়ে ভাবতে বলা হয়েছে। মানুষের সৃষ্টি প্রক্রিয়া ও নিজের দেহের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গবেষণা করতে বলা হয়েছে। তো ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস এগুলো তো আল্লাহরই সৃষ্টি, এগুলো তো শরীরেরই অংশ। এগুলো শরীরে কিভাবে কাজ করে আর শরীর কীভাবে এগুলোর সাথে লড়াই করে এই জ্ঞান না থাকলে দৈহিক গঠন নিয়ে চিন্তাভাবনার পূর্ণতা পাওয়া সম্ভব? আর কীভাবেই বা মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখা সম্ভব?
সম্ভব না।

আমাদের আলেম বানানোর সিলেবাসে বিজ্ঞান নেই ভালো কথা, কিন্তু যাদের কাছে বিজ্ঞানের জ্ঞান আছে তাদের নিকট থেকে জ্ঞান নেয়ার ব্যাপরেও যদি অনীহা থাকে, সেটা কি ইসলাম সম্মত? সেটা কি অপরাধ না?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান বলছে আল্লাহ এই ভাইরাসকে বানিয়েছেনই এমন বৈশিষ্ট্য দিয়ে যে জনসমাগমে ভাইরাস ছড়াবে। আর মসজিদে নামাজের যে পদ্ধতি, তাতে এটা ছড়ানোর ঝুঁকি আরো বেশি। অথচ এই অঞ্চলের প্রচলিত সিলেবাস পড়া আলেমরা বলছেন সমস্যা নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, কোন জ্ঞানের ভিত্তিতে তারা এই রায় দিচ্ছেন??
দুর্যোগে দুর্বিপাকে মানুষকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে আলেমদের এই ব্যার্থতা পুরো সমাজ ব্যবস্থাপনায় তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে আরো হালকা করে দেবে। ভারতের উত্তর প্রদেশে অলরেডি তাবলিগ জামায়াতকে মানবতার শত্রু আখ্যা দেয়া হয়েছে করোনা ছড়ানোর দায়ে।

সময়ের জ্ঞানের আলোকে চিন্তা-গবেষণা বাদ দিয়ে হাজার বছর আগের ফতোয়া ও ব্যখ্যা মুখস্ত করে আলেম হওয়ার এই সিলেবাস আলেমদেরকে দিন দিন মানবতার জন্য আরো অপ্রাসঙ্গিক করে দেবে কোন সন্দেহ নেই।

কয়েকটা উদাহরণ দেইঃ
০১. “মায়ের গর্ভে কী আছে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা।”- এই আয়াতের ব্যাখ্যা এক সময়ে ছিলো মাতৃগর্ভে ছেলে না মেয়ে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেননা। কিন্তু এখন তো আল্ট্রাসনো করে সন্তান ছেলে না মেয়ে তা খুব ভালোভাবেই জানা সম্ভব।

সুতরাং, কুরআন ভুল না, বরং ব্যখ্যা ভুল। ঐ সময়ের জন্য এই ব্যখ্যা পুরোপুরি সঠিক ছিলো। কিন্তু সর্বশেষ জ্ঞানের আলোকে ব্যখ্যা হবে মায়ের গর্ভের সন্তানের চরিত্র, মেধা, গুনাগুন, জীবিকা, হায়াত, ইত্যাদি কারো জানা নেই।
তো কুরআন হাদিস নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা না করে হাজার বছর আগের তাফসীর মুখস্ত করে বসে থাকলে কি এই ব্যখ্যা দেয়া সম্ভব?

০২. “.. যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট বাধা রক্ত থেকে “ একসময় এই ছিলো অনুবাদ। কিন্তু এখনকার চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে রক্ত জমাট বেধে যাওয়া মানে রক্তকনিকা মরে যাওয়া। আর মৃত রক্তকনিকার বৈশিষ্ট্যই আল্লাহ এমন করে দিয়েছেন যে তা দিয়ে নতুন সৃষ্টি সম্ভব নয়। আর বিশেষ মোজেজা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম করেননা।

তাহলে কোনটা ভুল- কুরআন (নাউজুবিল্লাহ) নাকি বিজ্ঞান?
কোনটাই ভুল না, ভুলটা অনুবাদে। এখানে আল্লাহ তায়ালা চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেছেন কিন্তু অনুবাদক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বশেষ জ্ঞান না জানায় সঠিক শব্দটা বাছাই করতে পারেনি।

আলাক শব্দের একটি অর্থ ঝুলে থাকা বস্তু। মাতৃগর্ভে সন্তানের একেবারে শুরুর অবস্থান হচ্ছে একটি শুন্য ঘরের ছাদে ঝুলন্ত একটি ছোট্ট পিন্ডের মত। আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে এমন ছবিই পাওয়া যায়। আল্ট্রাসনোগ্রাফী আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের আলোকেই আবিষ্কৃত। সুতরাং এখনকার সময়ের ব্যখ্যা করতে এই জ্ঞানের আলোকেই করতে হবে।
কিন্তু সর্বশেষ জ্ঞানের আলোকে কুরআন নিয়ে গবেষণা না করে হাজার বছর আগের তাফসীর মুখস্ত করে কি এই ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব?

এই আলাক্ব শব্দের আরেকটি ব্যবহার আমরা দেখতে পাই বিখ্যাত একটি হাদিসে। ৭ শ্রেণীর লোক কিয়ামতের কঠিন দিনে আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে। তাদের মধ্যে একশ্রেণীর হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত বা লটকানো থাকে; তারা এক নামাজ থেকে বের হয়ে পরের নামাজের অপেক্ষায় থাকে।

তো এখানে ঝুলন্ত অর্থটি মুয়াল্লাক শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে যা আলাক্ব থেকে উদ্ভুত। এখানে কিন্তু নির্বিশেষে সব আলেম ঝুলন্ত অর্থই ব্যবহার করেন।
কিন্তু এই অর্থ যে ওই মাতৃগর্ভের সৃষ্টির সাথে ব্যবহার করা যায়, সেজন্য তো চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে লেটেস্ট ধারণা থাকতে হবে। নাই বলেই জমাট বাধা রক্তের উপরই আলেমগণ এখন পর্যন্ত টিকে আছেন।

০৩. ‘কলব’ মানে অন্তর যা থাকে বক্ষের সম্মুখে (সদর)। এমনটাই এতদিনকার ব্যাখ্যা। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রমাণিত জ্ঞান হচ্ছে বুকের ভেতরে থাকা হার্ট বা হৃদপিণ্ড রক্ত পাম্প করা ছাড়া আর কোন কাজ করেনা। এমনকি হার্ট অপসারণ করে সেখানে কৃত্রিম পাম্পার মেশিন বসিয়ে দিলেও মানুষ দিব্যি চলতে পারে।
তাহলে ক্বলবের যে কাজ সেটি কোথায় হয়? ভালো ও মন্দের পার্থক্য করা, চিন্তা করা, গবেষণা করা এগুলো?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রমাণিত জ্ঞান বলছে সেটা হয় সম্মুখ মস্তিষ্কের অগ্রভাগে। অগ্রভাগ, সম্মুখভাগ, কথাগুলো কিন্তু মিলে যাচ্ছে। সদর শব্দের অর্থও সম্মুখভাগ। এখন সেটা বুক না হয়ে মাথার সম্মুখভাগে কিনা সেটা নিয়ে গবেষণা করাটা আলেমদের দায়িত্ব। এজন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের লেটেস্ট জ্ঞানকেও সামনে রাখতে হবে।
কিন্তু নতুন গবেষণা বাদ দিয়ে শুধু হাজার বছর আগের তাফসীর মুখস্ত করে আলেম হলে কি এই ব্যখ্যা করা সম্ভব?

মোদ্দা কথা আলেমরা যদি বিজ্ঞান থেকে দূরে থাকে, গবেষণা থেকে দূরে থাকে তাহলে দিনকে দিন সমাজের জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। ইসলামকে মানুষের জন্য অপ্রাসঙ্গিক করার এই দায় আলেমরা এড়াতে পারেবেন?

আলেমদের আন্তরিকতা, আমল ও আল্লাহভীতি নিয়ে আমাদের প্রশ্ন নেই। তাদের তুলনায় আমরা খুব নগণ্য এক বান্দা। কিন্তু তাদের জ্ঞান আহরণ ও চর্চার পন্থা যদি তারা পরিবর্তন না করেন তাহলে মানবতার জন্য যেমন তারা অপ্রয়োজনীয় হবেন, আল্লাহর কাছেও কি জবাবদিহীতা থেকে মুক্ত থাকবেন??

পঠিত : ৫১৯ বার

মন্তব্য: ০