Alapon

৮ এপ্রিল ২০১৮; যে রাতে ঢাবি ক্যাম্পাস পরিণত হয়েছিল এক যুদ্ধক্ষেত্রে



২০১৮-এর এপ্রিলের পূর্বে এবং বিগত কয়েক বছর ধরে বিচ্ছিন্নভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন চললেও, তা ২০১৮ সালের এপ্রিলে এসে সারা দেশব্যাপী ব্যাপকতা লাভ করে। এরই সূত্র ধরে ৮ এপ্রিল ঢাবি ক্যাম্পাসে আরেকটি ‘গণ অভ্যুত্থান’ তৈরি হয়েছিল। যা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্টানে। কিছুদিন পূর্বের ভ্যাটবিরোধী দমকা হাওয়ার চাইতেও বড় বিক্ষোভ দেখা দিল। তৈরি হয়েছিল প্রতিবাদের নতুন ভাষা। সেই ভাষা অহিংস, সেই ভাষা বৈষম্যবিরোধী, যে ভাষা এদেশের অগণিত তারুণ্যের দ্রোহকে জানান দিয়ে গিয়েছিল। এই তরুণেরা উঠতি বাংলাদেশের প্রতীক। জনমত বলতে এদের মতকেই বোঝায়।



ঢাবিতে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়েছিল যেভাবে-

২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল রোববার সকাল ১০টার দিকে ঢাবির বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যে জমায়েত হয়েছিল। নব্বইয়ের পর এত বড় মিছিল ঢাকা শহরে আর দেখা যায়নি। মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়েছিল ঢাবি ক্যাম্পাস। সবার গন্তব্য রাজু ভাস্কর্য। বিকেলে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে শত শত শিক্ষার্থী কোটা সংস্কারের দাবিতে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। তাঁরা সেখানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলেন। কোনো হট্টগোল নেই। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিচ্ছেন, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’,‘কোটা প্রথার সংস্কার চাই’,‘রাজপথ ছাড়ি নাই’। চারপাশে অপেক্ষমাণ যানবাহনের যাত্রীরা শিক্ষার্থীদের সমাবেশের প্রতি মৌন সমর্থন জানাচ্ছিলেন। কারও চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ নেই। ওদিকে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর হেলমেটধারী সদস্যরাও দিনের বেলা ছিলেন শান্ত, ধীরস্থির। কেউ মিছিলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। মিছিলের পুরোভাগে যাঁরা, সজাগ ছিলেন কোনো অঘটন যেন না ঘটে। এরই মধ্যে মিছিল থেকে একজন পানির একটি খালি বোতল ছুড়ে মারলেন পুলিশের দিকে। নেতারা সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিলেন।



রাতে হঠাৎ করে যেভাবে দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটে-

রাত আটটার দিকে হঠাৎ পুলিশ বিনা উস্কানিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে ত্রিমাত্রিক আক্রমণ চালায়। একদিকে তাদের লাঠিপেটা করে, রাবার বুলেট ছোড়ে। অন্যদিকে টিয়ার গ্যাস এবং জলকামান থেকে গরম পানি ছোড়ে। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাও পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। আবাসিক হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও রাতে হল থেকে বেরিয়ে আসেন অসংখ্য ছাত্রী। তাঁরাও যোগ দেন বিক্ষোভে। এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে কিছু অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত ঢাবি ভিসির বাসভবনে হামলা ও ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। যে দুর্বৃত্তদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
রাত আড়াইটার দিকে নীলক্ষেতের দিক থেকে ‘জয় বাংলা’স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের কয়েক'শ নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন। তাঁদের অধিকাংশই ঢাকা কলেজসহ মহানগর ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত বলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা পরে জানান।
ভোর পৌনে চারটার দিকে প্রায় ৬০টি গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকে র‍্যাব। পুলিশ ও র‍্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি লাঠিসোঁটা, রড, পাইপ নিয়ে অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা।
ভোর সাড়ে ৪টায় ভিসির বাসভবনের বাগানে আলোচনা করছিলেন জাহাঙ্গীর কবির, আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষক সমিতির নেতা মাকসুদ কামাল, কবি আবদুস সামাদসহ অন্যরা এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। জাহাঙ্গীর কবির নানক সোমবার দিনের বেলায় যেভাবে হোক, ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য বলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের।

রাতের এই ভয়াবহ সহিংস ঘটনার পর পরদিন ৯ এপ্রিল সকালে ঢাবি ক্যাম্পাসকে পরিত্যক্ত যুদ্ধক্ষেত্র মনে হচ্ছিল। চারিদিকে ইটের টুকরা, কাঠ, বাঁশের ছড়াছড়ি। জায়গায় জায়গায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী। কাঁদানে গ্যাসের শেলের খালি কৌটাগুলোও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কার্জন হল থেকে ঝাঁজালো ওই শেলের গন্ধ ছড়াচ্ছিল পুরো ক্যাম্পাসে। যেন পরিত্যক্ত যুদ্ধক্ষেত্র।




এই মর্মান্তিক ঘটনার পরবর্তীতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশব্যাপী।
এই আন্দোলনের একটি বহুল সমালোচিত ঘটনা ছিল ঢাবি ভিসির বাসভবনে হামলা চালানো। যা প্রসঙ্গে আন্দোলনকারীরা বলেছিল,‘উপাচার্যের বাসভবনে যারা হামলা করেছে, সরকার তাদের ধরুক। কিন্তু নিরীহ ও নিরপরাধ শিক্ষার্থীরা যেন নিগৃহীত না হন।’
কয়েক মাস ধরেই সুনির্দিষ্ট পাঁচটি দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিলঃ
দাবিসমূহ হলো:
১। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমান কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা।
২। কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া।
৩। সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ।
৪। কোটায় কোনও ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না রাখা।
৫। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা।

কোটাব্যবস্থা চালু করা হয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে, কিন্তু এখন কোটা নিজেই বঞ্চনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও বিবিএসের তথ্য মতে, বাংলাদেশে মাত্র ২৬ লাখ বেকার। কিন্তু এ তথ্য ইতিমধ্যেই বিতর্কিত এবং লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) পরিসংখ্যান মতে, পৃথিবীতে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়, বরং এটি বঞ্চনার বিরুদ্ধে। যদি শিক্ষার্থীরা এদেশে পাস করেই কাজের সুযোগ পেতেন, তাহলে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবি উঠত না। কিন্তু একদিকে উন্নয়নের ঝংকারে কান বন্ধ হয়ে যায়, আরেক দিকে লাখ লাখ তরুণের কাজের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
মুক্তিযোদ্ধারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কোটাব্যবস্থা তার প্রতিদান। ২০১৪ সালের ২৪ মার্চে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের সংসদে প্রদান করা লিখিত বক্তব্য অনুসারে তালিকাভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মাত্র ৫ হাজার ৯৯১ জন। বর্তমান কোটাব্যবস্থা মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের প্রতিদান দেওয়া হচ্ছে তাঁদের নানা-দাদাদের আত্মত্যাগের জন্য, কিন্তু ৩০ লাখ শহীদের পরিবারের কোনো দায় রাষ্ট্র নেয়নি। এই কোটাব্যবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারাই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারাই প্রকৃতই প্রান্তিক জীবনযাপন করেন, তাঁদেরই শুধু কোটাব্যবস্থায় মধ্যে নয়, বিশেষ সুবিধা দিয়ে সুন্দর জীবনের সুযোগ করে দেওয়া উচিত ছিল।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল লিখেছেন, ‘১৯৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্পর্কে কিছু বলা নেই। এই সংবিধান প্রণীত হয়েছিল যে গণপরিষদে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরিতে কোটা প্রদানের কথা উত্থাপিতই হয়নি। গণপরিষদে কেবল সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান প্রসঙ্গে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।’
(বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৭০-১)।

এমনকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরাও অনেকে এই দাবিগুলোর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছিলেন। নিজের ফেসবুক পেজে বখতিয়ার আহমেদ লিখেছেন:
‘আমার বাপ বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা। তার ছয় সন্তানের কারও কোনো দিন কোটা লাগে নাই। কেউ কখনো কোথাও কোটায় আবেদন করেনি। কোটা তাদের সন্তানদেরও লাগবে না। তোলেন এই কোঠারিতন্ত্র। এক্ষুনি।’
বিক্ষোভের জোয়ারের লম্বা ইতিহাসটা জানা থাকা চাই। জানা থাকা চাই, জীবন নুইয়ে এসেছে এমন মা-বাবার দুঃখের কথা। যৌবনের সোনালি দিনগুলোতে মেসে-হলে থেকে, বাসে ঝুলে, খেয়ে না-খেয়ে চলা জীবনের গল্পগুলো শুনতে হবে। যারা মাস্তানি করে, নেশা করে, ক্ষমতাসীনদের লেঠেল যারা, তাদের এত অভিমান আসার কথা না। যারা সেদিন ক্ষোভে আগুন হয়েছিল, তাদেরই কাঁদতে দেখেছি আগে। ওই সব অব্যক্ত কান্নাই বাংলাদেশের গৌরবের পতাকা হাতেই রাজপথে নিজেকে জাহির করেছিল শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশের সকল দেশপ্রেমিক, সুবিবেচক এবং সচেতন ব্যক্তিই সেদিন এই আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থা চিরন্তন প্রথা হতে পারে না। অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় আনার লক্ষ্য অর্জনের ব্যবস্থা হচ্ছে কোটা। কোন কোটা রাখা প্রয়োজন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংস্কার করা প্রয়োজন।’

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায় এবং বাংলাদেশের সংবিধানে সরকারের ওপর সেই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। সরকারি দল রাজনৈতিক কৌশলে পারদর্শিতা দেখাতে গিয়ে সেই দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আর এই সিদ্ধান্তের দায় আন্দোলনকারী তরুণদের ওপর চাপিয়ে দিতে যাঁরা ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠছেন, তাঁরা আশা করি ভেবে দেখবেন যে এই তরুণেরাই দেশের ভবিষ্যৎ।’

প্রথম আলোর কলামিস্ট ফারুক ওয়াসিফের ভাষায়, ‘দিনের শেষে রাষ্ট্র একটা যন্ত্র। এই যন্ত্রে জং ধরলে, ময়লা জমলে, নতুন সময়ের প্রয়োজন মেটাতে না পারলে তাকে সংস্কার করে নিতে হয়। সেই দায়িত্ব সরকারের যত, জনগণেরও ততটাই। সময়ে সময়ে জনগণের বিভিন্ন অংশ তার জন্য গতি ও বেগ দুটোই দিয়ে যায়। উঠতি মধ্যবিত্তের তরুণ সন্তানেরা ইতিহাসের সেই দায়িত্বটাই পালন করছে মাত্র। একে স্বাগত।’
পরিশেষে, অবিচার-অনিয়মের বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কণ্ঠস্বর থেমে যায়, তখন গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই আমরা জানি, গণতন্ত্র অর্জন করতে হলে বিস্তর খেসারত দিতে হয়। বঙ্গবন্ধুর কথাটা একবার ভাবুন, জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই তাঁকে কাটাতে হয়েছে কারান্তরালে। তাঁর সেই আত্মত্যাগের ফসল ছিল আমাদের স্বাধীনতা।
তাই প্রতিটি যৌক্তিক আন্দোলনে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন জ্ঞাপন করা আমার আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

পঠিত : ৫৭৮ বার

মন্তব্য: ০